ছোটো গল্প: ফেরা

রাজু আহমেদ প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৮, ২০২৪, ০৯:২২ পিএম

সপু মিয়ার বাড়িতে আজ নীল জোনাকির মেলা বসেছে। একটা নয়, দুইটা, হাজারটা নীল জোনাকি। সারা ঘরময় বাড়িময় সেই নীল জোনাকিগুলো পাখা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে। শুধু রাতে নয় দিনেও এই জোনাকিগুলো সারা ঘরময়, বাড়িময় উড়ে বেড়ায়। দিনে আবার এসব জোনাকিগুলো অদ্ভুত এক রং ধারণ করে, সপু মিয়া নিজেও সেই রঙের সাথে মিশে যায় প্রতিদিন। সপু মিয়া খেয়াল করে তখন তার নিজের রংও বদলে যায়। অদ্ভুত সে রং। সপু মিয়ার ইচ্ছে হয় সেই রঙের নাম জানার, কিন্তু কিছুতেই রঙের নাম জানতে পারে না সে। সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা রং।

আস্তে আস্তে অচেনা এই রঙটিই সপু মিয়ার খুব চেনা হয়। ধীরে ধীরে অচেনা রঙের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে তার। একসময় আবিষ্কার করে সপু মিয়া, অদ্ভুত সেই রংগুলো থেকে বিশাল এক সমুদ্র তৈরি হয়। সমুদ্রের সেই অদ্ভুত ঢেউয়ের মধ্যে হাজারটা নীল জোনাকি ভেসে বেড়ায়। জোনাকিদের মধ্যে সেও ভাসতে থাকে ক্রমেই। ভাসতে ভাসতে গভীর সেই সমুদ্রে তলিয়ে যেতে থাকে সে, ভেসে থাকার অনেক চেষ্টা করে কিন্তু কিছুতেই পারে না। ক্রমেই সমুদ্রে তলিয়ে যেতে থাকে। হঠাৎ একটা হাত শক্ত করে তার হাতটাকে আঁকড়ে ধরে। তারপর সাতরিয়ে তীরে নিয়ে আসে তাকে। বেশ কিছুক্ষণ পরে চোখ খোলে সপু মিয়া। কারও যেন কান্নার আওয়াজ পায়। ধীরে ধীরে চোখ মেলে, তারপর দেখে অনেকগুলো চোখ তার দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ খেয়াল করে সপু মিয়া, তার আব্বার কোলে শুয়ে আছে সে। তার আব্বা তাকে পাগলের মত চুমু খেতে থাকে। এরপর তার আব্বার কাছ থেকে এক প্রকার জোর করেই তাকে ছিনিয়ে নেয় তার মা। তারপর পাগলের মত তার কপালে, গালে, মাথায় চুমু খেতে থাকে আর কান্নাকাটি করতে থাকে। এভাবে কেটে যায় বেশ কিছ্ক্ষুণ। সপু মিয়া বুঝে উঠতে পারে না কিছুই । তারপর আবারও চোখ বোজে সে।

সপু মিয়া চোখ খোলে। পিট পিট করে তাকিয়ে থাকে। সারা ঘর জুড়ে অন্ধকার। বুঝতে পারে না সে কোথায় আছে। অন্ধকারে হাতড়ে দেখে চারপাশ। বুঝতে চেষ্টা করে পরিবেশটাকে। এদিক ওদিক হাতড়ে চলে সপু মিয়া। কিন্তু বুঝতে পারে না কিছুই। হঠাৎই কারও যেন ডাক শুনতে পায় সে। ‘সপু, সপুরে ও সপু, সপু ও সপু।’ ক্রমেই ডাকটা কাছে আসতে থাকে। সপু মিয়া বুঝতে পারে দখিনের জানালার পেছন থেকেই ডাকছে হয়তো কেউ। জানালার ওপাশে বাগান। ডাকটা বাড়তেই থাকে। ‘ও সপু, সপুরে, সপু বাইরে আসো বাজান।’ সপু জবাব দেয়, ‘আমি তো দরজা খুঁজে পাচ্ছি না।’ বাহিরে থেকে জবাব আসে, ‘অন্ধকারে কি দরজা খুঁজে পাওয়া যায় বাজান? সামনে নাক বরাবর দরজা বাবা।’ সপু মিয়া দরজা খুঁজে পায় তারপর বের হয়।

