দেশের চিকিৎসার প্রতি অনাস্থা ও উন্নত চিকিৎসার আশায় প্রতি বছর কয়েক লাখ বাংলাদেশি চিকিৎসা নিতে বিদেশে যান। এক দশক আগেও শুধু উচ্চবিত্তরা বিদেশে চিকিৎসা নিতে ছুটলেও এ তালিকায় এখন যোগ হয়েছেন মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তরা। বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়া বেশির ভাগ রোগীর গন্তব্য ভারত। কিন্তু গত বছর ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার প্রধান শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারত চলে যান। এর পর থেকেই ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক ফাটল ধরে। দুই দেশের মধ্যে নানা ইস্যুতে দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
এক পর্যায়ে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা সীমিত করে ভারত। ভ্রমণ ভিসা বন্ধ করে দিয়ে সীমিত পরিসরে চালু রাখে মেডিকেল ভিসা। এতে চিকিৎসার জন্য ভারত যাওয়া রোগীরা বিপাকে পড়েন। এমন বাস্তবতায় অন্তর্বর্তী সরকার উন্নত চিকিৎসায় বিদেশমুখী রোগীদের ভারত বাদে তৃতীয় কোনো দেশের যাওয়ার কথা বলছে। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরে বিষয়টি বেশ আলোচনায় আসে। ভারতের বিকল্প হিসেবে চীনে চিকিৎসা সেবা নিতে বাংলাদেশি রোগীদের বেশ কিছু অসুবিধাও দেখা যায়। চীন বা অন্য কোনো দেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার ক্ষেত্রে যাতায়াত ও যোগাযোগের মতো বিষয়গুলোর প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।
সহজ গন্তব্য ভারত : বাংলাদেশি নাগরিকদের উন্নত চিকিৎসার তালিকায় স্থান করে নিয়েছে ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, চীন, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো। চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগীদের প্রথম পছন্দ ভারত। সহনশীল চিকিৎসা ব্যয়, যাতায়াত ও যোগাযোগের সহজ ব্যবস্থা এর অন্যতম প্রধান কারণ। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া বেশির ভাগ রোগীর গন্তব্য ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু, দিল্লি, মুম্বাই, চেন্নাই কিংবা বেঙ্গালুরু। ভারত অন্যান্য ভিসার চেয়ে মেডিকেল ভিসার ক্ষেত্রে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে।
ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্সের তথ্য অনুযায়ী, গেল আগস্টের আগে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ ভারতে চিকিৎসা নিতে যেতেন। শুধু ব্যাংকিং কার্যক্রমের মাধ্যমেই ব্যয় করতেন ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। ব্যাংকিং কার্যক্রমের বাইরে এ ব্যয় আরও কয়েকগুণ বেশি। কিন্তু ভিসা সীমিত করার পর ভারতমুখী রোগী অর্ধেকে নেমে এসেছে। ভারতের ডক্টর কমিউনিটি সার্ভের তথ্য অনুযায়ী, অন্যান্য বছরের তুলনায় চলতি বছর ভারতে যাওয়া বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা অর্ধেকের মতো কমে গেছে।
তৃতীয় দেশে নানা প্রতিবন্ধকতা : বাংলাদেশিদের জন্য মেডিকেল ভিসা সীমিত করায় ভারতমুখী অনেক রোগী বিপাকে পড়েন। অন্তর্বর্তী সরকার তৃতীয় কোনো দেশে উন্নত চিকিৎসার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি ড. ইউনূসের চীন সফরে চিকিৎসার বিষয়টি আলোচনায় ছিল। সফর শেষে জানা যায়, চীন এরই মধ্যে ইউনান প্রদেশের কুনমিংয়ের চারটি হাসপাতাল বাংলাদেশি রোগীদের জন্য বিশেষভাবে বরাদ্দ করেছে। ওই চার হাসপাতালে একজন বাংলাদেশি রোগী চীনা নাগরিকদের সমান খরচেই চিকিৎসা নিতে পারবেন।
বাংলাদেশি রোগীদের চীনে যাতায়াত সহজ করতে চায়না ইস্টান এয়ারলাইন্স চট্টগ্রাম থেকে কুনমিং পর্যন্ত ফ্লাইট পরিচালনার পরিকল্পনা করছে। এর ফলে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের মানুষ সহজে চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর কুনমিংয়ের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে পারবেন। কুনমিং ভ্রমণ সহজ করতে ঢাকা-কুনমিং রুটে বিমান টিকিটের দাম কমানোর উদ্যোগও নিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ।
চীনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশিদের জন্য স্বাস্থ্যসেবার বিভিন্ন সুবিধা উন্মুক্ত করবে। রোগীরা যেন সহজে ভিসা পান, সেই উদ্যোগও নিয়েছে চীন সরকার। একই সঙ্গে বাংলাদেশে একটি উন্নতমানের বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন। বাংলাদেশি রোগীদের টানতে চীনের এমন সব উদ্যোগের মধ্যেও নানা প্রতিবন্ধকতা দেখছেন চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগী ও খাত সংশ্লিষ্টরা। প্রায় দুই যুগের বেশি সময় ধরে এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি রোগীদের ভিসা ও ডক্টর অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে কাজ করে ইউনি হেলথ ইন্টারন্যাশনাল।
