একটি নতুন ভোর। মধ্যপ্রাচ্যে সূচনা হলো নতুন একটি ইতিহাসের। প্রায় ৫৪ বছরের পারিবারিক শাসনের অবসান ঘটলো সিরিয়ায়। দেশটির কর্তৃত্ববাদী শাসক বাশার আল-আসাদ বিদ্রোহীদের কাছে পরাজিত হয়েছেন। ব্যক্তিগত উড়োজাহাজে পালিয়েছেন দেশ ছেড়ে। সিরিয়ার ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত এ শাসকের উত্থান হয়েছিল কীভাবে? কীভাবে তিনি উঠে এলেন মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসনে? এই লেখায় খোঁজা হয়েছে সে সব প্রশ্নের উত্তর।
বাশার আল আসাদ ছিলেন সিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল আসাদের সন্তান। হাফিজের পর ক্ষমতা গ্রহণের কথা ছিল বড়ভাই বাসেল আল বাশারের। ফলে রাজনীতি থেকে নিরাপদ দূরেই ছিলেন ছোটভাই বাশার আল আসাদ। বাশার যে শাসনভার গ্রহণ করবেন, তা নিজেও জানতেন না। তবে কথিত আছে- এক গাড়ি দুর্ঘটনা ভাগ্য খুলেছে বাশার আল আসাদের। ফলে শাসক হিসেবে অভিষেকের পেছনে এ দুর্ঘটনাই সম্ভবত বড় প্রভাবক বলে মনে করা হয় বাশারের জীবনে।
বাশার আল আসাদের বড়ভাই বাসেল আল আসাদ গাড়ি দুর্ঘটনায় নিহত হন ১৯৯৪ সালে। দামেস্কের কাছে ওই দুর্ঘটনা যখন ঘটে আসাদ তখন লন্ডনে চক্ষু চিকিৎসা নিয়ে পড়ছিলেন। মূলত বাসেলের মৃত্যুর পর আসাদকে ক্ষমতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা শুরু হয়।
বাশারের পিতা হাফিজ আল আসাদ প্রায় ৩০ বছর সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। পিতার হাত থেকে ক্ষমতা নেওয়ার জন্য তাকে তৈরি করা হয়নি। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে তিনিই দেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে, যে যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ মারা গেছেন, বাস্তুচ্যুত হয়েছেন অনেকে।
১৯৬৫ সালে বাশার আল-আসাদের জন্ম। ওই সময়েও সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যে নাটকীয় ঘটনা ঘটেছিল। সেই সময় মিশর ও সিরিয়া মিলে স্বল্পকালীন যে আরব প্রজাতন্ত্র করেছিল, তা ভেস্তে যাওয়ার পর বাথ পার্টি ক্ষমতা দখল করে। অন্য আরব দেশের মতো সিরিয়াতেও গণতন্ত্র ছিল না ও বহুদলীয় নির্বাচন হতো না। আঞ্চলিক রাজনীতিতে সেখানকার সব দেশেই আরব জাতীয়তাবাদ নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় ছিল।
আসাদের পরিবার যে সম্প্রদায়ের ছিলেন তারা ছিলেন সিরিয়ার খুবই অনগ্রসর একটি সম্প্রদায়। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তাদের অনেক সদস্য সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। হাফিজ আল আসাদ সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে উঠে আসেন। ১৯৬৬ সালে তিনি বাথ পার্টির সরকারে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হন। পরে দেশের প্রেসিডেন্ট হন ১৯৭১ সালে। এরপর ২০০০ সালে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ওই পদেই বহাল ছিলেন। তার সময়ে অনেকগুলো সামরিক অভ্যুত্থান হলেও তা সফল হয়নি। বরং বিরোধীদের দমন ও গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে তিনি কঠোর হাতে দেশ শাসন করেছেন।
মেডিসিন ও লন্ডন
রাজনীতি ও সামরিক বাহিনী থেকে দূরে থাকতে বাশার আল-আসাদ ডাক্তার হিসেবেই তার ক্যারিয়ার গড়তে চেয়েছিলেন। দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রাজুয়েশন শেষে তিনি ১৯৯২ সালে যুক্তরাজ্যে যান লন্ডনের ওয়েস্টার্ন আই হসপিটালে চোখের ডাক্তার হিসেবে পড়ালেখার জন্য।
এ সময় তিনি ইংরেজ গায়ক ফিল কলিন্সের অনুরক্ত হন ও পশ্চিমা সংস্কৃতিতে উদ্বুদ্ধ হন। লন্ডনেই আসমা আল-আখরাসের সঙ্গে তার দেখা হয়। পরবর্তীতে তারা বিয়ে করেন। আসমা কিংস কলেজে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়তেন। তিনি হার্ভার্ডে ভর্তির জন্য বিবেচিত হয়েছিলেন।
কিন্তু বাশার আল আসাদের জীবনের গতিপথ পাল্টে যায় বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর। ওই মৃত্যুই মূলত বাশার আল-আসাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তৎক্ষণাৎ তাকে ফিরে যেতে হয় সিরিয়ায় এবং এরপর তাকে সিরিয়ার পরবর্তী নেতা হিসেবে প্রস্তুত করার কাজ শুরু হয়। বাশার সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন এবং ভবিষ্যতের জন্য জনগণের সামনে নিজের ইমেজ তৈরির প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
পরিবর্তনের স্বপ্ন
হাফিজ আল আসাদের মৃত্যুর পর ২০০০ সালে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে দ্রুতই প্রেসিডেন্টের পদে আসীন হন বাশার আল আসাদ। তবে, এজন্য দেশটির সংবিধানে প্রেসিডেন্টের সর্বনিন্ম বয়স ৪০ বছর থাকার যে বিধান ছিল তা পরিবর্তন করতে হয়। দায়িত্ব নিয়ে তিনি ‘স্বচ্ছতা, গণতন্ত্র, উন্নয়ন, আধুনিকায়ন, জবাবদিহিতা ও প্রাতিষ্ঠানিক ভাবনা’র কথা বলেছিলেন।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার কয়েক মাস পর তিনি আসমা আল আখরাসকে বিয়ে করেন। তাদের তিন সন্তান- হাফিজ, জেইন এবং কারিম। প্রথমদিকে তার রাজনৈতিক সংস্কার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বিষয়ক বক্তব্য অনেককে আশাবাদী করেছিল। তার নেতৃত্বের স্টাইল ও পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত আসমার সঙ্গে জুটিবদ্ধ হওয়া- অনেককে স্বপ্ন দেখিয়েছিল।
কিন্তু ২০০১ সালে নিরাপত্তা বাহিনী ব্যাপক দমন অভিযান চালায় ও বহু সোচ্চার কণ্ঠকে আটক করে। বাশার আল আসাদ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সীমিত সংস্কার করলে ব্যক্তি খাত উৎসাহী হয়ে ওঠে। তবে আর শাসনের প্রথম দিকে উত্থান হয় তার চাচাতো ভাই রামি মাখলৌফের। তিনি সম্পদ আর ক্ষমতার সমন্বয়ে বিশাল ব্যবসা সাম্রাজ্য তৈরি করেছেন।
আরএস