বিএসসি ডেন্টাল ডিগ্রী :  অপপ্রচার ও বাস্তবতার ব্যবচ্ছেদ

উত্তম কুমার  প্রকাশিত: জুলাই ৪, ২০২২, ০৪:৩০ পিএম

উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত বিএসসি ইন হেলথ/মেডিকেল টেকনলোজি ডেন্টাল ডিগ্রিটিকে কেবলমাত্র গোষ্ঠীস্বার্থে অপপ্রচারের উপাচার বা উপাদানে পরিনত করা হয়েছে। চিকিৎসা অনুষদের মাধ্যমে প্রদত্ত ডিগ্রিটাকে স্বার্থের দ্বন্দ্বে এমনসব কুৎসার মধ্যে ফেলে দেয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে তাতে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করা কঠিন কিছু নয়। অথচ ডেন্টাল পেশার এসকল গ্র্যাজুয়েটদের নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) আইনে নিবন্ধিত করে জনগনের স্বা¯থ্য সুরক্ষায় অনায়াসে কাজে লাগানো যায়।

একটি পুরাতন প্রবাদ আছে, একটি নতুন বিশ্বাসকে মনে ঠাঁই দেয়া যতটা কঠিন তার চেয়ে আরোও কঠিন পুরোনো বিশ্বাসকে মন থেকে মুছে ফেলা। বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার বাস্তবতা ব্যবচ্ছেদ করলে দেখা যায়, এখানে যেসব জনবল স্বাস্থ্য সেবার মূল ভূমিকায় অবতীর্ণ রয়েছেন তাঁরা হলেন চিকিৎসক, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্টগণ এছাড়াও বিভিন্ন সহযোগিগণ। যদিও ডাক্তার ব্যতিরেকে বাকি জনবলের সামাজিক ও পেশাগত অবস্থান খাতাকলমে ওপরে হলেও বাস্তবে অত্যন্ত নাজুক।

দেশে বিএমডিসি নিবন্ধন প্রাপ্ত এমবিবিএস চিকিৎসকের সংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ পাশাপাশি ডিপ্লোমা চিকিৎসা সহকারী ২০ হাজারের বেশি, কমিউনিটি প্যারামেডিক ৩ হাজার। দেশে বিএমডিসি স্বীকৃত দন্ত চিকিৎসক বিডিএস এর সংখ্যা ১১৩৫০ জন। ১৯ কোটিরও বেশি জনবহুল এ দেশের দন্তচিকিৎসক এর সাথে জনসংখ্যার তুলনামূলক স্টাডি করলে খুব সহজেই অনুমেয় বিডিএস এর সংখ্যা জনসংখ্যার অনুপাতে নিতান্তই অপ্রতুল। এ অপ্রতুলতার শুরুটা বেশ পুরোনো যার ফলশ্রুতিতে হাজার হাজার প্রশিক্ষনবিহীন হাতুড়ে দাঁতের ডাক্তার তৈরীর প্রেক্ষাপট  উন্মোচিত হয়েছিল এবং সমাজের চাহিদা চিন্তা করে তাদেরকে একসময় বিএমডিসির স্বীকৃতিও দেয়া হয়েছিল।

দন্ত চিকিৎসা একটি শল্য চিকিৎসা এবং নিঃসন্দেহে ব্যয়বহুল। ৭৬ শতাংশ গ্রামীন জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশের নিকট এ চিকিৎসা ব্যয়ভার বহন করা দূরুহ এবং দুঃসাধ্যও বটে। অনেক ক্ষেত্রে ব্যয়ের বিষয়টি অতিরিক্ত মনে করে সাধারণ মানুষ সঠিক চিকিৎসা নিতে আগ্রহ হারায় শুধু তা-ই নয় দন্ত রোগ থেকে মুক্তির জন্য দাঁত ফেলে দিতেই তারা উৎসাহী থাকেন।

দেশে অদ্যবধি প্রশিক্ষণবিহীন হাতুড়ে জনগোষ্ঠীর দৌড়াত্ব তো কমেইনি বরং প্রশাসনের  উদাসীনতায় তা বেড়েই চলেছে  কিন্তু প্রশাসন বা যাঁরা বিএসসি ডেন্টাল ডিগ্রিধারীদের বিরুদ্ধে সারাদিন সরব থাকেন, হাতুড়ে বিষয়ে তাঁরা মুখে কুলুপ এঁটেছেন। প্র্যাকটিস ফিল্ডে আমরা বিডিএসদের প্রতিযোগী না হয়েও আমাদের প্রতিযোগি বানানো হচ্ছে। একজন ডিপ্লোমাধারী কিংবা বিএসসি ডেন্টাল গ্র্যাজুয়েটদের নিকট সাধারণ মানুষ চিকিৎসার জন্য শরণাপন্ন হলে তাঁরা প্রাথমিক সেবা দিয়ে থাকেন এবং এ কাজটি করে থাকেন পঠিত বিদ্যা, প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা থেকে। 