বাড়ির দখিন পাশে আম সুপারির বাগানে দাঁড়িয়ে সপু মিয়া। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিজের হাতও দেখতে পায় না সে। সেই ডাকটাও আর শুনতে পায়না সপু মিয়া। সে চিৎকার করে ডাকে ‘কোথায় আপনি? আমি তো এসেছি।’ বাগান ভেদ করে অন্ধকারের বুক চিরে শূন্যে মিলিয়ে যায় সেই ডাক। জবাব আসেনা। তবুও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সপু মিয়া। এরপর ফিরে আসার জন্য অন্ধকার হাতড়ে বাড়ি ফেরার পথ ধরে।

‘সপু ও সপু’ থমকে দাঁড়িয়ে যায় সপু মিয়া। ডাকটা যেন কতদিনের চেনা। আগে খেয়াল করতে পারেনি সে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে। খুবই পরিচিত একটা ডাক। কত কতদিন শুনেছে সে এই মধু মাখা ডাক। এরপর হঠাৎ করেই এই ডাকটা বন্ধ হয়ে যায়। কেউ আর ডাকে না তাকে এই নামে। পাড়াপড়শি, ভাই বোন কেউ না, কেউ না। এই নামে তো শুধু এইজনই ডাকতো । এই ডাকটা শোনার জন্যই কি সে অপেক্ষায় ছিল? পিছনে ঘোরে সে। বুঝতে পারে তার সামনে যেন কেউ দাঁড়িয়ে আছে। বিদঘুটে অন্ধকারেও কারও অস্তিত্ব টের পায় সে। এই অস্তিত্বের সাথেই মিশে আছে তার অস্তিত্ব। এর সাথে তার জনম জনমের সম্পর্ক। সপু মিয়া বলে ওঠে, ‘মা তুমি কোথায়? আমি তো তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না মা। আমি কতদিন তোমাকে দেখিনি মা।’
‘অন্ধকারে কি মানুষ দেহা যায় বাজান? তুই তো আলো আনস নাই বাজান। আমারে দেখবি ক্যামনে?’
‘মা আমি তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরতে চাই মা।’কথাটি বলেই অন্ধকারে একটু জোরেই এগিয়ে যায় সে। তারপর একটা গাছের সাথে জোরে একটা ধাক্কা খায়। অন্ধকারে গাছের অস্তিত্ব টের পায় না সে। কপালে হাত দেয় সপু মিয়া। বুঝতে পারে কপাল ফাটেনি। আবারও ডাকে সে, ‘মা, ও মা, মাগো কই তুমি?’

হঠাৎ অন্ধকারে আলোর ঝলকানিতে চোখ ধাঁদিয়ে ওঠে সপু মিয়ার। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সে। কাঁধে হাত রাখে তার স্ত্রী রাহেলা বেগম। ‘কি হলো স্বপ্ন দেখছিলে বুঝি?’ সপু মিয়া চুপচাপ থাকে। তাকিয়েই থাকে রাহেলা বেগমের দিকে। কিছুক্ষণ পর কথা বলে ওঠে সপু মিয়া। ‘আমাকে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দাও।’ রাহেলা ফ্রিজ খুলে স্বামীকে পানি দেয়। আর বলে, ‘বাড়ি থেকে তো খবর পাঠিয়েছে মায়ের নাকি শরীর খুব একটা ভাল না চলো দেখে আসি।’ 
‘আচ্ছা দেখি বলে পানি খেতে থাকে সপু মিয়া। আর কানের মধ্যে একটা ডাক যেন বাজতেই থাকে। সপু ও সপু, সপুরে... 

সপু মিয়ার চোখে ঘুম জড়িয়ে আসে। অনেক পিছনের কিছু দৃশ্য দেখতে পায় সে। বাড়ির পূব পাশে পুকুর। দক্ষিণে বিশাল বাগান। বাড়িতে বড় একটা উঠোন। ঘরের খোলা বারান্দা। সেই বারান্দায় একটা দোলনা টাঙানো। সেখানে দোল খাচ্ছে সপু মিয়া। পেছন থেকে দোলনায় দোল দিচ্ছে তার মা।

দোল দোল দুলুনি রাঙা মাথা চিরুনি। বউ আসবে এখুনি। সপু দোলনার দড়ি ধরে বসে থাকে। আর খিলখিল করে হাসে। 

