মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি এর ১০ তম মানবাধিকার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) রাজধানীর বাংলা মটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অডোটেরিয়ামে এ মানবাধিকার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
মানবাধিকার সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন দেশে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গসহ সারাদেশ থেকে আসা প্রায় শতাধিকের ওপরে মানবাধিকার কর্মীরা।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য কবি মাহবুব মোর্শেদ বলেন, `আমরা লেখালেখির মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন সমস্যা-অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করি। এবারের নির্বাচনের পর থেকে যেটি বেশি আলোচিত হয়েছে তা হলো ভোটাধিকার। এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার। আমাদের ভোটাধিকার না থাকায় গণতন্ত্র শুধু কাগজে-কলমে পড়ছি। মানবাধিকার কর্মীদের ভোটাধিকার নিশ্চিতে কাজ করতে হবে। বিনা বিচারে সাজা, বিনা দোষে জেলে নেয়া, আটক করলে কিংবা নির্যাতন বড় অর্থে মানবাধিকারের লঙ্ঘন। বিভিন্ন সরকারের সময়ে এদেশে মানবাধিকারের লঙ্ঘন হয়েছে। আমাদের সমাজেও সার্বিকভাবে মানবাধিকার, স্বাধীনতা ইত্যাদি নিয়ে একধরনের অজ্ঞতা রয়েছে। এসব পরিস্থিতি উত্তরণে আমাদের সকলকে একটি জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে হবে।`
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমদে বলেন, `কথা বলার ক্ষেত্রে যে দ্বিধা এটিই এখন বাংলাদেশের বড় সংকট। বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থার বড় সংকট বিবেকের স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা না থাকা। মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকলে বর্তমানের ঘটনাগুলো ঘটতো না। বর্তমানে অনেক থলের বিড়াল বেরিয়ে আসছে। ক্ষমতায় থাকাকালে তাদের কর্মকাণ্ড বেরিয়ে আলোচনা কেন? কারণ তাদের কাছে সবাই কুক্ষিগত ছিল। এজন্য সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি নিশ্চিত হলে ক্ষমতায় থাকাকালে এখন বেরিয়ে আসা থলের বিড়ালরা আর দুর্নীতি করার সাহস পেতেন না।`
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও দৈনিক সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান বলেন, `যেখানে ভোটাধিকার থাকেনা, নির্বাচন হয়না সেখানে অন্যান্য অধিকারও পাওয়া যায় না। এদেশে
গণতন্ত্র কখনই ছিলোনা। যা ছিল ভোটতন্ত্র। পাঁচ বছর পরপর জনগণ একটা মালিকানা পেতো। নিজেদের ক্ষমতাবান মনে করতো। কিন্তু সেই অধিকারটুকুও কেড়ে নেয়া হয়েছে। রাষ্ট্র মূর্তমান হয় তার প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে। পুলিশ, সেনাবাহিনী, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষার মাধ্যমে একটি রাষ্ট্রের একটি চিত্র পাওয়া যায়। কিন্তু এখন রাষ্ট্র মানে বেনজীর-আজিজ- মতিউর। এই হলো রাষ্ট্রের চেহারা। এর উপরেও রক্ষক আছে, যারা এদের পরিচালনা করেছে। রাষ্ট্রই তাদের প্রটেক্টর হয়ে আছে। আর যারা জনগণ তারা অধিকার হারা হয়ে আছে। যখন এদের দাপট ছিল আমরা কথা বলতে পারিনি। কারণ এখানে একটি ভয়ের সংস্কৃতি কাজ করছে আমাদের মাঝে। আমাদের প্রতিনিয়ত মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, সুশাসনের জন্য সংগ্রাম জারি রাখতে হবে। রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা বিরুদ্ধে সকলকে সবসময় সোচ্চার হতে হবে। এই রাষ্ট্র সবার। এখানে সবার অধিকার নিশ্চিত করতে হলে সোশাল জাস্টিস দরকার।`
মানবাধিকার কর্মী ও হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির প্রধান উপদেষ্টা মো. নূর খান বলেন, `এমন একটি সময়ে আমরা সম্মেলন করছি যখন এদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। আমরা দেখেছি ক্রস ফায়ারের মাধ্যমে বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড, সাদা পোশাকে মানুষকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন, হয়রানি ও গুম করা হয়েছে। এসবের ভুক্তভোগী আমাদের অনেকেই। আমেরিকা স্যাংশন দেয়ার পূর্ব থেকেই মানবাধিকারকর্মীরা কথা বলেছে। সেসময় থেকে একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের দাবি জানানো হয়েছে বারবার। এগুলো সবই গণমাধ্যমে এসেছে। কিন্তু সরকার উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে পৃধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়ে নূর খান বলেন, `দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করুন। শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করুন।` এছাড়া পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের বিবৃতির সমালোচনা করে বলেন, `এর মাধ্যমে তারা ব্যক্তি দায় নিজেদের কাধে নিলেন।`
দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক মহাপরিচালক মইদুল ইসলাম বলেন, `সংবিধানে বলা আছে রাষ্ট্র এমন ব্যবস্থা করবে যাতে কেউ অবৈধ উপার্জন করতে না পারে। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি তার ভিন্ন চিত্র। এবারের বাজেটে করের হার কমিয়ে দিয়ে কালো টাকাকে সাদা টাকা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। যাদের সাদা টাকা রয়েছে তাদের কর হার বেশী। এটি সংবিধানের পরিপন্থি।`
দুর্নীতি দমন কমিশনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, `কমিশনে অভিযোগ আসলে তা অনুসন্ধান ও তদন্তের জন্য অনেক সময়ের অপচয় হয়। এই সময়ের মধ্যে অনেক অপরাধী পালিয়ে যায়। আমি দায়িত্বে থাকাকালে চেয়েছিলাম যদি কমিশনের কাছে ক্রেডিবল ইনফরমেশন থাকে তাহলে সাথে সাথে যেন অ্যাকশন নেয়া হয়। কিন্তু তা করা হয়নি।`
দিনব্যাপী এই সম্মেলন এসময় আরও বক্তব্য রাখেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কামাল আহমেদসহ বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ।
এছাড়া উপস্থিত ছিলেন, হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত মানবাধিকার কর্মীরা।
আরএস