যেখানে, বিদ্যমান  আইনের ধারা ১৫ অনুযায়ী বাংলাদেশে অবস্থিত বা বাংলাদেশের বাহিরে অবস্থিত কোন মেডিকেল প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত তিন বছরের কম নয় এমন সময়ব্যাপী মেডিকেল চিকিৎসা প্রশিক্ষন সমাপ্তির পর উক্ত মেডিকেল চিকিৎসা ডিপ্লোমাধারী এ আইনের অধীন কাউন্সিল কর্তৃক নিবন্ধিত হওয়ার যোগ্য হয়ে থাকে এবং শুধুমাত্র এসএসসি পাসের পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদ থেকে মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট বিষয়ে ৩/৪ বছর কোর্স সম্পন্ন করে বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল থেকে প্রাইভেট প্র্যাক্টিস রেজিষ্ট্রেশন সনদ প্রাপ্তির মাধ্যমে বৈধভাবে ৪৫ ধরনের ওষধ প্রেসক্্রাইব করাসহ মেডিসিন, সার্জারী ও মিডওয়াইফারী প্র্যাকটিস করতে পারেন সেখানে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ বছর মেয়াদী পেশাগত ডেন্টাল ডিগ্রী, দন্তচিকিৎসা বিষয়ক ক্লিনিক্যাল বিষয়ে (১৯২০ ঘন্টা তত্ত্বীয় ও ১৬১০ ঘন্টা ব্যবহারিক) পড়াশোনা করে এবং এক বছর ইনকোর্স ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে ডায়াগনসিস, কনজারভেটিভ, সার্জারি, প্রস্থডোন্টিক, অর্থডোন্টিক ও চিলড্রেন ডেন্টিস্ট্রিসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে সরাসরি প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেও এমনকি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সরকারিভাবে কোর্সটি অনুমোদনের সময় কোর্সটিকে বিএমডিসি’র অধিভূক্তি ও শর্তসমূহ প্রতিপালনের জন্য নির্দেশনা প্রদান করলেও কোর্সটিকে অনুমোদনে বিএমডিসি কর্তৃপক্ষ কোনরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বিএমডিসি কর্তৃপক্ষ ডিগ্রীটিকে তফসিলভূক্ত করে নিবন্ধন প্রদান না করা কেবল স্বার্থান্বেষী মহলের প্রভাবে বা প্ররোচনায় নানা অজুহাত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এ ডিগ্রীধারী গ্রাজুয়েটগণকে প্রাপ্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করার চলমান প্রচেষ্টার অংশ্ ।

"এক্সপার্ট কমিটি অন ডেন্টাল অক্সিলারী অব ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন" এর মতামত অনুযায়ী একজন ডেন্টাল এ্যাসিসটেন্ট এর একাডেমিক যোগ্যতা টুয়েলভ গ্রেডের পর ৬ মাস থেকে ১/২ বছর মেয়াদি প্রশিক্ষণ অপরদিকে ডেন্টাল হাইজিনিস্ট বা ল্যাবরেটরী টেকনিশিয়ান হিসেবে কোর্সের মেয়াদ, পঠিত বিষয় এবং প্রশিক্ষণ সম্পূর্ণ আলাদা।

ডেন্টাল সোসাইটির নেতৃবৃন্দ কিংবা ডিগ্রিধারীগন ঠিকঠাক ঠাওর করতে পারেন না বিএসসি ডেন্টাল ডিগ্রীধারীদের ঠিক কি বলে ডাকা যায় বা ছোট করা যায়। বিএসসি ডেন্টাল ডিগ্রীধারী গ্র্যাজুয়েটদের তাঁরা এক সময় বলেন তাদের সহকারী এক সময় টেকনিশিয়ান। প্রায়শই বলতে শোনা যায়, বিএসসি ডেন্টাল ডিগ্রিধারীদের বা ডিপ্লোমাধারীদের নিকট চিকিৎসা করানোর কারনে নানাবিধ রোগ সৃষ্টি হচ্ছে কিংবা ক্যান্সার সৃষ্টি হচ্ছে । মজার ব্যাপার হলো, বিশ্বায়নের এ যুগে তথ্য উপাত্ত না দিয়ে, রিসার্চ ফাইন্ডিংস না দিয়ে কিংবা কোন গবেষণালব্ধ ফলাফলবিহীন এসকল তথ্য নিতান্তই ভিত্তিহীন। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই তবে তা হাতুড়ে ডাক্তারের মাধ্যমেই সম্ভব কেননা বিএসসি ডেন্টাল ডিগ্রিধারীদের বা ডিপ্লোমাধারীদের জীবানুমুক্তকরন প্রক্রিয়া সম্পর্কে সম্যক পড়াশোনা রয়েছে।

ওরাল ক্যান্সার সহ জঠিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার যে তথ্য দেয়া হয় তার কোন যৌক্তিক ভিত্তি নেই বরং এসব কথা চিলে কান নেয়ার মত। দাঁতের ব্যথার মত তীব্রতর ব্যথায় আক্রান্ত রোগীকে প্রাথমিক সেবা দিয়ে সুস্থ করা এবং সমস্যা বেশি মনে হলে তাদের বড় কোন সার্জনের নিকট রেফার্ড করা হয় আর এ শিক্ষা মূলত প্রাপ্ত একাডেমিক শিক্ষারই অংশ। 

