সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)

বছরে ৬ হাজার কোটি টাকার সম্পদ কর হারাচ্ছে সরকার

মো. মাসুম বিল্লাহ প্রকাশিত: মে ২৪, ২০২৩, ১০:১১ পিএম

অর্থনীতির তুলনায় দেশে কর আদায় খুবই সামান্য। দেশ ইতোমধ্যে সিঙ্গাপুর, কানাডাকে ছাড়িয়ে গেছে দাবি করা হলেও সম্পদ কর আদায়ে আফ্রিকার দেশগুলোর সমতুল্য। জমিওয়ালা এবং বাড়িওয়ালাদের কাছ থেকে বছরে ৬ হাজার কোটি টাকার সম্পদ কর হারাচ্ছে সরকার। এসব কর আদায়ে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

বুধবার (২৪ মে) হোটেল লেকশোরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত সংলাপে এসব কথা বলা হয়। সংলাপের বিষয় ছিল সম্পদ কর।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সদস্য জাতীয় পার্টি নেতা ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী।

শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, কর্মসংস্থান ও করবিহীন উন্নত দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ, যেটা আসলে বেশিদিন টেকসই হবে না। এ ছাড়াও দেশের দুর্নীতি ও সুশাসন বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। সিপিডির নির্বাহী ড. ফাহমিদা খাতুনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এ ছাড়াও বক্তব্য রাখেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান- ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, ড. নাসির উদ্দিন আহমেদ, পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, ইউরোপীয় ইউনিয়নের হেড অব কোঅপারেশন মাওরিজিও সিয়ান এবং চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট স্নেহাশীষ বড়ুয়া প্রমুখ।

ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান বলেন, ভূমি কর ব্যবস্থা আধুনিকায়ন হচ্ছে। এখান থেকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আসছে। তিনি বলেন, কাজ করলে বেশ কিছু সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আমি বা আমরা জায়গা থেকে সে সিদ্ধান্ত নিতে পিছপা হই না। মন্ত্রী বলেন, আমাদের কর ব্যবস্থায় পরোক্ষ কর বেশি। এটি ইতিবাচক নয়। তবে এ অবস্থা থেকে সরে আসছে এনবিআর। তারা প্রত্যক্ষ করে মনোযোগী হয়েছে। এ ছাড়াও ভূমি মালিকদের জন্য সার্টিফিকেট অব ল্যান্ড ওনারশিপ বা সিএলও চালু হচ্ছে বলে জানান তিনি।

ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, কর্মসংস্থান ও করবিহীন উন্নত দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ, যেটা আসলে বেশিদিন টেকসই হবে না। আসলে দেশ ঋণনির্ভরশীল অনুন্নত অর্থনীতি হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, যে দেশে গণতন্ত্র নেই, সুশাসন ও ভালো সেবা নেই, যে দেশের আমলা ও রাজনীতিবিদরা টাকা পাচার করে বিদেশে বাড়ি-গাড়ি বানিয়েছে, যে দেশে ব্যাংক লুট হয়  সেখানে কর আহরণ কম হবে, এটাই স্বাভাবিক।

মূল প্রবন্ধে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ উন্নত দেশে মোট করের ১০ শতাংশ সম্পদ কর। কিন্তু বাংলাদেশে তা শূন্য দশমিক ৩৪ শতাংশ। তিনি বলেন, যে দেশ যত উন্নত, ওই দেশে সম্পদ তত বেশি। তার মতে, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ বাড়লে সম্পদ দশমিক ৪ শতাংশ বৃদ্ধির কথা। সেই হিসাবে বছরে আমাদের বাড়তি ৬ হাজার কোটি টাকা সম্পদ কর পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটি আসছে না।

তিনি বলেন, উন্নয়নে আমরা সিঙ্গাপুর, কানাডাকে ছাড়িয়ে গেলেও সম্পদ কর আদায়ে আফ্রিকার দেশগুলোর সমতুল্য। অনুষ্ঠানে বিআইডিএসের গবেষক বলেন, এই তুলনা যৌক্তিক নয়।  

তার মতে, আফ্রিকার জনঘনত্ব আর বাংলাদেশের জনঘনত্ব এক নয়। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশে আয় বেড়েছে দ্বিগুণ। একই সঙ্গে বেড়েছে বৈষম্যও। দেখার বিষয় হলো- আয়বৈষম্যের চেয়ে সম্পদবৈষম্য বেড়েছে দ্বিগুণ হারে। আয়বৈষম্য ১ দশমিক ৪ শতাংশ হলে সম্পদবৈষম্য বেড়েছে ৩ শতাংশেরও বেশি। অর্থাৎ সম্পদের বৈষম্য ক্রমান্বয়ে ঘনীভূত হচ্ছে। এ বৈষম্য কয়েকগুণ হারে বাড়ছে। তিনি বলেন, তিন ধরনের সম্পদের কর নিয়ে সিপিডি কাজ করেছে। সেগুলো হলো-প্রত্যক্ষ সম্পদ কর, হোল্ডিং কর ও উত্তরাধিকার কর। বর্তমানে সম্পদের সার চার্জ ৩৫ শতাংশ। এটাকেও আমরা উচ্চ কর বলে মনে করছি।

