ফেনীতে ১০ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি, বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন সাড়ে ৩ লাখ গ্রাহক

ফেনী জেলা প্রতিনিধি: প্রকাশিত: আগস্ট ২২, ২০২৪, ০৫:২৪ পিএম

ভারী বৃষ্টি ও ভারতীয় পানির চাপে সৃষ্টি  স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে।এখনও হুহু করে ঢুকছে পানি।বাড়ছে পানির উচ্চতা। পানিবন্দি হয়ে পড়ছে জেলার ৬ উপজেলার অন্তত ১০ লক্ষাধিক মানুষ। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সাড়ে তিন লাখ গ্রাহক। গোলযোগ দেখা দিয়েছে প্রায় সব কয়টি অপারেটরের মোবাইল নেটওয়ার্কেও।

বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) দুপুর পর্যন্ত জেলার সদর উপজেলা,পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া,দাগনভূঞা ও সোনাগাজীর বেশকিছু এলাকার মানুষ বন্যার কারণে বিদ্যুৎবিহীন অন্ধকারাচ্ছন্ন ও মোবাইল নেটওয়ার্কিং গোলযোগের কারণে বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে দিনাতিপাত করছে জানা গেছে।

টানা বৃষ্টি এবং মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ভেঙে যাওয়া অংশ দিয়ে প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করায় ডুবছে একের এক জনপদ। সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া কারণে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছেন স্থানীয়রা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বন্যার পানিতে বিদ্যুতের খুঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় গত সোমবার (১৯ আগস্ট) রাত থেকেই জেলার পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলার সব এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় মঙ্গলবার সকালে সোনাগাজী ও দাগনভূঞা উপজেলার কিছু এলাকায় পুরোপুরি সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়। একইসাথে ভারী বৃষ্টিতে ফেনী শহরে জলাবদ্ধতার কারণে বুধবার থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

শুধু সম্পদ নয়, প্রাণ বাঁচানোই মুখ্য হয়ে উঠেছে মানুষের। বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি কোস্টগার্ড, বিজিবি, ফায়ারসার্ভিস ও স্বেচ্ছাসেবীরা যোগ দিয়েছেন। তবে দুর্গত এলাকায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় ও পানির প্রবল স্রোত থাকায় ব্যাহত হচ্ছে উদ্ধার কার্যক্রম।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বন্যায় জেলার ফুলগাজী, পরশুরাম এবং ছাগলনাইয়ার প্রায় ৯৫ শতাংশ এলাকা পানিতে ডুবে গেছে। বন্ধ রয়েছে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা, নেই বিদ্যুৎ সংযোগ। সময়ের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন দুর্গত অঞ্চলে বানভাসি মানুষের বাঁচার আকুতি প্রবল হয়ে উঠেছে। সেনা ও কোস্টগার্ডের ২৪টি বোট উদ্ধার কাজে নিয়োজিত রয়েছে।

ফেনী শহরের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মঞ্জুর আলম জানান, বুধবার সকাল ১০টার দিকে মোবাইল ফোনে পরশুরামের মধ্যম ধনীকুন্ডা এলাকায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয় তার।এরপর  সন্তানদের নিয়ে প্রাণে বাঁচতে পাশের একটি দোতলা ভবনে আশ্রয় নিয়েছিল পরিবারের সদস্যরা।

তিনি আরও বলেন,সেখানে তখন পানিতে নিচতলা পুরোটা ডুবে ছিল। কিন্তু তারপর থেকে আর কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারছি না। পানির তীব্রতার কারণে বাড়ি ফেরারও পরিস্থিতি নেই। এছাড়া শহরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও পানি ঢুকে মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে। ভয়ানক দুঃসময় কাটছে আমাদের।

এছাড়া জেলার পরশুরামের মির্জানগর এলাকা থেকে পরিবারের পাঁচ সদস্যকে নিয়ে বাঁচার আশায় আশ্রয়ের সন্ধানে ফেনী শহরের স্টেশন রোডের একটি হোটেলে এসে উঠেছেন ইসমাইল হোসেন। তিনি বলেন, রাতভর আতঙ্ক, মানুষের আর্তি আর বন্যার প্রবল বিধ্বংসী রূপ দেখেছি। ভিটেমাটি ছেড়ে সামান্য কয়েকটি কাপড়চোপড় সম্বল হিসেবে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হতে বাধ্য হয়েছি।