বলাবাহুল্য কেউ কেউ স্বভাবজাতভাবে রোগ ধরে রাখেন অনেকেই চিকিৎসা ভীতি ও ব্যয়ের কারনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ফার্মেসি থেকে ঔষধ কিনে ইচ্ছামাফিক সেবন করে ব্যথা প্রশমন করেন। নিয়মমাফিক ঔষধ না খাওয়ার কারনে এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেসিস্টেন্স এবং লিভার কিডনি বিকলসহ আরো নানাবিধ ঘটনা ঘটছে এগুলো কেবল আলোচনায় সীমাবদ্ধ।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া কেউ চিকিৎসা সেবাদান করলে সাধারণ ভাষায় তাদের কোয়াক বলা হয়। বিএমডিসির সর্বশেষ সংশোধনী ২০১০ এর আগে যে আইন দ্বারা বিএমডিসি দন্ত চিকিৎসকদের স্বীকৃতি দিতো তাদের একটা শ্রেণী ছিলো কোয়াক। ১৯৮০ আইনের ১৫ ধারার উপধারা ৩ ধারা অনুযায়ী কোন প্রকার একাডেমিক প্রশিক্ষণ ছাড়া কোন একজন ডেন্টাল সার্জনের অধীনে পাঁচ বছর সময়ব্যাপি একজন মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি"রেজিস্টার্ড ডেন্টিস্ট বা অনুমোদিত দন্ত চিকিৎসক" হওয়ার যোগ্য হতেন। অথচ কোয়াকদের রেজিস্টার্ড বানানো বিএমডিসি রাতারাতি তাদের জাতে উঠাতে ডেন্টাল গ্র্যাজুয়েটদের বলির পাঁঠা বানাচ্ছে যা অত্যন্ত হাস্যকর এবং বিএমডিসি কর্তৃপক্ষের গোয়ার্তুমি মূলত গোষ্ঠীর স্বার্থে বা নেপোটিজম বৈকি।

দেশের প্রতিটি উপজেলা, জেলা হাসপাতালে দন্ত চিকিৎসক এর সংখ্যা একজন করে। শুধু তা-ই নয় সরকারি হাসপাতালে দন্তচিকিৎসা সেবার মান কেমন তা বলাবাহুল্য। বেসরকারিভাবে ব্যয়বহুল এবং সরকারি অপ্রতুলতা থেকে নিরুপায় মানুষের খানিক স্বস্তির জায়গাটাতে স্বল্পমূল্যে সঠিক চিকিৎসাসেবা সন্ধান করেন ।

দেশে বিদ্যমান হাজার হাজার কোয়াক বহাল তবিয়তে অপচিকিৎসা চালিয়ে গেলেও বিএমডিসি কর্তৃপক্ষের কোন কার্যকর পদক্ষেপ পরিলক্ষিত না হলেও  দন্ত চিকিৎসা বিদ্যায় শিক্ষিত বিএসসি ডেন্টাল ডিগ্রিধারী ডেন্টিস্টগণ প্রশংসিত হওয়ার পরিবর্তে তা না হয়ে একটি গোষ্ঠীর অন্যায় আবদারে সায় দিয়ে বিএসসি ডেন্টাল ডিগ্রিধারদের পেশাচর্চা বন্ধে মরিয়া বিএমডিসি। একটি গোষ্ঠীর স্বার্থকে একচেটিয়া বজায় রাখতেই ডিপ্লোমা ও বিএসসি ডিগ্রি প্রাপ্তদের স্বীকৃতির বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে তা সহজেই অনুমেয়। একটি সমশিক্ষিত গোষ্ঠীকে মোটাদাগে কোয়াক বলে অবিহিত করা ডেন্টাল সোসাইটির অপকৌশলের অংশমাত্র আর তার অপপ্রয়োগ করে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ানোই লক্ষ্য উদ্দেশ্য। 

সাধারন জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা, শিক্ষিত একটি গোষ্ঠীর কর্মক্ষেত্রের কথা সর্বোপরি রাষ্ট্রের কল্যানের কথা চিন্তা না করে গোষ্ঠীগত স্বার্থ হাসিলে ব্যস্ত একদল লোক ডেন্টাল পেশায় নিজেদের রামরাজত্ব কায়েমে ব্যতিব্যস্ত। প্রশাসনের উদাসীনতায় ও আইনি অযুহাতে বিএমডিসি কর্তৃক বিএসসি ডেন্টাল ডিগ্রিধারদের প্রাপ্য অধিকার বঞ্চিত করার দূরভিষন্ধিমূলক অপচেষ্টা এর অবসান এখন সময়ের দাবী ।

লেখক: উত্তম কুমার 

পরিচিতি:মহাসচিব ,বিএসসি ডেন্টাল অ্যাসোসিয়েশন।

আরইউ