তিনি আরও বলেন, কর সিস্টেমে শহর ও গ্রামের মধ্যেও বৈষম্য আছে। দেশের ভেতরে সম্পদ যেভাবে  কেন্দ্রীভূত হয়েছে, যেভাবে আয় বৈষম্য বেড়েছে। ন্যায্যতা ও বৈষম্য কমাতে সম্পদের করের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন।

তার মতে, উন্নয়ন প্রকল্পে সরকার কর পরিশোধ করে না। সরকার যখন নিজে কোনো প্রকল্প হাতে নেয়, সেটা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হোক বা অন্য কিছু হোক, তখন কর পরিশোধ করে না। আবার সরকার যখন বিদেশ  থেকে কিছু পেত, একটা সময় ছিল এগুলোর আমদানি শুল্ক দিত না। তবে এখন তা পরিবর্তন হয়েছে।

তিনি বলেন, এখন যে সব ছাড় দেওয়া হচ্ছে, এগুলো কাউকে না কাউকে  দেওয়া উচিত। তাহলে হিসাবটাও বাড়ত। এতে সরকারের হিসাবের ভেতর বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ হিসাবে আসত। ড. দেবপ্রিয় বলেন, সরকার নিজের প্রকল্পে ছাড় নিলে অন্যদের সঙ্গেও প্রতিযোগিতায় অসাম্য সৃষ্টি হয়।

মূল প্রবন্ধে তিনি আরও বলেন, ‘পাঁচ ধরনের কর  চলমান রয়েছে। সেগুলো হলো-ভূমি উন্নয়ন ট্যাক্স, ওয়েলথ সারচার্জ (সম্পদ কর), হোল্ডিং ট্যাক্স, ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স ও গিফট ট্যাক্স। এর মধ্যে স্থাবর সম্পত্তি যখন নিজেদের মধ্যে দান বা হেবা হয়, সেখানে কোনো ট্যাক্স নেই। আমরা এ বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে বলেছি। তবে শুধু উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগে কর অব্যাহতি দেওয়া  যেতে পারে। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, নতুন এলাকা হিসাবে ভূমি কর আধুনিক করতে হবে। যুগোপযোগী করতে হবে হোল্ডিং ট্যাক্সকে। তিনি বলেন,সম্পদ আয় করে একটি প্রজন্ম। এটা ভোগ করে পরবর্তী প্রজন্ম। সেখানে ন্যায্যতা নিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশের উত্তরাধিকার কর প্রচলন করা অত্যন্ত প্রয়োজন।  

আহসান এইচ মনসুর বলেন, সম্পদ করের  ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছি। জমি ও বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্টের ক্ষেত্রে যথাযথভাবে কর আরোপ হচ্ছে না। এখানে বৈষম্য রয়েছে। জমির ওপর বিনিয়োগ বাড়ছে। কারণ জমির দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। এর বড় কারণ এ বিনিয়োগে বড় ধরনের কর দিতে হয় না।

তিনি বলেন, মানুষ হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়ছে। কিন্তু সেই অনুসারে সম্পদের ওপর কর দিচ্ছে না। বিশেষ করে শত শত বিঘা জমি কিনে ফেলে রাখার বিষয়টি নজরে আনতে হবে। তিনি বলেন, দুবাই, সৌদি আরবে দেখেছি, সেখানে জমি কিনে কেউ ফেলে রাখে না। রাখার সুযোগ নেই। কারণ অনুৎপাদনশীল জমির ওপর সেখানে উচ্চ হারে কর দিতে হয়। অথচ ঢাকার পাশে পূর্বাচলের দিকে তাকালে দেখা যায়- সেখানে শত শত প্লট ফাঁকা পড়ে আছে। এতে অর্থ অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় হচ্ছে, দেশের অর্থনীতি উপকৃত হচ্ছে না। জমি কিনে ফেলে রাখলে বাড়তি কর আরোপের সুপারিশ করেছেন তিনি। তার মতে, বাড়তি কর দিতে হলে জমির দামও অস্বাভাবিক হারে বাড়বে না। কারণ ট্যাক্সে চাপে আর কেউ জমি ফেলে রাখতে চাইবে না।

আরএস