ড. ইউনূসের সেভেন সিস্টার্স নিয়ে বক্তব্যে তোলপাড় ভারতে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক প্রকাশিত: এপ্রিল ১, ২০২৫, ০৪:৪২ পিএম

দ্য উইক, টাইমস অব ইন্ডিয়া ও দ্য হিন্দুর প্রতিবেদন।। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি চীন সফরের সময় ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যে ব্যবসায়িক সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেছেন।

তিনি বলেছেন, ‘ভারতের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত সাতটি রাজ্য সম্পূর্ণরূপে ল্যান্ডলকড (স্থলবেষ্টিত)। সমুদ্রের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের কোনো উপায় নেই। আমরাই এই অঞ্চলের জন্য সমুদ্রের একমাত্র অভিভাবক।’

ড. ইউনূসের এই মন্তব্য নিয়ে ভারতের নীতিনির্ধারক ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়েছে। ড. ইউনূসের এই বক্তব্যকে হুমকি হিসেবে পাঠ করছেন তাঁরা। দিল্লি আনুষ্ঠানিকভাবে ড. ইউনূসের বক্তব্যের কোনো প্রতিক্রিয়া না জানালেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সঞ্জীব সান্যাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লিখেছেন, ‘ভারতের সাতটি রাজ্য স্থলবেষ্টিত হওয়ার তাৎপর্য আসলে কী?’

বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রি প্রধান উপদেষ্টার এই মন্তব্যকে ‘অবাক করা’ বলে অভিহিত করেছেন এবং তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, উত্তর–পূর্বাঞ্চল ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভারতীয় সংবাদ সংস্থা এএনআইকে বীণা সিক্রি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের মন্তব্য অত্যন্ত হতাশাজনক। এই ধরনের মন্তব্য করার কোনো অধিকার তাঁর নেই।’

বীণা সিক্রি আরও বলেন, ‘তিনি (ড. ইউনূস) জানেন যে, উত্তর–পূর্ব ভারত অবিচ্ছেদ্যভাবে ভারতের অংশ এবং উত্তর–পূর্ব ভারতের বঙ্গোপসাগরে প্রবেশের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আমাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে আলোচনা হয়েছে এবং এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক চুক্তিও রয়েছে।’

ভারতের এই কূটনীতিক ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে সেভেন সিস্টার্সে বাংলাদেশের ট্রানজিট দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি বাংলাদেশকে একটি বিষয় খুব স্পষ্টভাবে বলতে পারি—যদি তারা উত্তর–পূর্ব ভারতকে (মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে) সংযোগের অধিকার দিতে আগ্রহী না হয়, তবে তারা “জলপথের অধিকার” হিসেবে কোনো অধিকার আশা করতে পারে না। তাই তাদের এটি খুব স্পষ্টভাবে জানা উচিত এবং এ বিষয়ে তাদের কোনো ভুল ধারণা রাখা উচিত নয়। আমাদের এই বিবৃতির নিন্দা জানানো উচিত।’

ভারতের প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ প্রফুল্ল বকশি এএনআই–এর কাছে ড. ইউনূসের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দাবি করেন, ভারত বাংলাদেশ তৈরি করেছে এবং তা করার সময় কোনো মানচিত্রগত সুবিধা নেয়নি। বকশি উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে, বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তান উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংযোগকারী রুট শিলিগুড়ি করিডরকে কাজে লাগিয়ে ভারতের শ্বাসরোধ করার উপায় নিয়ে আলোচনা করছে।

বকশি বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ তৈরি করেছি। বাংলাদেশ তৈরির সময় আমরা কোনো মানচিত্রগত সুবিধা নিইনি। বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তান সম্প্রতি চিকেনস নেক (শিলিগুড়ি করিডর) এবং ভারতের গলা চেপে ধরে সুবিধা নেওয়ার বিষয়ে কথা বলছে। এখন বাংলাদেশ বলছে, চীনের সাহায্য করা উচিত এবং শিলিগুড়ি করিডরের ওপর নির্ভরশীল সাতটি ল্যান্ডলকড রাজ্যে প্রবেশ করা উচিত।’