প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক জুবায়ের আহমেদ বলেন, ভারত পার্শ্ববর্তী দেশ হওয়ায় বাংলাদেশিরা সহজে চিকিৎসা নিতে পারেন। অনেক সময় দেখা যায়, দেশের চেয়ে তুলনামূলক কম খরচে ভারতে বিভিন্ন চিকিৎসা সেবা পাওয়া যায়। বর্তমানে ভিসা সীমিত করায় বহু রোগী ভোগান্তিতে পড়েছেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য তৃতীয় দেশ হিসাবে চীন বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা জানিয়েছে। কিন্তু এখানে কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। তিনি বলেন, প্রধান দুটি প্রতিবন্ধকতা হলো- যাতায়াত ও চিকিৎসা ব্যয়।
যদিও চীন বলছে বাংলাদেশি রোগীরা চীনের নাগরিকের মতো ব্যয়েই চিকিৎসা পাবেন। কিন্তু এ ব্যয় ভারতের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। যা অনেকের পক্ষে বহন করা সম্ভব হবে না। তাছাড়া ভারতে বাংলাদেশি রোগীরা আকাশপথ, সড়ক, রেল ও নৌপথে সহজে যাতায়াত করতে পারেন। কিন্তু চীনে শুধু আকাশপথ ব্যবহার করেই যেতে হবে। এতে চিকিৎসা ব্যয় বাড়বে। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত একটি শ্রেণি চীনে গেলেও ভারতে যেমন সব স্তরের মানুষ চিকিৎসার জন্য যান তা সম্ভব হবে না। চীন ছাড়াও উন্নত চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশিদের বড় একটি অংশ থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর যান।
জুলাই আন্দোলনে আহত অনেককে সরকার এ দুই দেশে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়েছে। দেশ দুটিতে চিকিৎসা ব্যয় প্রায় আকাশচুম্বী। ভারত ও চীনের চিকিৎসা ব্যয়ের তুলনায় ক্ষেত্র বিশেষে থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা ব্যয় প্রায় কয়েকগুণ বেশি। যা সাধারণ নাগরিকের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদের পরামর্শ : সম্প্রতি পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআরআই) ও বিশ্বব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক কর্মশালায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানান, বিদেশে চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশিরা বছরে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি। বিশ্বের যেসব দেশ থেকে বেশি রোগী চিকিৎসার জন্য অন্য দেশে যায়, এমন ১০টি দেশের মধ্যে শীর্ষ ইন্দোনেশিয়া। এই তালিকার ১০ নম্বরে বাংলাদেশ। তালিকায় অন্য দেশগুলো হচ্ছে— যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইতালি, জার্মানি, লেসেঙ্গো, দুবাই ও লিবিয়া।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক ডা. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসা নিতে বিদেশে যাচ্ছে এমন রোগীর সংখ্যা কম নয়। চিকিৎসা নিতে যাওয়া বেশির ভাগ রোগী ভারতে যায়। বিশ্বের সব দেশেই প্রতিবেশী দেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার প্রবণতা আছে। যেসব রোগের চিকিৎসা দেশেই করা সম্ভব সেসব রোগের চিকিৎসার জন্য বিদেশে গেলে সময় ও অর্থ অপচয় হয়। তিনি বলেন, আবার এটাও অস্বীকার করা যাবে না যে কিছু রোগের চিকিৎসা আমাদের দেশে এখনো প্রসারিত হয়নি। সেসব রোগের চিকিৎসার জন্য মানুষ বিদেশে যেতে পারে। তবে কেউ দেশে চিকিৎসা নিতে থাকলে হুজুগের বশে বিদেশ যাওয়ার প্রয়োজন নেই। দেশের চিকিৎসকরা যথেষ্ট পরিশ্রমী ও মেধাবী। আমাদের দেশেই ভালো চিকিৎসা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, দেশের স্বাস্থ্য খাতে আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়ায় চিকিৎসার জন্য বিদেশমুখী হচ্ছে মানুষ। এতে দেশের কয়েক হাজার কোটি টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। দেশের স্বাস্থ্যসেবা গতানুগতিক ধারায় চলছে। কেন মানুষ চিকিৎসা নিতে দেশের বাইরে যাচ্ছে এ বিষয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কোনো পদক্ষেপ নেই।
তিনি বলেন, ভারত ভিসা বন্ধ করায় আমরা উন্নত চিকিৎসার জন্য তৃতীয় দেশ খুঁজছি। কিন্তু নিজ দেশের স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নত করছি না। নিজেদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভালো করার দিকে নজর দিতে হবে। একটা শ্রেণি যখন বিদেশে চিকিৎসা নিতে যায় তারা এমন ঘটা করে যায় এতে অন্যরাও বিদেশে চিকিৎসা নিতে উৎসাহ পায়।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রী) অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, বিদেশে চিকিৎসা নেয়া একটি সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদেশে চিকিৎসা নেয়ার প্রবণতা কমাতে আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। বেশ কয়েকটি রোগ চিহ্নিত করেছি যেসব রোগের চিকিৎসার জন্য মানুষ বিদেশে যাচ্ছে। এগুলোর মধ্যে- ক্যান্সার, অঙ্গ প্রতিস্থাপন ও হার্টের বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। আমরা এগুলো নিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ শুরু করেছি। যার সুফল মিলতে সময় প্রয়োজন।