বিগত দুই বছর মহামারি করোনা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ঘরছাড়া মানুষের আপন নীড়ের ঈদযাত্রায়। ইচ্ছে থাকলেও অনেকে নাড়ির টানে যেতে পারেননি গ্রামের বাড়ি ঈদ কাটাতে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতসহ প্রত্যেকের কর্মক্ষেত্র থেকে ছুটি পেলেও স্ত্রী, পুত্র, কন্যাকে নিয়ে একপ্রকার বাধ্য হয়েই ঈদ কাটাতে হয়েছে এই যান্ত্রিক শহরে।
তাই এবার সব বাধা উপেক্ষা করে মা মাটির সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে উদগ্রীব হয়ে পড়েছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা মানুষেরা। কিন্তু প্রতিবছরই দেখা যায়, ঘরমুখো অতিরিক্ত যাত্রীদের চাপে সড়কে গণপরিবহন ও নদীতে লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটে। চাপ সামলাতে না পেরে নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি গাড়ি উঠানোর ফলে মাঝপথে ফেরিডুবির ঘটনায় শতশত মানুষ মারা যায়। এমন ঘটনা বিরল নয়। যা রোজা কিংবা কোরবানির ঈদ আসলেই দেখা যায়।
আর এসব দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাওয়ার পরে তদন্ত করে বলা হয় ফেরির ফিটনেস কিংবা লঞ্চে অদক্ষ চালকের কথা। তবে তাদের এই গতানুগতিক রিপোর্টে আর ফিরে আসে না হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো। প্রতিবছরই ঘরে ফেরা হয় না এমন বহু মানুষের। তা ছাড়া দেখা যায়, যানজটের কবল থেকে রেহাই না পেয়ে স্বল্পপাল্লার গাড়িতে চড়ে ফেরি বা লঞ্চের পরিবর্তে স্পিডবোটে পার হয় অনেক যাত্রী। দ্রুততার সঙ্গে নদী পাড়ি দিতেই মূলত তারা এই পদ্ধতি অবলম্বন করেন।
কিন্তু সামপ্রতিক একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, নদীতে ডুবে মারা যাওয়ার বড় একাংশ এই স্পিডবোট দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। এ জন্য এসব দুর্ঘটনা ঘটার আগেই কর্তৃপক্ষকে আরও বেশি দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। ছোট ছোট এ বিষয়গুলো নজরে না আনলে কোনোভাবেই অপ্রত্যাশিত এই দুর্ঘটনা বা মৃত্যুর সংখ্যা কমানো সম্ভব হবে না। ঈদে বাড়ি ফেরা নিয়ে প্রতিবছরই থাকে নানা বিড়ম্বনা। আর এ দুর্ভোগের সবচেয়ে বড় কারণ হলো টিকিটের দুষ্প্রাপ্যতা। মানুষ আপ্রাণ চেষ্টা করে টিকিটের জন্য। কেউ পায় কেউ পায় না। যাত্রীদের বাস, রেল, লঞ্চ সর্বত্র চলছে টিকিট কালো বাজারির ত্রাস। টিকিটের জন্য সর্বত্র এখন যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধের জন্য ভোর থেকে লাইন দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না সেই বহু কাঙ্ক্ষিত টিকিট। ব্যর্থ হয়েই অনেকে ফিরে আসেন।
এবারের ঈদে পূর্বের সেই পুনরাবৃত্তি যেন না হয় সেটাই সবার প্রত্যাশা। ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে অনেককে ঢাকায় বসবাস করতে হয়, যাদের সবারই কোনো না কোনো গ্রামে বা মফস্বল শহরে রয়েছে স্থায়ী বাড়ি। ঈদ উপলক্ষে বাড়িতে গিয়ে সবার সঙ্গে তারা ঈদের আনন্দ উপভোগ করবে-এটাই স্বাভাবিক। এই অদম্য বাসনা যেখানে সুরের ধারায় প্রবাহিত হওয়ার কথা, সেখানে মন থাকে সার্বক্ষণিক আতঙ্কে! বাড়িতে আসলেই সুস্থভাবে, নিরাপদভাবে যাওয়া সম্ভব হবে কি না? ছয় ঘণ্টার পথ কত ঘণ্টায় শেষ হবে? এ রকম অসংখ্য প্রশ্ন ভিড় করে মনে।
তবু আশা থাকে, যেভাবেই হোক যেতেই হবে। এই হলো ঘরমুখো মানুষের ঈদে ফেরার বাস্তবতা। প্রতি ঈদে নাড়ির টানে মানুষ বাড়ি ফেরে; ছুটে যায় নিজ বাড়িতে পরিবার-পরিজনের সান্নিধ্যে। কারণ বছর শেষে আনন্দের দিনটি সবাই একসঙ্গে ভাগাভাগি করে নেবে। আসন্ন ঈদুল আজহা উপলক্ষেও পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে মানুষ ছুটছে নিজ নিজ বাড়ির উদ্দেশে। কিন্তু শিকড়গামী মানুষের উদ্বিগ্ন মনে আশার সঞ্চার করতে এগিয়ে আসতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। আমাদের দেশের সড়কগুলো যেন হয়ে উঠছে এক একটি মৃত্যু ফাঁদ।
