ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সদ্য প্রয়াত নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার গত এক বছর ধরে ছিলেন লোকচক্ষুর আড়ালে। ধারণা করা হচ্ছিল, দীর্ঘ সময়ে মাটির নিচে হামাসের তৈরি সুড়ঙ্গের মধ্যে একদল দেহরক্ষী এবং ইসরায়েলি জিম্মিদের ‘মানবঢাল’ বানিয়ে আত্মগোপনে ছিলেন তিনি। তবে মৃত্যুর আগে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় মাত্র তিনজন সঙ্গীকে নিয়ে একটি ভবনের কক্ষে প্রবেশ করলেও শেষ মুহূর্তে তিনি ছিলেন একা।
ইসরায়েলি কর্মকর্তারা জানান, ফিলিস্তিনের দক্ষিণ গাজায় বুধবার (১৬ অক্টোবর) ইসরায়েলি সেনাদের সঙ্গে হামাসপ্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ারের বন্দুকযুদ্ধ হয়। একপর্যায়ে তিনি নিহত হন। অভিযানে অংশ নেওয়া ইসরায়েলি সেনারা প্রাথমিকভাবে জানতেন না যে তারা তাদের দেশের ১ নম্বর শত্রুকে পেয়ে গেছেন।
বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, বুধবার দক্ষিণ গাজায় অভিযান চালিয়ে সিনওয়ারকে হত্যা করা হয়েছে। আঙুলের ছাপসহ ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে তারা নিশ্চিত হয়েছে যে সিনওয়ার নিহত হয়েছেন।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী এক বিবৃতিতে বলেছে, এক বছর ধরে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) ও নিরাপত্তা সংস্থা (আইএসএ) গাজায় অনেক অভিযান পরিচালনা করেছে। এমনকি যে এলাকায় সিনওয়ারকে হত্যা করা হয়েছে, সেই এলাকায় সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে অভিযান চালানো হয়। এসব অভিযানের ফলে সিনওয়ারের কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়েছিল। ইসরায়েলি বাহিনী তাকে তাড়া করে চলছিল। শেষ পর্যন্ত তাকে নির্মূল করা হলো।
ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বলেছেন, বুধবার দক্ষিণ গাজার তেল আল সুলতান এলাকায় তল্লাশি-অনুসন্ধান চালানোর সময় সিনওয়ারকে পেয়ে যান ইসরায়েলের পদাতিক সেনারা। এলাকাটিতে হামাসের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সদস্য অবস্থান করছেন, এমনটা ভেবে অভিযান চালাচ্ছিলেন ইসরায়েলি সেনারা। সেখানে সিনওয়ারের থাকার বিষয়টি জানতেন না ইসরায়েলি সেনারা।
ইসরায়েলি কর্মকর্তারা জানান, অভিযানকালে সেনারা তিনজন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে বিভিন্ন ভবনের মধ্য দিয়ে সরে যেতে দেখেন। একপর্যায়ে তারা গুলি চালান। দুই পক্ষের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এ সময় সিনওয়ার সরে গিয়ে একটি বিধ্বস্ত ভবনে ঢুকে পড়েন।
ইসরায়েলের গণমাধ্যমের বিবরণ অনুযায়ী, পরবর্তী সময়ে ভবনটি লক্ষ্য করে ট্যাংক দিয়ে একাধিক গোলা ছোড়ে ইসরায়েলি বাহিনী। এ ছাড়া তারা একটি ক্ষেপণাস্ত্রও ছোড়ে।
গতকাল ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী একটি ছোট ড্রোন থেকে নেওয়া ফুটেজ প্রকাশ করে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বলছে, ফুটেজে যে ব্যক্তিকে চেয়ারে বসে থাকতে দেখা যায়, তিনি সিনওয়ার। তার হাতে গুরুতর আঘাতের চিহ্ন দেখা যায়। তার মুখ স্কার্ফে ঢাকা। ফুটেজে দেখা যায়, তিনি ড্রোনটির দিকে একটি লাঠি ছুড়ে মারার চেষ্টা করছেন। তিনি এভাবে ড্রোনটিকে ফেলে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হাগারি বলেছেন, অভিযানকালে সিনওয়ারকে শুধু একজন হামাস যোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন ইসরায়েলি সেনারা। তার সঙ্গে ছিল একটি অস্ত্র, একটি প্রতিরক্ষামূলক জ্যাকেট ও ৪০ হাজার ইসরায়েলি মুদ্রা শেকেল।
এদিকে, দখলদার ইসরায়েলের হামলায় গত বুধবার প্রাণ হারান হামাস প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ার। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর মুখপাত্র ড্যানিয়েল হ্যাগারি দাবি করেছেন, সিনওয়ারের কাছ থেকে নগদ ৪০ হাজার শেকেল (ইসরায়েলি মুদ্রা), অস্ত্র এবং নিরাপত্তা ভেস্ট পাওয়া গেছে।
এছাড়া ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম চ্যানেল-১২ কয়েকটি জিনিসের একটি ছবি প্রকাশ করেছে। সংবাদমাধ্যমটি দাবি করেছে, সিনওয়ারের সঙ্গে এসব জিনিস পাওয়া গেছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, এতে রয়েছে একটি পাসপোর্ট, আল-আকসা মসজিদের ছবি সংবলিত দুটি বই, হাত ঘড়ি, নেইল কাটার, তজবিহ, মেন্টস চকলেট, একটি গুলি, আতর, স্কচটেপ এবং টুথপেস্ট সদৃশ্য কাজগের সবুজ বাক্স।
তবে যে পাসপোর্টটি মিলেছে সেটি সিনওয়ারের নয়। এটি আরেক ব্যক্তির। যিনি জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার হয়ে কাজ করতেন। এই পাসপোর্ট সিনওয়ার কেন বহন করছিলেন সেটি নিশ্চিত নয়।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর মুখপাত্র জানিয়েছেন, যেসব সেনা সিনওয়ারকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছিলেন তারা জানতেন না ওই ব্যক্তি সিনওয়ার ছিলেন। হামলার পর সেখানে গিয়ে সিনওয়ারের মতো দেখতে এক ব্যক্তির মরদেহ খুঁজে পান তারা। এরপর পরিচয় নিশ্চিত হতে প্রথমে মরদেহটির আঙুল ইসরায়েলে পাঠানো হয়। এরপর মরদেহটি উদ্ধার করা হয়। সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে জানা যায়, ইসরায়েলি সেনারা নিজেদের অজান্তে সিনওয়ারকে হত্যা করেছেন।
সিনওয়ার তার জীবনের ২২ বছর দখলদার ইসরায়েলের কারাগারে ছিলেন। ১৯৮৮ সালে দুই ইসরায়েলি সেনাকে জিম্মি এবং তাদের হত্যা করায় সিনওয়াকে আটক করা হয়েছিল। ২০১১ সালে বন্দি বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে মুক্তি পান তিনি। সিনওয়ার যখন কারাগারে ছিলেন তখন ইসরায়েলি সরকার তাকে পর্যবেক্ষণ করে বলেছিল, তিনি ‘দয়ামায়াহীন’ এবং ‘শক্তিশালী’। ২০১৭ সালে হামাসের গাজা শাখার প্রধান হন তিনি। এরপর চলতি বছরের জুলাইয়ে ইসমাইল হানিয়া যখন গুপ্তহত্যার শিকার হন তখন তিনি হামাসের প্রধান নেতার দায়িত্ব পান। -সূত্র: রয়টার্স, বিবিসি
আরএস