সিটি কর্পোরেশন ডেঙ্গুর সঙ্গে অন্যান্য মশার পার্থক্য বুঝতে পারছেনা বলেই নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে- ড. কবিরুল বাশার, কীটতত্ত্ববিদ
ডেঙ্গুর প্রকোপ প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। এর থেকে কিছুতেই মিলছে না মুক্তি। প্রতি বছর ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন শত কোটি টাকা বাজেট ঘোষণা করেও কোন আশানুরূপ ফল পাচ্ছে না। দেশে প্রায় ১২৩ প্রজাতির মশা রয়েছে। শুধু ঢাকাতেই দেখা যায় ১৬ প্রজাতির বেশি মশা। এরমধ্যে ৯৯ শতাংশই কিউলেক্স মশা আর মাত্র এক শতাংশ এডিস মশা আছে বলে জানিয়েছেন কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার।
এক শতাংশ মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা সম্পর্কে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার আরও বলেন, গত বছরে কেন ৩ লাখ ২১ হাজার মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে তা জানা দরকার। মশা সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে। তবে ডেঙ্গুর সঙ্গে অন্যান্য মশাকে মিলানো যাবে না। সিটি কর্পোরেশন এই পার্থক্যটা বুঝতে পারছেনা বলেই আজ এই অবস্থা। তাই ডেঙ্গু ও কিউলেক্স মশাকে আলাদাভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ঢাকাতে ৪৩ শতাংশ মশা বহুতল ভবনে প্রজনন হয়। এক শতাংশ ডেঙ্গু মশা আক্রমণেই জনজীবন অতিষ্ঠ। যা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে সিটি কর্পোরেশন। লক্ষ নির্ধারণ করে প্রতিনিয়ত কাজ করে করতে হবে।
এই এক শতাংশ মশাকে নিয়ন্ত্রণ করতে ডিএসসিসি ও ডিএনসিসি বার বার ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। যদিও তাদের দাবি, মশক নিধনের জন্য বিশেষ অভিযান, মোবাইল কোর্ট, জনসচেতনতা, র্যালি, প্রশিক্ষণ, প্রচারণা ও মশকনিধনের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করছে তারা। সেই সাথে ব্যয় করছেন বিপুল পরিমাণে অর্থ।
বছরজুড়ে বিস্তার লাভ করা ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে দুই সংস্থার ব্যর্থতা সবার কাছে পরিষ্কার। অথচ এ খাতে বছরে শত কোটি টাকার বেশি জনগণের রাজস্ব খরচ করছে সংস্থা দুটি। প্রতিদিন মশা নিয়ন্ত্রণে তারা কীটনাশক ব্যবহার, লার্ভা নিধনে কীটনাশক ছিটানো, বড় মশা নিধনে ফগিং করা হচ্ছে। তবে এ কার্যক্রম যথাযথভাবে করা হচ্ছে না বলে অভিমত কীটতত্ত্ববিদদের। তাদের মতে, মশা নিয়ন্ত্রণ একটি বিজ্ঞানভিত্তিক কাজ। প্রজনন মৌসুম বুঝে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু দুই সিটির কার্যক্রমে তার বড়ই ঘাটতি রয়েছে।
ডিএসসিসি সূত্রমতে, শুধু মশা মারতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা বরাদ্দ রেখেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। এর মধ্যে ৩৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা দিয়ে মশা নিধনে ব্যবহূত কীটনাশক এবং বাকি আট কোটি ২৫ লাখ টাকা যন্ত্রপাতি কেনা ও পরিবহন খাতে ব্যয় করা হয়। যা গত অর্থবছরে এ খাতে খরচ করেছে প্রায় ৩১ কোটি টাকা।