প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনার খবর আমরা পাচ্ছি। যত দিন যাচ্ছে আহত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশের যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম হলো সড়কপথ। অধিকাংশ মানুষ সড়কপথেই যাতায়াত করতে পছন্দ করেন। অবশ্য তাদের কাছে দ্বিতীয় কোনো পছন্দও নেই বলা চলে।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। যেখানে লোক সমাগম অন্য জেলা থেকে অনেক বেশি। ঢাকাই হচ্ছে মানুষের প্রাণকেন্দ্র। তাই ঢাকাকে ঘিরে লাখো মানুষের কর্ম জড়িত। এতে ঈদকে কেন্দ্র করে ঘরেফেরার মানুষের ঢল নামে সড়ক, নৌ ও রেলপথে। ঈদে প্রিয়জনের সাথে ঈদ উদযাপন করতে ছুটি পেয়ে নারীর টানে বাড়ি ফিরতে সকলে দৌড় আসে নিজ বাড়িতে। এদিকে রাস্তাঘাটের বেহাল দশা, অপর্যাপ্ত যানবাহন ও অদক্ষ গাড়িচালকের কারণে প্রতিবছর শুধু ঈদকে কেন্দ্র করে রেকর্ড সংখ্যাক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। যার দায় এড়িয়ে যান সবাই।
বাংলাদেশে নৌপথে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ ও লাখ লাখ টন পণ্য পরিবহন হলেও আজো গড়ে ওঠেনি আধুনিক নৌপরিবহন ব্যবস্থা। কিন্তু মুনাফার আশায় কোনো কোনো অসাধু মালিক নিজের চেষ্টায় রাজনীতিবিদ এবং সরকারের কিছু উচ্চপর্যায় অসাধু লোকের যোগসাজশে বিভিন্ন রুটে কিছু বিলাসবহুল লঞ্চ সার্ভিস চালু করলেও স্বাধীনতাপরবর্তী ৫০ বছরে প্রণীত হয়নি নৌপরিবহন নীতিমালা। এ কারণে সরকারি উদ্যোগে যাত্রীসেবার মান বাড়ানো কিংবা নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে কার্যকর ব্যবস্থা নেই। নৌযাত্রীদের জন্য এখনো চালু হয়নি দুর্ঘটনার ঝুঁকি কিংবা মৃত্যুবিমা।
অন্যদিকে সরকারের অদূরদর্শিতা ও উদাসীনতার সুযোগে দেশের প্রায় সব রুটেই বিপুলসংখ্যক ফিটনেসহীন ও রেজিস্ট্রেশনবিহীন লঞ্চ চলাচল করছে। সারাদেশে প্রায় ২০ হাজার নৌযান চলাচল করলেও বেআইনিভাবে চলাচলরত নৌযানের সংখ্যা অন্তত আট থেকে সাড়ে আট হাজার। ফলে নৌরুটে যাত্রীরা প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ও নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। বিশেষ করে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলগামী যাত্রীরা বেশি ঝুঁকির সম্মুখীন হয়ে থাকেন। বিগত বছরগুলোতে অনেকবার নৌরুট এবং সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জনসাধারণের আশা, আকাঙ্ক্ষা ও সাধ পূরণে যদি তাদের যাত্রাপথকে নিরাপদ করতে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাহলে হয়তো এমন বুকফাটা কান্না, লাশের মিছিল এবং স্বজনদের আহাজারি আমাদের দেখতে হতো না। কিন্তু কে শোনে কার কথা। আসলে যার স্বজন চলে যায় তিনিই কেবল হারানোর যন্ত্রণা কী তা উপলব্ধি করতে পারেন। সত্যি কথা বলতে কি, নিরাপত্তা বিধানে যারা যে অবস্থানে আছেন তারা তাদের সঠিক দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট নন বলেই এত দুর্ঘটনা। আমাদের সব ক্ষেত্রে দায়িত্বে গাফিলতির ভাব থেকেই যাচ্ছে।
সরকারের একার পক্ষে কোনো কিছুই মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। নিজ নিজ দায়িত্ব বোধ থেকে আমাদের এসব দুর্ঘটনা রোধে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসা উচিত। অথচ মুসলমানদের প্রধান দুটি ধর্মীয় উৎসবের একটি হচ্ছে ঈদুল ফিতর, অন্যটি ঈদুল আজহা। এ দুই উৎসবে রাজধানী ও অন্যান্য শহর থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ নাড়ির টানে পরিবার-পরিজনসহ গ্রামের উদ্দেশে যাত্রা করে। আসন্ন ঈদুল আজহাতেও এর ব্যতিক্রম হবে না।