একই উপজেলার বাসিন্দা এম এ হাসান  বলেন, বন্যার পানিতে ঘরবাড়ি সব ডুবে গেছে। পানির তীব্র স্রোতের কারণে ঠিকভাবে উদ্ধার কাজও করতে পারছেন না। তারমধ্যে বিদ্যুৎ, মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় আরো দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

স্থানীয় শালধর গ্রামের মো. আসিফ বলেন, বেশিরভাগ এলাকার একচালা ও পাকাঘর (একতলা) ডুবে গেছে। কোথাও আশ্রয় নেওয়ার মতো অবস্থা নেই। বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।

ফুলগাজী উপজেলার আনন্দপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য মোহাম্মদ সেলিম বলেন, ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলায় প্রতিবছর পাহাড়ি ঢলের পানিতে বন্যা হলেও ১৯৮৮ সালের পর এই ধরনের ভয়াবহ বন্যা আর হয়নি। তিন উপজেলায় প্রায় প্রতিটি বাড়ি ও বসতঘরে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে।

দাগনভূঞা উপজেলার ফখরুল ইসলাম মামুন  বলেন, অনেকেই ঘর বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। পানিতে অধিকাংশ এলাকার ঘরবাড়িসহ চারপাশ ডুবে গেছে।

সোনাগাজীর আবদুর রহিম জানান,ওই উপজেলার মুহুরী প্রজেক্ট এলাকার সব কয়টি রেগুলেটর খুলে দেওয়া হয়েছে। তবুও পানির চাপে বিভিন্ন সড়ক সহ স্থানীয়দের অধিকাংশ ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়ে পড়ছে।

ফেনী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার হাওলাদার মো: ফজলুর রহমান বলেন, জেলায় চার লাখ গ্রাহকের মধ্যে তিন লাখের বেশি বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। ভারী বৃষ্টিতে বিভিন্ন এলাকার লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।বুধবার রাতে জেলার সোনাগাজী ও দাগনভূঞা উপজেলার কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ স্বাভাবিক ছিল।

ফেনী বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী হোসেন মাহমুদ শামীম ফরহাদ বলেন, আমাদের প্রায় ৭০ শতাংশ গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। শহরের বিভিন্ন এলাকার ভবনগুলোর নিচ তলায় পানি ঢুকে মিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে,যার কারণে পানি নামা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ থাকবে। বন্যার পানি কমার আগে সংযোগ স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আবুল কাশেম  বলেন, মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনীয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ২৭টি ভাঙা অংশ দিয়ে হু-হু করে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। নদীর পানি বিপৎসীমার ৯৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত বন্যায় ভেঙে যাওয়া ২৬টির সঙ্গে এবার নতুন করে আরও একটি বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় ঠিকভাবে উদ্ধার কাজও করা যাচ্ছে না। এখনো বৃষ্টির সঙ্গে পানি বাড়ছে।

ফেনী জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার  বলেন, বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি কোস্টগার্ড, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস ও স্বেচ্ছাসেবীরা কাজ করছে। তবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় কতজনকে উদ্ধার করা হয়েছে বা কোন এলাকায় কতজন প্রাণহানি ও কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে তার কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না। প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছু এলাকায় শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। পানির তীব্র স্রোতের কারণে কোথাও যাওয়া যাচ্ছে না।

প্রসঙ্গত,এর আগেও ভারী বর্ষণ ও ভারতীয় পাহাড়ি ঢলে চলতি বছরের ২ জুলাই প্রথমবার ও ২ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় ফেনীর মুহুরী নদীর  বেঁড়িবাধের ১৭টি স্থানে ভাঙনের ফলে জেলার ফুলগাজী পরশুরাম উপজেলার অধিকাংশ পরিবার পানিবন্দি হয়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বিআরইউ