এখনও কমেনি বিদেশি ভাষার ব্যবহার

নিজস্ব প্রতিবেদক: প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৪, ০৭:২০ পিএম
  • বিজ্ঞাপন ও বিলবোর্ড বিদেশি ভাষার দখলে
  • সরকারি প্রতিষ্ঠানের ফলকে নেই বাংলার ব্যবহার
  • শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম ইংরেজিতে 
  • আইন থাকলেও নেই বাস্তবায়ন
  • কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাই বাড়ছে ভিন্ন ভাষার ব্যবহার

অমর একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির কাছে মহান একটি দিন। কারণ বাংলাদেশ একমাত্র দেশ যারা মাতৃভাষা রক্ষার্থে রক্ত দিতে হয়েছে। এই দিবসটি পৃথিবী জুড়ে আন্তর্জাতিক দিবস হিসাবে পালন করা হচ্ছে। বাংলা ভাষার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন বাঙালিরা। অথচ দেশের প্রতিটি বিজ্ঞাপন, বিলবোর্ড বা সাইনবোর্ডে এখনো বাংলা লেখার প্রচলন হয়নি।

 বর্তমানে দেশের অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন কোম্পানি ও সংস্থা এমনকি বিজ্ঞাপন, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ডসহ অনেক ক্ষেত্রেই বাংলা ছাপিয়ে ইংরেজির প্রাধান্য স্পষ্ট। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের প্রতিটি বিলবোর্ড ও সাইনবোর্ডে দৃশ্যমান হচ্ছে বিভিন্ন ভাষার লেখা। এই বিষয়ে বিভিন্ন আইন ও নির্দেশনা থাকলেও কেউই তা মানছে না। 

বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞাপন, বিলবোর্ড ও সাইনবোর্ডে বাংলা লেখার ব্যাপারে দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের জন্য ১৯৮৭ সালে ‍‍`বাংলা ভাষা প্রচলন আইন‍‍` প্রণয়ন করা হয়। বাংলা ভাষা প্রচলন আইন-১৯৮৭ এ বলা হয়, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যমসহ সব ধরনের বিজ্ঞাপন, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, নামফলক, গাড়ির নম্বরপ্লেট ইত্যাদি বাংলায় লেখা বাধ্যতামূলক এবং সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী দূতাবাস ও বিদেশ-সংশ্নিষ্ট ক্ষেত্র ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা ব্যবহার বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য করা হলেও বাস্তবায়নে দৈন্য স্পষ্ট।

রাজধানী ঢাকা বা দেশের যেকোনো অঞ্চলের চলার সময় ইংরেজি ভাষার বিজ্ঞাপন, সাইনবোর্ড বা বিলবোর্ড ছাড়া অন্যকিছু চোখে পড়বে না। দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখনও ইংরেজি ভাষার ব্যবহার দেখা যায়। যারা বাংলা ভাষার ব্যবহার সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করবেন তাদের প্রতিষ্ঠানেই বিদেশি ভাষার ছড়াছড়ি। এমনকি দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা আছে ইংরেজি ভাষায়। 

তাছাড়া রাস্তাঘাটে, বিপণিবিতানে সাইনবোর্ড বা বিলবোর্ডে নেই বাংলা ভাষার ছোঁয়া। তাছাড়া সাইনবোর্ড-বিলবোর্ডে বাংলায় লেখার অনীহা এবং বাংলা বানানে ভুলের ছড়াছড়িও কম নয়। এ নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন ভাষাবিদগণ। তাদের মতে, ভাষার জন্য সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি। এখনো সর্বত্র দেখা যাচ্ছে বিদেশি ভাষার সাইনবোর্ড। বাণিজ্যিক কেন্দ্রসহ সর্বত্র বিদেশি ভাষার প্রাধান্য দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামফলকে ইংরেজির পরিবর্তে বাংলা ভাষার ব্যবহারে নানা সময় উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। 

যদিও দেশের সর্বত্র বাংলা ভাষার প্রচলন নিশ্চিত করতে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চের ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি দেওয়া এক আদেশে বলা হয়, ‘সকল ধরনের সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নম্বর প্লেট, সব দফতরের নামফলক এবং ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় ইংরেজি বিজ্ঞাপন ও মিশ্র ভাষার ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।

সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভা থেকে বিভিন্ন দোকানপাট, স্কুল-কলেজ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স দেয়া হয়। ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ার সময় দোকান বা প্রতিষ্ঠানের নামে সাইনবোর্ড বা নামফলক স্থাপনের জন্য একটি শর্ত দেওয়া হয়। অনুমতি নেওয়ার সময়ই নামফলকে বাংলা ব্যবহারের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়। অতিরিক্ত একটি সিল দিয়ে ট্রেড লাইসেন্সে লেখা থাকে, ‘সাইনবোর্ড ও ব্যানার বাংলায় লিখতে হবে।’ তবে বাস্তবে এসব আদেশ কতটুকু বাস্তবায়ন হয় তা ঘর থেকে বের হলেই দেখা যায়।

কোনো সাইনবোর্ড বা বিলবোর্ডেই দেখা যায় না বাংলা ভাষার ব্যবহার। এমনকি ডিজিটাল বাংলাদেশে এখন ডিজিটাল বিলবোর্ডগুলোও ইংরেজির ব্যবহার শোভা পাচ্ছে। বাংলা এসব জায়গায় চরমভাবে উপেক্ষিত। উদাসীনতা ও জবাবদিহির ব্যবস্থা না থাকার কারণেই এমনটি হচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ থেকে উত্তরণের জন্য গোটা ব্যবস্থারই পরিবর্তন দরকার। দরকার মানসিক ও সামাজিক বৈপ্লবিক পরিবর্তন।

স্বাধীনতার পর দেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন ‍‍`জাতীয় শিক্ষা কমিশন ১৯৭২‍‍`-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা। পাশাপাশি ইংরেজি বা অন্য ভাষাগুলো ব্যবহার করা যাবে।’

এ আদেশের পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডগুলোতে আদেশটি কার্যকর করতে বলা হলেও বাস্তবতা দুঃখজনক। সরকারি অফিস-আদালত কিংবা অন্য কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন হলেও বিজ্ঞাপন, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, নামফলক ইত্যাদিতে এ আদেশের বাস্তবায়ন প্রায় উপেক্ষিত। এখনও ইংরেজি কিংবা বিদেশি ভাষায় বিজ্ঞাপন, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, নামফলক হরহামেশা চোখে পড়ছে।

বিজ্ঞাপন ও অন্যান্য প্রচারণার উপকরণে বাংলা ভাষার বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা নেই। কোথাও কোথাও শুধু ইংরেজিতে লেখা সাইনবোর্ড চোখে পড়ছে। আবার কোথাও ইংরেজির পাশে ছোট করে বাংলা লেখা দেখা যাচ্ছে, যা ভাষার মর্যাদা আরও ক্ষুন্ন করছে। 

আবার অনেকের দাবি, ইংরেজিতে লিখলে স্মার্ট ও সুন্দর দেখা যায়। বাংলা ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে না জানা ও বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে প্রশাসনের দুর্বলতা চোখে পড়ার মতো। ইংরেজি ও অন্যান্য বিদেশি ভাষার ছড়াছড়িতে বাংলা ভাষার প্রাধান্য ম্লান হতে পারে না। ফেব্রুয়ারি এলেই ঘটা করে এ মাসটি উদযাপন, কিন্তু এ মাস গেলেই বাংলা ভাষার গুরুত্ব ও তাৎপর্য ভুলে যাওয়ার মধ্যে সমাধান নেই।

যে ভাষার জন্য সালাম, রফিক, জব্বার, বরকতরা জীবন দিয়েছেন, সে ভাষাকে গুরুত্ব দেওয়া এবং সর্বক্ষেত্রে প্রচলনে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। অন্যথায় আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষার গুরুত্ব হারাবে।

ব্যক্তিগতভাবে সচেতন হলে সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড কিংবা নামফলকে বাংলার প্রচলন কঠিন হবে না। এ ক্ষেত্রে জনসচেতনতা তৈরিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।

বিআরইউ