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রতি বছর ঈদ উৎসবের আগমুহূর্ত থেকেই ঘরমুখী মানুষের মনে নিরানন্দের সুর ধ্বনিত হতে দেখা যায়। টিকিট কালোবাজারি, যানজট, ছিনতাই-ডাকাতি ও চাঁদাবাজি, জাল নোট, সড়ক ও লঞ্চপথে দুর্ঘটনা এবং শ্রমিক অসন্তোষের কারণে রাস্তা অবরোধসহ বিভিন্ন ঘটনায় জনদুর্ভোগ চরমে ওঠে। অতীতের ঘটনা থেকে প্রমাণিত দেশের কোনো পথই ঘরমুখী মানুষের ঈদযাত্রার জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। সড়কপথ, নৌপথ, রেলপথ— ঈদের আগে কোথাও স্বস্তির কোনো চিত্র পরিলক্ষিত হয় না। নির্ঝঞ্ঝাট ও নিরাপদ ভ্রমণের প্রত্যাশা নিয়ে মানুষ টিকিটের জন্য বাস, লঞ্চ ও রেলস্টেশনে ভিড় জমায়। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের টিকিট পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়ে। মূলত অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের জন্য অবৈধ পন্থায় টিকিটের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে এ সময় মানুষকে উচ্চমূল্যে টিকিট কিনতে বাধ্য করা হয়।
ঈদের আগে এ ধরনের অনিয়ম-অব্যবস্থা মোটেই কাম্য নয়। আমাদের যে সামাজিক ঐক্য ও উৎসবের গৌরব হারানোর মুখোমুখি, এই গৌরব পুনরুদ্ধার করতে হলে গোটা মানব সভ্যতার পুনর্জাগরণ জরুরি, খুব জরুরি। যে কোনো উৎসবের অন্যতম দিক হচ্ছে সৌহার্দ্য-সমপ্রতি-মৈত্রীর সেতুবন্ধ আরও পোক্ত করা।
উৎসব আমাদের সেই পথই তৈরি করে দেয়। উৎসব মানেই তো মানুষে মানুষে মিলন মেলা। এই দুর্যোগকালে কামনা করি, মানুষের হূদয়ে মানুষের ছায়াই যেন বিরাজমান থাকে, উৎসব যেন প্রকৃতই মানবিক আবেগের আনন্দঘন যে সর্বজনীন আবেদন, তা আরও ছড়িয়ে দেয় সর্বত্র। শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, সব ক্ষেত্রেই মানবিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার ব্যাপক বিস্তার ঘটুক। আলো আসুক আঁধার কেটে। সত্য, সুন্দর শুভবোধের আপন চেতনা হোক প্রসারিত। জয় হোক মানুষের। দূর হোক অন্ধকার। নির্মূল হোক সব নেতিবাচকতা। উৎসব রূপ পাক সর্বজনীনতার। মানুষ যাতে পরিবার-পরিজন নিয়ে নির্বিঘ্নে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
এ লক্ষ্যে সবাই নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেন, এটাই প্রত্যাশা। অনেক সময় তড়িঘড়ি করে বাড়ি ফিরতে গিয়ে পথেঘাটেই যেন মৃত্যু না হয় সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। সব সময় মনে রাখতে হবে ‘সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য বেশি’। কারণ আপনার আমার একটু অসচেতনতার ফলেই শুধু আমরা পৃথিবী ছেড়ে চলে যাই না বরং পথে বসতে হয় আমাদের পরিবারকেও। হারিয়ে যায় আপনার আমার ছেলেমেয়ের হাসিমাখা মুখ। অপেক্ষায় থাকা বৃদ্ধ বাবা-মায়ের বুকফাঁটা আর্তনাদ সবকিছু ভেবেই আমাদের উচিত হবে নিজ জায়গা থেকে সচেতনতার সঙ্গে বাড়ি ফেরা।
সেক্ষেত্রে সময় বাঁচাতে লাফ দিয়ে পরিবহনে উঠা, অতিরিক্ত যাত্রীবাহী লঞ্চে যাত্রা করা, দ্রুত পার হতে স্পিডবোট ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। যাতে অনেক প্রতীক্ষার পরে আসা এই ঈদের যাত্রা আমাদের জন্য নিরাপদ হয়। সুস্থ, সুন্দরভাবে যেন পরিবারের সঙ্গে ঈদ আনন্দ উপভোগ করতে পারেন সেসব বিষয় মাথাই নিয়েই হোক আপনার এবারের ঈদযাত্রা। ঈদে বাড়ি ফেরা আনন্দের উপলক্ষ হলেও প্রতিবছর পথের নানা ভোগান্তি এবং প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার কারণে তা কোনো কোনো পরিবারের জন্য যেভাবে নিরানন্দ বয়ে আনে, সেটি দুর্ভাগ্যজনক।
পরিশেষে বলব, বছরে দুবার অনুষ্ঠিত ঈদে যাতে সবাই নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরতে পারে এবং উৎসব শেষে কর্মস্থলে যেতে পারে, সে জন্য দীর্ঘমেয়াদি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। বস্তুত সুষ্ঠু যানবাহন ব্যবস্থাপনা, সড়কে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা এবং বাড়তি আয়োজন গ্রহণের মাধ্যমে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় উৎসবকে সবার জন্যই আনন্দময় করে তোলা সম্ভব। সবার প্রতি থাকলো শুভ কামনা।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট