আমাদেরও আছে অপরূপ রাঙামাটি

এম এ নোমান প্রকাশিত: আগস্ট ২২, ২০২২, ০৫:৩০ পিএম

বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর—কবি জীবনানন্দ দাশের এ কবিতা বাংলাদেশের রূপ-বৈচিত্র্য আর নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতি বিশ্বের ভ্রমণপ্রিয় মানুষদের প্রবলভাবে আকর্ষণ করেছে নিঃসন্দেহে। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের আমাদের এ প্রিয় বাংলাদেশের প্রাকৃতিক রত্নভাণ্ডার রাঙামাটি জেলা। ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সম্প্রীতি ও বৈচিত্র্যময় সমাজ-সংস্কৃতির বিবেচনায় স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল পাহাড়ের রানিখ্যাত এ জেলার প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ হয়ে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি, সাহিত্যিক ও গীতিকাররা রচনা করেছেন মনোমুগ্ধকর সুন্দর সুন্দর কবিতা ও গান-গল্প।

দিগন্তছোঁয়া সুনীল আকাশ, সবুজে ঘেরা উঁচুনিচু পাহাড় ও এঁকেবেঁকে চলা নীল জলরাশির লেক। উঁচু পাহাড়ের গা ঘেঁষে ঝর্ণা থেকে ঝরঝর করে অবিরাম ঝরছে স্পুটিকের ন্যায় হিমশীতল স্বচ্ছ বারিধারা। এ যেন এক অপরূপ রূপের মাধুরি সাজিয়ে হাতছানি দিয়ে পাহাড়ের রানি ডাকছে, আয় আমার রূপের রাজ্যে । প্রকৃতির রূপের ভাণ্ডার এ জেলায় ভ্রমণের প্রবল আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে সেই ছাত্রজীবনেই। কাজেই রাঙামাটি ভ্রমণের আমন্ত্রণ পাওয়া মাত্রই প্রবল আকাঙ্ক্ষা থেকেই কালবিলম্ব না করে রাজি হয়ে গেলাম।

এবার রাঙামাটি ট্যুরের আয়োজন করেছে ল’রিপোর্টার্স ফোরাম। আইন,আদালত ও বিচার প্রশাসন নিয়ে গণমাধ্যমে কর্মরত রিপোর্টারদের সংগঠন ল’রিপোর্টাস ফোরাম। পেশাগত প্রয়োজনের তাগিদ থেকে ২০০১ সালে এ সংগঠনের জন্ম। সদস্যদের পেশাগত দক্ষতা ও মানোন্নয়নে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মশালা ছাড়াও বিষয়ভিত্তিক সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম আয়োজনের মাধ্যমে বিদ্যমান আইনের সংস্কার ও যুগোপযোগী আইন প্রণয়নে এ ফোরাম কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করে আসছে। ফলে সংগঠনটি দেশে সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোর মধ্যে একটি প্রেস্টিজিয়াস সংগঠন রূপে পরিচিতি লাভ করেছে। প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে ওঠা আকর্ষণীয় পর্যটন এলাকাগুলোতে একটি পারিবারিক ট্যুরের আয়োজন করাও সংগঠনের রীতিতে পরিণত হয়েছে। ফলে ল’রিপোর্টার্স ফোরামের ট্যুর আমাদের পরিবারের সদস্যদের মাঝেও অন্য রকম আকাঙ্ক্ষার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।


বৈশ্বিক মহামারি করোনা-পরিস্থিতির কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর গত ১৯ আগস্ট দেশের পর্যটনকেন্দ্রগুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার শর্তে খুলে দেয় সরকার। সব রীতিনীতি মেনে ল’রিপোর্টার্স ফোরাম ২ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাঙামাটিতে পারিবারিক ট্যুরের আয়োজন করে। ৪৮ জন সদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্যরা মিলে মোট ১১৫ জনের চার দিনের আয়োজন সত্যিকার অর্থেই ফোরামের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জিং ছিল।

