শিশুর বয়স কমালে কি অপরাধ কমবে

মো. তানজিমুল ইসলাম প্রকাশিত: জুলাই ৬, ২০২২, ০২:৫৫ পিএম

মানুষের জন্য যেমন মানবাধিকার, ঠিক তেমনি শিশুদের সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য শিশু অধিকার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। আজকের শিশু আগামী দিনের কর্ণধার। শিশুরা যাতে সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে পারে, এ জন্য আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ (ইউএনসিআরসি) শিশুদের একটি নির্দিষ্ট বয়স নির্ধারণ করেছে। শূন্য থেকে ১৮ বছরের কম বয়সি সব মানব সন্তানই শিশু। 

বাংলাদেশসহ মোট ১৯১টি রাষ্ট্র এই সনদে উল্লিখিত নীতিসমূহের প্রতি একমত পোষণ করে স্বাক্ষর প্রদান করে। ৩০ বছর ধরে এই সনদকে স্বাক্ষরকারী সব রাষ্ট্র সমানভাবে মেনে চলছে। অর্থাৎ শিশুর কল্যাণের কথা বিবেচনা করেই এটিকে সার্বজনীন করা হয়েছে। আমরা প্রত্যেকেই জানি ও মানি, শিশুরা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। 

তাই পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সবারই উচিত তাদের বাড়তি যত্ন নেয়া। জনস্বাস্থ্যের তথ্য অনুযায়ী আমরা প্রত্যেকে বিশ্বাস করি, যে জাতি শিশুদের নিয়ে যত বেশি মনোযোগী সে জাতির তত বেশি সার্বিক উন্নয়নে অগ্রসর হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। সুতরাং ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের বিশেষ করে বয়সটিকে কেন অনেক গুরুত্ব দিতে হবে তা আমরা প্রত্যেকেই কম বেশি অনুধাবন করতে পারি। শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ বিবেচনা, বৈষম্যহীনতা, শিশু বেঁচে থাকা ও পরিবেশ, শিশুর অংশগ্রহন ও জবাবদিহিতা ইত্যাদি শিশু অধিকার সনদের মূলনীতি। যেহেতু শিশুর কল্যাণার্থে উক্ত বিষয়গুলোর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, তাহলে বুঝতে হবে, শিশুদের জন্য এসবের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। 

অন্যভাবে বলা যায়, যেহেতু ১৮ বছর বয়সের আগে কোনো মানব সন্তান পূর্ণভাবে বিকশিত হতে পারে না অথবা কল্পনার রঙিন জগতে ভেসে বেড়ায় তাই তাদের লালন-পালন করার জন্য বড়দের পূর্ণ সহযোগিতার কোনো বিকল্প নেই। চিকিৎসাবিদ ও মনোবিজ্ঞানীদের মতে, শিশুরা অনেক বেশি অনুকরণপ্রিয়। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র থেকে তারা প্রতিনিয়ত শেখে; সেটি ভালো কিংবা মন্দ যাই হোক না কেন। এক পর্যায়ে এই শেখাটি তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়।

সমপ্রতি টেলিভিশন, সংবাদমাধ্যমে সরকার তথা অনেক বিজ্ঞজনদের বলতে শোনা যায়, দেশে শিশু অপরাধের সংখ্যা বেড়েছে, তাই শিশুদের বয়স ১৮ বছরের কম করার চিন্তাভাবনা চলছে। বিষয়টি অত্যন্ত ভাবাচ্ছে প্রায় প্রতিটি মহলকে। আসলেই কি শিশু অপরাধ বেড়ে গেছে নাকি শিশুদের দ্বারা বড়রা অপরাধকর্ম ঘটাচ্ছে? তাছড়া শিশু অপরাধের মূল কারণ কি আসলে শিশুরা নাকি শিশুর পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও অবস্থান? 