ডিএনসিসি সূত্রমতে, মশা নিধনে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রায় ১২২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখে ডিএনসিসিও। এর মধ্যে মশা নিধনকাজ পরিচালনার জন্য ৮৪ দশমিক ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। মশার ওষুধ কেনার পেছনেই ব্যয় করে ৪৫ কোটি টাকা। আর ৩০ কোটি টাকা ব্যয় করে বেসরকারি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিয়োজিত মশককর্মীদের দিয়ে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পীত ব্যবস্থাপনার কারণেই এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে ডিএসসিসি ও ডিএনসিসি। বাংলাদেশের এই পরিণতির পেছনে গত কয়েক বছর ধরে চলমান অপরিকল্পিত নগরায়ন, মশক নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা, স্বাস্থ্যখাতের দুরবস্থাসহ বেশ কিছু কারণ রয়েছে। অনেক বছর ধরেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মশার ওষুধ ছিটানো এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মত নানা পদক্ষেপ নেয়ার কথা থাকলেও এখনো নিয়ন্ত্রণে আসছে না ডেঙ্গু। মশার আচরণগত বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে পারলে এটি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। দেশে মেডিসিন ল্যাবের অনুমতি থাকলেও ভ্যাকসিন ল্যাবের অনুমতি নেই। ভ্যাকসিন উৎপন্ন করতে পারলে খরচ কমে যাবে।
তারা আরও বলেন, সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলগণ প্রতিটি লোককে এবিষয়ে সতর্ক করা জরুরি। সাধারণ মানুষ মশা সম্পর্কে জানলেও মশার আচরণ সম্পর্কে জানে না। বহুতল ভবনগুলোকে ডেঙ্গু প্রজনন সহায়ক করা যাবে না। দুই সিটি বাজেট করলেও লাভ হবে না যদি সঠিক ব্যবস্থা না থাকে। সকল বিষয় তদারকি করা জন্য কমিটি গঠন করতে হবে। ডেঙ্গুর চার ধরনের আক্রান্ত হলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অপ্রকৃত নগরায়ন তাপমাত্রা ও ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে ফলে সিটি কর্পোরেশন এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খাচ্ছে। এক্ষেত্রে কীটতত্ত্ববিদ ও সিটি কর্পোরেশন মিলে কাজ করতে পারলে সফল হওয়া সম্ভব। নিজের পরিবার আক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত কেউ সতর্ক হয় না।
মশকনিধন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, সিটি কর্পোরেশনের মাঝে সমন্বয়ের অভার রয়েছে। জনগণ ও মানুষকে নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠনকে ছাড়া কখনো মশা নিয়ন্ত্রণের কাজ সফল করতে পারবে না। তাছাড়া একার পক্ষে তা সামাল দেয়া কষ্টকর। বিটিআই সাধারণত সকল মশাই মারা যায়। কিন্তু ডেঙ্গুর জন্য বিশেষভাবে কোন কীটনাশন আনতে হবে। মানুষ আক্রান্ত না হোক সেটাই সকলের চাওয়া। আমাদের ঘরের দায়িত্ব কোন সিটি কর্পোরেশনের নয়। এবার ডেঙ্গু আক্রমন করলে ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে।
মশা নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, আত্মসমালোচনার জন্য আমরা গোল টেবিল বৈঠক করি। যেখানে সকল বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হয়। ড্রোনের মাধ্যমে প্রতিটি বিল্ডিংয়ের ছাদের ডাটা সংগ্রহ করা হয়েছে। মশককর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। বিটিআই নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকলেও এটিকে আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। পাঁট টন বিটিআই ১৭ লাখ টাকা দিয়ে আনা হলেও অনিয়মের কারণে তাদেরকে কোন টাকা দেয়া হয়নি। সেই কোম্পানির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হয়েছে। পুনরায় আবারও কীটনাশক আনা হবে। তবে আগেরগুলো ব্যবহার হবে না।
তিনি আরও বলেন, আমরা ঠিকমতে মনিটরিং করতে পারছি না এটি সত্য। তবে একটি কমিটি দ্রুত করা হবে যাতে সকল কিছু তদারকি করতে পারে। জনগণকে সাথে নিয়েই কাজ করছে উত্তর সিটি। হটস্পটগুলো নির্ধারণ করার জন্য টিম গঠন করা হবে। সবাইকে জবাবদিহিতার মধ্যে কাজ করতে বাধ্য করা হবে। চলতি মাস থেকে সিটি কর্পোরেশন পুরোপুরিভাবে মাঠে নামবে।
আরএস