২ সেপ্টেম্বর রাত ১১টায় আমরা ঢাকার আরামবাগ ঐতিহ্যবাহী নটরডেম কলেজের সামনে থেকে তিনটি বিলাসবহুল বাসে চড়ে আমাদের হৃদয়ের রানি রাঙামাটির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। রাত দেড়টার দিকে আমাদের বহনকারী বাসগুলো কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট পার হয়ে জমজম হাইওয়ে রেস্টুরেন্টে গিয়ে যাত্রাবিরতি করে। রেস্টুরেন্টের মালিক মিজানুর রহমান নিজেই ফুল নিয়ে আমাদের অতিথি হিসেবে গ্রহণ করলেন। মধ্যরাতে তাঁর আন্তরিক আতিথেয়তা আমাদের মুগ্ধ করে। রেস্টুরেন্টটির ভেতরে শিশুদের খেলাধুলা ও বিনোদনের জন্যও চমৎকার আয়োজন রয়েছে।

ঘড়ির কাঁটায় রাত তখন আড়াইটা। খাওয়া-দাওয়া সেরে মিজান ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হওয়ার সময় উঠে দেখি কারও স্ত্রী-সন্তানই সঙ্গে নেই। সবার স্ত্রীই ওই বিনোদনকেন্দ্রে বাচ্চাদের সামলাতে ব্যস্ত। বাচ্চাদের কেউ দৌড়াদৌড়ি করছে, কেউ চরকিতে ঘুরছে, কেউ দোল খাচ্ছে। সহকর্মী জাকের তাঁর ছোট ছেলেকে দোলনা থেকে নামাতে গেলে সে কোনও ভাবেই নামতে রাজি হচ্ছে না। চিৎকার জুড়ে দিয়ে বলছে, ‘আমি এত তাড়াতাড়ি ঢাকায় যাব না। আমি এখানে আরও থাকব, আরও বেড়াব।’ তার মতো অন্যদের বাচ্চাদেরও একই অবস্থা। তাদের সবারই ধারণা, এটাই ছিল হয়তো আমাদের পিকনিক স্পট। ওদের বের করে এনে কুমিল্লার জমজম হাইওয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বাস ছাড়তে ছাড়তে রাত তখন ৩টা। বাসের সিটে গা এলিয়ে দিতেই গভীর ঘুম।

চট্টগ্রামের সীমানা পেরিয়ে আমাদের বহনকারী বাসগুলো রাঙামাটির উঁচুনিচু পাহাড়ি সড়কে ওঠার পর ঘুম ভেঙে যায়। বাসে জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখি পাহাড়ের সবুজ গাছের ফাঁক গলিয়ে সোনালি রোদেলা আভা ছড়িয়ে সূর্যটা উঁকিঝুঁকি মারছে। পাহাড়ের ঘন লতাপাতার মাঝে ভোরের সূর্যটাকে মনে হচ্ছে যেন প্রিয়া চোখ টিপে মিষ্টিমাখা হাসি দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে আবার ফিরে আসছে। দুষ্টু সূর্য তার মিষ্টি আলো বনপাহাড়ের নাঙা গায়ে ঢেলে দিয়ে পাহাড়ের রূপমাধুরীকে আরও অপরূপ করে তুলছে। এ যেন এক মায়াবী রূপ।


বাস এগিয়ে চলছে। সবাইকে রোমাঞ্চিত করে পেছনে থেকে যাচ্ছে সারিসারি উঁচুনিচু পাহাড় ও লেকের ধারা। ঘণ্টা দুয়েক পরে আমাদের বহনকারী বাস তিনটি রাঙামাটি শহরের হোটেল সোফিয়া ইন্টারন্যাশনালের সামনে গিয়ে থামে। আগে থেকেই কক্ষ বরাদ্দ ছিল। একশ দশ জনের ভালোভাবে থাকার জন্য রাঙামাটিতে এর চেয়ে ভালো মানের আর কোনও হোটেল বা মোটেল নেই। আমাদের পাঁচ সদস্যের পরিবারের জন্য সুবিশাল দুটি কক্ষ বরাদ্দ রাখা হয়েছে।  কক্ষে প্রবেশের পর বুঝতে পারলাম, বৈশ্বিক মহামারি করোনার আঘাত এ হোটেলটির ওপর দিয়েও বইয়ে গেছে। করোনার প্রভাব দেশের সবগুলো খাতকেই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এর মধ্যে পর্যটন খাত একটু বেশিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে রাঙামাটিসহ দেশের সব পর্যটন এলাকার হোটেল মোটেলই অনেক দিন ধরে বন্ধ ছিল। নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর আমাদের ট্যুর উপলক্ষে হোটেল কর্তৃপক্ষ কয়েক দিন আগে স্টাফদের এনে হোটেলটি ধুয়েমুছে পরিষ্কার করেছে।