যদি সত্যিই শিশু অপরাধের সংখ্যা বেড়ে যায়, তবে এর নেপথ্যের কারণসমূহ বিবেচনা করার সঠিক সময় এক্ষুণি। শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ বিবেচনায় ১৯৭৪ সালে শিশু আইন প্রণীত হয়। এছাড়া বাংলাদেশের সংবিধান, আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা (আইএলও) এবং বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ও ফৌজদারি কার্যবিধিতেও শিশুদের স্বার্থরক্ষায় বিভিন্ন আইন রয়েছে। 

উল্লেখ্য শিশু আইন ১৯৭৪ একদিকে যেমন শিশু স্বার্থ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে, পাশাপাশি অপরাধী শিশুদের জন্য নমনীয় এবং সংশোধনমূলক বিচারব্যবস্থার বিধানও নিশ্চিত করেছে। সমপ্রতি সরকার শিশু আইন সংশোধনের জন্য আইনমন্ত্রীকে উদ্যোগ নিতে বলেছে। জনৈক মন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, কিশোর গ্যাংসহ বর্তমানে যেসব সমস্যা লক্ষ করা যাচ্ছে, তাতে মনে হয়েছে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আইনের সংশোধন হওয়া উচিত। 

আমাদের মতো উন্নয়নকর্মী মানুষদের প্রশ্ন হলো— আইনের সংশোধন হলেই কি অপরাধ প্রবণতা কমে যাবে রাতারাতি? সমপ্রতি শিশু-কিশোর কর্তৃক যে অপরাধ সংগঠিত হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে, ঐ শিশু-কিশোরই নয় বরং পুরো পারিবারিক ও সামাজিক ব্যবস্থাই দায়ী। শিশু বয়সে শিশুদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি না হওয়া একটি অন্যতম কারণ বটেৎ। যদি পারিবারিক, পারিপার্শ্বিক বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় কোনো ঘাটতি থাকে অথবা অপ্রত্যাশিত অপশিক্ষা দেয়া হয় তবে সেসব শিশু-কিশোর কালক্রমে নষ্ট হয়ে যায়। 

শিশুর বয়স কমানো নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জনৈক মন্ত্রী শিশুর সর্বোচ্চ বয়স ১৪ বছর করা যেতে পারে বলে মত প্রকাশ করেন। অপরাধীরা যাতে বয়স কম বলে ছাড় পেয়ে না যায় তাই এমন ভাবনা ভাবছেন বৈকি। পক্ষান্তরে শিশুর বয়স কমানো হলে অকালপক্বতার সম্ভাবনাটি কি বেড়ে যায় না? সরকার কর্তৃক শিশুর বয়স ১৮ বছর পর্যন্ত নির্ধারিত হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৭-১৮ (বিডিএইচএস) অনুযায়ী, ১৮ বছরের আগেই দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। 

২০১৪ সালেও এমনটাই দেখা গিয়েছিল (বাল্যবিয়ের প্রবণতা বুঝতে ২০ থেকে ২৪ বছরের বিবাহিত নারীদের বিয়ের বয়স দেখা হয়েছে)। আর যখন শিশুর বয়সের মাত্রাটি কমে আসবে তখন অবলীলায় সংঘটিত হবে অবাধে শিশুবিয়ে। অপরিণত বয়সে গর্ভধারণ করবে লাখ লাখ শিশু-কিশোরী। ভূমিষ্ট হবে অপরিপক্ব শিশু, মানে ঝুঁকিপূর্ণ জাতি। আমরা কি আদৌ এমন দেশকে পেতে চাই? অল্প বয়সে বিয়ের প্রবণতা বাড়ার সাথে সাথে দারিদ্র্যের কালগ্রাসে ছেয়ে যাবে পুরো দেশ। অল্প বয়সেই বার্ধক্য ফলশ্রুতিতে পূর্ণ যৌবন বয়সে পরকীয়ার নেশায় মত্ত হবে যুব সমাজ। 