‘সপু বাজান আমার তুমি ডাক্তার হবা বাজান। আমি তুমারে ডাক্তার বানামু বাজান। সবাই আমারে কইবো, ঐ দ্যাখ সপু ডাক্তারের মা যায়।’ তারপর সপু মিয়া দেখে সে উঠোন জুড়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। আর খাবারের থালা নিয়ে ওর মা ওর পিছু পিছু দৌড়াচ্ছে।

সপুর ঝিমুনি ভাবটা আবারও কেটে যায়। বিষণ্ন জল টলটলে চোখে অন্ধকারে শূন্য ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। 

বাবার কষ্টের টাকা, সম্পত্তি বেশির ভাগই শেষ হয় সপু মিয়াকে ডাক্তার বানাতে গিয়ে। ডাক্তার হয়েই কিনা সেই সপু নিজে নিজেই বিয়ে করে ফেলে। বিয়ের খবর শুনে খুবই কষ্ট পায় তার বাবা। এরপর কয়েকমাস পর স্ট্রোক করে না ফেরার দেশে চলে যান তিনি।

এরপর ধীরে ধীরে বাড়ির কথা ভুলে যায় সে। ডাক্তারি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ভীষণ রকম। মাসে একবার দু’বার ফোন করে খোঁজ নেয় মায়ের। মা বলেন, ‘আমি ভাল আচি বাজান। তুই ভালা আছস তো বাজান। কতদিন বাড়িতে আসস না। খুব ব্যস্ত তাই না বাজান। তবু একবার সময় করে বাড়িতে এসে ঘুরে যাস বাজান।’ ব্যস্ততার কারণে বাড়িতে না আসতে পারার জন্য মায়ের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে সে।

এভাবে সময় গুলো একটু একটু করে এগিয়ে যেতেই থাকে, যেতেই থাকে। এরপর একদিন মাকে দেখার জন্য সময় হয় সপু মিয়ার। বাড়ি থেকে আবারও খবর আসে তার মায়ের অবস্থা খুবই খারাপ, দেরি না করে খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে যেন চলে আসে।

মাকে দেখতে রওয়ানা হয় সে। দীর্ঘ আট ঘণ্টার জার্নি শেষে বাড়িতে পৌঁছায় সে। বাড়িতে অনেক মানুষ। সপু মিয়া বুঝতে পারে না ওদের বাড়ি ভর্তি এত মানুষ কেন?  দু’একজন মুরুব্বি গোছের লোক বলে ওঠেন, ‘আইছো বাপ আরও কয়েকটা দিন আগে যদি আইতা।’সপু মিয়ার বুকটা ধক করে ওঠে। ধীরে ধীরে ঘরের দিকে এগিয়ে যায় সে।

সপু মিয়ার মায়ের খাটে সাদা কাপড়ে কাকে যেন ঢেকে রাখা হয়েছে। কেউ একজন মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে দেয়। সপু মিয়া স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকে নিথর প্রাণহীন তার মায়ের মুখের দিকে। শুকনো মুখে যেন আবছা হাসি আর আধখোলা চোখে যেন চেয়ে আছে কারও অপেক্ষায়,   ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠে সপু মিয়া। পড়শিরা সান্ত্বনা দিতে থাকে।

শেষ বারের মত মায়ের কবরে মাটি দেয় সপু মিয়া। একে একে সবাই চলে যায়। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে কবরের সামনে। এরপর সেও এক সময় হাঁটতে থাকে বাড়ির পথে। হঠাৎই পেছন থেকে কেউ যেন ডেকে ওঠে ‘সপু ও সপু।’ পেছন ঘুরেই দেখে ওর মা কবরের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।
‘তুই আইছোস বাজান? তোর মুখটা এত শুকনা ক্যান বাজান? কিছু খাস নাই ? তুই এমন শুকিয়ে গেছিস ক্যানরে বাজান?’

এরপর কেউ একজন ওর হাত ধরে টান দেয়, ‘এসো বাবা কবরের পাশে দাঁড়িয়ে এভাবে কাঁদতে নেই মুর্দা কষ্ট পায়। মায়ের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে দোয়া কইরো।’

হাত ধরে তাকে বাড়ির দিকে নিয়ে যেতে থাকে লোকটা, যেতে যেতে আবারও পেছন ফিরে তাকায় সপু মিয়া। সে দেখে করুণ চোখে তার দিকে চেয়ে আছে তার মা।

আরএস