সবাই নিজ নিজ কক্ষে গিয়ে ফ্রেশ হওয়ার পরপরই ল’রিপোর্টার্স ফোরামের কার্যকরী কমিটির সদস্যরা সকালের নাশতার প্যাকেট ও পানি নিয়ে দরজায় কড়া নাড়ছেন। নাশতা সেরে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই গভীর ঘুম। ঘুম থেকে জেগে দেখি জুমার নামাজের সময় যায়যায় অবস্থা। পাশের জামে মসজিদে গিয়ে জুমার নামাজ আদায় শেষে হোটেলে ফিরে সবাই একসঙ্গে দুপুরের খাবারের টেবিলে বসে পড়লাম। রাঙামাটির লেকের মাছের স্বাদের কথা রূপকথার গল্পের মতো। যিনি এ লেকের মাছের স্বাদ নেননি, তিনি মাছের প্রকৃত স্বাদ থেকে বঞ্চিতই থেকে যাবেন। খাবারের সাথে বিভিন্ন ধরনের মাছ পরিবেশন করছেন আর একনাগাড়ে এগুলোর স্বাদ ও গুণাগুণ বর্ণনা করে চলেছেন হোটেলের ওয়েটাররা। তৃপ্তি সহকারে দুপুরের খাবার খেয়ে হোটেল কক্ষে এসে আবারও কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে আমরা সবাই চলে গেলাম পলওয়েল পার্কে।

পলওয়েল পার্ক নতুন রূপে গড়ে ওঠা রাঙামাটির অন্যতম একটি দর্শনীয় স্থান। কাপ্তাই হ্রদের পাড়ে নির্মিত এ পার্কটি রাঙামাটি জেলা পুলিশ পরিচালনা করে থাকে। অপরূপ প্রকৃতি আর আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর অপূর্ব সমন্বয়ে পার্কটিকে বিশেষভাবে পর্যটকদের আকর্ষণ করছে। ‘লাভ পয়েন্ট’ হচ্ছে পার্কটির অন্যতম আকর্ষণ। এ লাভ পয়েন্টের ভেতরে রয়েছে লাভ লক বা ভালবাসার তালাখ্যাত ‘লাভ’ চিহ্নের একটি বিশেষ চরকি। ভালোবাসার বন্ধনকে চিরস্থায়ী করতে অনেকেই সঙ্গে করে একটি তালা নিয়ে আসেন এখানে। লোহা ও রড দিয়ে তৈরি বিশাল চরকির ভেতরে কয়েকজন যুবক-যুবতী পরস্পরকে জড়িয়ে একসঙ্গে একটি তালা ঝুলিয়ে চাবিটি হ্রদে ফেলে দিয়ে তাদের মধ্যকার ভালোবাসাকে স্থায়ী রূপ দিতে দেখলাম। ‌এখানে বাহারি রঙের ও নানান ডিজাইনের এমন শতশত তালা ঝুলতে দেখে আমাদের মনেও একটি তালা ঝুলিয়ে চাবিটি হ্রদের পানিতে টুপ করে ফেলে দেওয়ার স্বাদ জেগে ওঠে। তবে তালা সঙ্গে না থাকায় এ ইচ্ছেটি শেষ পর্যন্ত অপূর্ণ রেখেই সন্ধ্যার দিকে সঙ্গিনীর হাতটি শক্ত করে চেপে ধরে লাভ পয়েন্ট ত্যাগ করি।