আমাদের জেনে থাকা ভালো, শিশু হলো রাষ্ট্রীয় পোষ্য এবং রাষ্ট্র তার সর্বোত্তম স্বার্থরক্ষাকারী অভিভাবক। রাষ্ট্রের পিতৃসম অভিভাবকত্বকে ‘প্যারেনস পেট্রি’ বলা হয়। সঙ্গত কারণেই শিশুদের প্রতি স্বয়ং রাষ্ট্র যেখানে নমনীয়, সেখানে আপামর জনসাধারণের নৈতিক দায়িত্ব হলো শিশুদের সুন্দর পরিবেশে গড়ে তোলা। যে শিশুটি নিজ পরিবারে আদর-যত্ন-ভালোবাসা পায়নি ও নীতি-আদর্শে বেড়ে ওঠেনি, সে শিশুটি যদি অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণে জড়িত পড়ে, সেই দায় কি কেবলই ঐ শিশুর? রাষ্ট্রেরও কি দায় নেই এতটুকু? এক্ষেত্রে বয়স কমানো কোনো সমাধান হতে পারেনা বরং শিশুদের বয়স কমিয়ে আনা মানেই অল্প বয়সেই তাকে/তাদের অল্প বয়সেই ‘বড়’ হয়ে যাওয়ার স্বীকৃতি প্রদান করা ছাড়া আর কিছুই নয়। 

এতে ভবিষ্যতে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। আজ শিশুর বয়স কমানো নিয়ে যে শোরগোল চলছে, তার চেয়ে অনেক বেশি আলোচনা হওয়া উচিত ছিল কিভাবে, শিশুদের প্রতি নির্যাতন কমানো যায়? শিশু রাজন, ববিউল, ফেলানীদের প্রতি পৈশাচিক নির্যাতনের কথা এ দেশের সবাই জানে। কিন্তু যে নামগুলো মানুষ জানে না, সেসব বর্বরতার কাহিনী আরও ভয়ংকর! বাংলাদেশে প্রতিদিন শিশুরা কেমন শারীরিক-মানসিক-যৌন নির্যাতনের শিকার হয় তা এখন সবারই জানা। এর সঠিক কোনো তথ্য-উপাত্ত কোথাও সংরক্ষিত নেই, তাই অনুমান করে বুঝে নিতে হবে। 

তবে এটি সত্য দেশে উত্ত্যক্ত বা উৎপীড়নের রূপটি অত্যন্ত ভয়াবহ। আধুনিক যুগে শিশুদের উত্ত্যক্ত, হয়রানি প্রত্যেক দেশেই জাতীয় উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করেছে। যান্ত্রিক যুগে শিশু-কিশোরদের নিয়ে পরিবারের অস্তিত্ব মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। গতিশীল ও কর্মমুখর জীবনযাত্রার কারণে পিতা-মাতা উভয় কর্মজগতে তৎপর। তাই অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের কাছের আত্মীয় ও পরিচিতদের কাছেও শিশুরা নিরাপদ নয়। এভাবেই শিশুর মানসিক বিকাশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে এবং শিশু যেন এক অস্বাভাবিক মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠছে। শিশু-কিশোর অপরাধের সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন অপরাধ বিজ্ঞানীরা। 

যেমন মা-বাবা, দাদা-দাদির পর্যাপ্ত সংস্পর্শ না পাওয়া, ভালোবাসা না পাওয়া, পারিবারিক মূল্যবোধের অভাব, মা-বাবার অবৈধ কর্মসূচির সাক্ষী হওয়া, অসামাজিক গণমাধ্যমে অশ্লীল, নীল ছবি, অসামাজিক সঙ্গ ইত্যাদির কারণে শিশু-কিশোর অপরাধ বাড়ছে। দেশ যখন উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে, তখন শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠিত না করে বরং বয়স কমিয়ে শিশুদের আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলা কোনো সঠিক সমাধান হতে পারে না। 

উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে বিশ্বায়নের এই যুগে সবার সাথে তাল মিলিয়ে শিশুর সুন্দর আবাস গড়ার প্রত্যয় হোক আমাদের সবার। যার যার অবস্থান থেকে প্রতিটি শিশুর জন্য আমাদের স্বপ্ন হোক, জীবন তার পরিপূর্ণতায় ভরে উঠুক, আগামী দিনে যোগ্য মানুষ হয়ে সে যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে তার ইচ্ছার দৃঢ়তায়। 

লেখক : অ্যাডভোকেসি কো-অর্ডিনেটর, ওয়ার্ল্ড ভিশন