তিনি বাংলাদেশকে হুমকি দিয়ে আরও বলেন, ‘তারা (বাংলাদেশ) বুঝতে পারছে না যে, আমরা বাংলাদেশের বিপরীত দিকে একই কাজ করতে পারি। আমরা সমুদ্রের ওপার থেকে তাদের টুঁটি চেপে ধরতে পারি।’ তিনি আশ্বাস দেন, ভারত সরকার পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত এবং ব্যবস্থা নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘ভারত সরকার এ নিয়ে মিডিয়ার কাছে ছুটে গিয়ে হইচই করবে না। সরকার ইতিমধ্যেই ব্যবস্থা নিয়েছে। এমনকি ইউনূসও জানেন ভারত কী করতে চলেছে।’

ভারতের সেভেন সিস্টার্সের একটি আসাম রাজ্য। এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমান্ত বিশ্বশর্মা বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের মো. ইউনূসের ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যকে স্থলবেষ্টিত উল্লেখ করে এবং বাংলাদেশকে সমুদ্রের অভিভাবক হিসেবে স্থাপন করার বিবৃতিটি আপত্তিকর এবং তীব্রভাবে নিন্দনীয়।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ড. ইউনূসের ওই বক্তব্যের ভিডিওতে তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘আমরা এই পুরো অঞ্চলের জন্য সমুদ্রের একমাত্র অভিভাবক। সুতরাং, এটি এক বিশাল সম্ভাবনার উন্মোচন করে। সুতরাং, এটি চীনা অর্থনীতির একটি সম্প্রসারণও হতে পারে। পণ্য তৈরি করা, উৎপাদন করা, বিপণন করা এবং তা আবার চীনে নিয়ে যাওয়া এবং বাকি বিশ্বেও তা ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ হতে পারে এখানে।’

ড. ইউনূসের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় আসামের মুখ্যমন্ত্রী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লেখেন, ‘এই মন্তব্যটি ভারতের কৌশলগত চিকেনস নেক করিডরের সঙ্গে জড়িত দীর্ঘস্থায়ী দুর্বলতার ন্যারেটিভটিকেই তুলে ধরে।’

পোস্টে বিশ্বশর্মা মূল ভূখণ্ড থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতে যাওয়ার জন্য বিকল্প সড়কপথ তৈরিরও আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘চিকেনস নেক করিডরের নিচে এবং চারপাশে আরও শক্তিশালী রেল ও সড়ক নেটওয়ার্ক তৈরি করা অপরিহার্য। এ ছাড়া, উত্তর-পূর্বকে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযোগকারী, চিকেনস নেককে কার্যকরভাবে এড়িয়ে যাওয়া বিকল্প সড়কপথ অনুসন্ধানে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। যদিও এটি উল্লেখযোগ্য প্রকৌশলগত চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে, তবুও দৃঢ় সংকল্প ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে তা অর্জন করা সম্ভব।’

ড. ইউনূসের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসও। গতকাল সোমবার কংগ্রেস ইউনূসের বক্তব্যকে উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য ‘খুব বিপজ্জনক’ বলে অভিহিত করেছে এবং অভিযোগ করেছে যে, কেন্দ্র সরকার মণিপুরসহ এই অঞ্চলের ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে না।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে শেয়ার করা পোস্টে কংগ্রেসের গণমাধ্যম ও প্রচার বিভাগের প্রধান পবন খেরা বলেন, ‘বাংলাদেশ ভারতকে ঘিরে ফেলতে চীনকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের এই মনোভাব আমাদের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য খুবই বিপজ্জনক। সরকার মণিপুরের যত্ন নিচ্ছে না এবং চীন ইতিমধ্যেই অরুণাচলে গ্রাম স্থাপন করেছে।’

বিআরইউ