আমাদের এ আনন্দ আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানমালায় ছিল শুভলং ঝর্ণা ও শুভলং বাজার পরিদর্শন। সকাল ৮টার মধ্যেই আমরা সবাই ফিশারি ঘাটে বাধা কেয়ারি ট্যুরিস্ট লঞ্চে গিয়ে চড়ে বসলাম। বেশ সুন্দর ও আকর্ষণীয় লঞ্চটিতে আমাদের সবার জন্য সকালের নাশতার আয়োজন রাখা ছিল। লঞ্চটি এগিয়ে চলেছে এঁকেবেঁকে চলা লেকের ভেতর দিয়ে। নাশতাপর্ব শেষে শুরু হলো মনোমুগ্ধকর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আমাদের সন্তানদের মধ্যে ‘বেস্ট পারফর্ম’ করার প্রতিযোগিতা দেখে বেশ ভালো লাগল। লেকের দুধারে সবুজে আচ্ছাদিত পাহাড়। মাঝেমধ্যে লেকের জলরাশির ভেতরে ছোট ছোট দ্বীপ। মাঝেমাঝে পাহাড়ের গা বেয়ে ঝর্ণাধারা নেমে এসে মিলিয়ে গেছে লেকের পানিতে। লেক, পাহাড়, ঝর্ণার মিশেলে রানির মুকুট পরে বিশ্বকে অপরূপ সৌন্দর্যের জানান দিচ্ছে রূপময়ী প্রকৃতিকন্যা রাঙামাটি। চারপাশে উঁচু উঁচু পাহাড়ের সাথে লেকের স্বচ্ছ পানির বহমান স্নিগ্ধতা মনকে রাঙিয়ে তুলছে। ছোট্ট লঞ্চটির দুলুনিতে মনও দোল খেয়ে উঠেছে। লেক, পাহাড় ও ঝর্ণার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে নান্দনিক সৌন্দর্য।


প্রায় দুই ঘণ্টা চলার পর আমাদের বহনকারী লঞ্চটি গিয়ে শুভলং বাজারে গিয়ে নোঙর করে। অতি দুর্গম পাহাড়ি বাজার। নানান ধরনের পসরা নিয়ে বসে আছেন দোকানিরা। দোকানিদের মাঝে যেমন আছে বাঙালি, তেমনই রয়েছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা। একসঙ্গে বাজারে শতাধিক মানুষ থেকে বেশ খুশিই হন দোকানিরা। বাজারে নিত্যপণ্যের পাশাপাশি স্থানীয় ফলফলাদিই বেশি। বাজার থেকে কিছু কেনাকাটাও করেন আমাদের কেউ কেউ। বাজার থেকে আবার লঞ্চে উঠে আমরা চলে যাই শুভলং ঝর্ণার কাছে।

এ শরতেও যেন ঝর্ণাটি পূর্ণ যৌবন নিয়ে আমাদের অপেক্ষায় ছিল। ঝর্ণা থেকে অবিরাম পানি পড়ছে। সবাই একযোগে ঝর্ণার কাছে নিজেদের সঁপে দিয়ে সে কী উচ্ছ্বাস! অনেক উঁচু পাহাড়ের চূড়া থেকে রুপালি ঝিলিক দিয়ে মুগ্ধতা ছড়িয়ে পানি পড়ছে। নিচে শতশত পর্যটক একসঙ্গে ব্যান্ডের তালেতালে নেচেগেয়ে চলছে। দৃশ্যটি ছিল বেশ উপভোগ করার মতো। ঝর্ণার হিমশীতল পানিতে শরীর ঠাণ্ডা করে আবার লঞ্চ ধরে রাঙামাটি শহরের উদ্দেশে রওনা দিতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল।

সেদিন সন্ধ্যায় আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি ছিল মনে রাখার মতো। রাঙামাটি শহরে আয়োজন করা হয় স্থানীয় শিল্পীদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। সন্ধ্যা ৭টা থেকে একটানা রাত ১১টা পর্যন্ত চলে এ অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে গানের ফাঁকে চলে খাওয়া-দাওয়া আর পুরস্কার বিতরণ ও আকর্ষণীয় র‍্যাফেল ড্র। ল’রিপোর্টার্স ফোরাম সদস্য এবং তাঁদের স্বামী বা স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য পুরস্কারের আয়োজন করে।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর খ্যাতনামা শিল্পীরা নিজস্ব ভাষায় গান পরিবেশন করেন, পাশাপাশি গানের বর্ণনা ও ভাবানুবাদও তুলে ধরেন তাঁরা। গানে গানে তাঁরা নিজস্ব ঐতিহ্য, পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ভাতৃত্বের মেলবন্ধনের কথাও তুলে ধরেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে ১১টি ভিন্ন সম্প্রদায়ের সম্প্রীতিপূর্ণ সহাবস্থান রয়েছে রাঙামাটিতে। সম্প্রদায়গুলোর পৃথক পৃথক পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, ভাষা ও সংস্কৃতি দ্বারা এ জেলাটি বিশেষভাবে সমাদৃত হয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টাও রয়েছে তাঁদের মাঝে।

আরেকটি আকর্ষণীয় দর্শনীয় জায়গার নাম বৌদ্ধ তীর্থস্থান রাজবন বিহার। শহরের রাজবাড়ি এলাকায় এ তীর্থস্থান অবস্থিত। শত শত পর্যটক রাজবন বিহার দর্শন করতে আসেন। আমাদের ট্যুরের তৃতীয় দিন সকালে নাশতাপর্ব শেষ করেই আমরা চলে যাই বৌদ্ধ তীর্থস্থান দেখতে। করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার পর থেকে এখানে দর্শনার্থীদের প্রবেশ সীমিত করা হয়েছে। গেটের কাছে গিয়ে পৌঁছাতেই একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু এগিয়ে এলেন। তিনি কিছু এলাকা ঘুরে দেখালেন। বিহারের আশপাশে শতশত বানরের বসবাস। এখানে বানরের বাঁদরামিও দেখার মতো। সবগুলো বানরই মনে হয় প্রশিক্ষিত। নানান ঢঙে লাফিয়ে কোনও কোনওটি আবার হেলেদুলে নবাবি কায়দায় চলছে। কোনওটি আবার গাছে উঠে ডালে বসে ডাল নাড়িয়ে নিজের বৈশিষ্ট্যের জানান দিচ্ছে। পকেট থেকে মোবাইল বের করে ছবি তুলতেই বৌদ্ধ ভিক্ষু সতর্ক করে দিয়ে বললেন, একটু সাবধানে ধরবেন মোবাইলটি। সুযোগ পেলে হেঁচকা টান মেরে নিয়ে একলাফে গাছে উঠে যাবে। অনেক অনুনয়-বিনয় করেও আর ফেরত পাবেন না। তবে বানরের মর্জি হলে কিংবা কোনও খাবার দিলে ফেরত দিতেও পারে।


রাঙামাটি ভ্রমণে আসলেন, অথচ ঝুলন্ত সেতুতে ওঠেননি। তাহলে ধরে নিতে হবে আপনার রাঙামাটি ভ্রমণ পূর্ণতা পায়নি। তাই পর্যটকদের কাছে এ সেতুটি আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। ফলে এটিকে বলা হয় ‘সিম্বল অব রাঙামাটি’। ‌আমাদের ট্যুরের প্রোগ্রামসূচির একেবারে শেষ পর্যায়ে ছিল ঝুলন্ত সেতুতে যাওয়া। কাপ্তাই লেকের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন দুটি পাহাড়ের মাঝে বন্ধন তৈরি করেছে এ সেতু। প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক আসেন এ সেতুতে দাঁড়িয়ে পাহাড় ও লেকের সৌন্দর্য অবগাহন করতে।

পর্যটন শিল্প বর্তমানে সমগ্র বিশ্বের অন্যতম শিল্প হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। অনেক দেশের প্রধান আয়ের উৎস পর্যটন শিল্প। এ শিল্পকে কেন্দ্র করেই তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে আসছে। সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা আমাদের এ প্রিয় বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। পর্যটন শিল্পের দুয়ার উন্মোচন করে বিশ্বের পর্যটনপ্রেমীদের আকর্ষণ করছে আমাদের যে কয়েকটি দর্শনীয় স্থান, তার মধ্যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি রাঙামাটি অন্যতম।

অনেক দেশে জগৎজুড়ে খ্যাতি অর্জন করা অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। আমাদেরও রয়েছে রাঙামাটি। এখানে তিন দিন কাটিয়ে আমরা যখন কর্মস্থল ঢাকায় ফেরার জন্য বাসে উঠছিলাম, সবার চোখেমুখেই তখন অতৃপ্তির ছায়া। অপরিমেয় সৌন্দর্যবিস্তৃত এ রাঙামাটির রং ছড়িয়ে পড়ুক সারা বিশ্বে, এমন প্রত্যাশার কথাই শোনা গেল সবার মুখে।