সময়ের পরিক্রমায় বদলে যায় অনেক কিছু। যোজন-বিয়োজনের ধারাপাতে এই অদল বদলই যেন নিত্য বাস্তবতা। চলমান স্বাভাবিকতার ঘাত-প্রতিঘাতে কোনকিছু যেমন অতল তলে হারিয়ে যায় আবার কোন কিছু রঙিন আলোকছটার পরশে মহিমান্বিত হয়ে ওঠে অহরহ। এসব কথা একদিকে যেমন ব্যক্তিজীবনে সত্য অন্যদিকে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে কোন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। তেমনি একটি সুপ্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম লাহিড়ী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়। ১৯২০ সালে যাত্রা শুরু করা এই প্রাচীন
বিদ্যাপীঠ যে প্রজ্জ্বলিত আলোর মশাল জ্বালিয়ে আলোকিত করেছিল অবহেলিত এই জনপদের পথ-প্রান্তর সেই আলোকছটার তেজ এতোটুকুও কমেনি আজ অবধি। বরং শতবর্ষ পরেও দীপ্তিময় বাতিঘরের মতো প্রতিনিয়ত উজ্জ্বীবিত ও উদ্ভাসিত হয়ে প্রাণিত করেছে হাজার-হাজার শিক্ষার্থীর মন ও মনন, গড়ে দিয়েছে ভূত-ভবিষ্যৎ, রণনে-অনুরণনে উদ্দিপ্ত করেছে শিক্ষা-সংস্কৃতি ও প্রগতির সড়কে এবং স্ব-উৎসরিত আলোকধারায় দৃশ্যমান আলোকবর্তিকার মতো বারবার জানান দিয়েছে নিজের সাফল্যমন্ডিত অস্তিত্ব। এই হলো আমাদের প্রাণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লাহিড়ী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়। গেল ২০২০ সালে শতবর্ষ পার করে আবার শতায়ুর পথে যাত্রা শুরু করেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তদানীন্তনকালে বালিয়াডাঙ্গী-লাহিড়ী জনপদে তেমন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিলনা। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডী পেরিয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করার জন্য আগ্রহী শিক্ষার্থীদের ছুটতে হতো ঠাকুরগাঁও শহরে অবস্থিত ঠাকুরগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ে(বর্তমানে ঠাকুরগাঁও জিলা স্কুল)। ফলে দেখা যেতো শুধুমাত্র স্বচ্ছল ও সম্ভ্রান্ত ঘরের সন্তানরাই এই সুযোগ পেতো কিন্তু অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীরা এই শিক্ষালাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে প্রাথমিক স্তরেই শিক্ষাজীবন শেষ করতো। এসব মানবিক দিক ও এলাকার শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক উন্নতির কথা বিবেচনা করে লাহিড়ী ও তৎসংলগ্ন এলাকার কিছু শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন লাহিড়ী এম.ই
স্কুল।
পরবর্তীতে দেশভাগের পর এটি এম,ই থেকে নিম্ন-মাধ্যমিক এবং পরবর্তীতে মাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে রুপলাভ করে। এই স্কুলের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে পরবর্তী বিভিন্ন ধাপে যারা নানাভাবে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছিলেন তাদের মধ্যে বাবু শ্যামাপ্রসাদ রায়, মৌলভী তমিজউদ্দিন আহাম্মেদ, ভবানীচরণ চ্যাটার্জী, ভবেশচন্দ্র সিংহ, ডাঃ দেরেম আলী, ডাঃ ইদ্রিস আলী, ডাঃ ওসমান গণি ও নাজমুল হকের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাণভোমরা হলো মূলতঃ শিক্ষার্থীরা। এই শিক্ষার্থীদের ওপর আলোকসম্পাত করে কাঁদা-মাটির আদলে গড়িয়ে-পড়িয়ে যারা যোগ্য করে তোলেন, মানুষ হওয়ার মন্ত্রে দীক্ষিত করে পাঠিয়ে দেন পরবর্তী জীবন যুদ্ধে; তারা হলেন কারিগররুপী মহান শিক্ষকবৃন্দ। এসব মহান শিক্ষকদের কারণেই লাহিড়ী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় দীপ্তিমান সূর্যের মতো তার দ্যুতি ছড়িয়ে যাচ্ছে আজও। এই মহান শিক্ষকদের বদৌলতেই এই স্কুলের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময়ে অলংকৃত করেছেন সরকারী-বেসরকারী চাকুরির বড় পদ, হয়েছেন খ্যাতিমান সংসদ সদস্য, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সমাজসেবক কিংবা শিক্ষকতার মতো মহান পেশাকে বেছে নিয়ে মুখ উজ্জ্বল করেছেন এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের।
খুব সম্ভবত সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় প্রিয় স্যারদের নিয়ে যে ছড়াটি লিখেছিলাম তার দ্বিতীয় স্তবকটি ছিল এরকম-“এই স্কুলের সব স্যারেরা/পাঠদানে খুব পাকা/তাঁদের চোখে মোদের নিয়ে/হাজার স্বপ্ন আঁকা”। সত্যিই শ্রদ্ধেয় স্যারদের চোখের মণিতে তাঁদের শিক্ষার্থীদের নিয়ে হাজারো স্বপ্নের পসরা ছিল। সুনিপুন দক্ষতায় ¯স্নেহ-মায়া-মমতা ও শাসন-বারনের মাধ্যমে স্বপ্ন বুননের যে পথ তাঁরা দেখিয়ে ছিলেন তেমনি স্বপ্ন বাস্তবায়নের সিঁড়ি বাইতেও ভীষণ অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন নিঃস্বার্থভাবে।
এই লেখা লিখতে গিয়ে পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে চাই প্রয়াত প্রধান শিক্ষক হেরাসউদ্দিন আহমেদ স্যারের কথা। অসম্ভব প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা আর ভীষণ রাশভারী এই মানুষটি ছিলেন অসীম জ্ঞানের অধিকারী। শুধু স্কুলের চৌহদ্দিতেই নয় বরং তাঁর প্রগাঢ় ব্যক্তিত্বের সৌরভ ছড়িয়ে পড়েছিল জেলার সর্বত্র। এলাকার সর্বস্তরের মানুষ তাঁকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। লাহিড়ী স্কুলের যে বর্তমান কলেবর, যে অবস্থান ও সুনাম সেই কৃতিত্বের অন্যতম অংশীদার হলেন হেরাসউদ্দিন আহমেদ স্যার, একথা জোর দিয়েই বলতে হবে। তার পূর্বে ও সমসাময়িক যে শিক্ষকরা শিক্ষার আলো ছড়িয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন তাঁরা হলেন প্রয়াত এ্যাডভোকেট ভবানী চরণ চ্যাটার্জী, এ্যাডভোকেট ওয়ালিউর রহমান, সাবেক অতিরিক্ত সচিব শামসুজ্জোহা, আনিসুর রহমান বিএসসি, এ্যাডভোকেট ইকবাল, হায়দার আলী, সেরাজুল হক, শেখ ফরজন আলী, মজিদুল হক, রবীন্দ্রনাথ চ্যাটার্জী, তাজিমউদ্দিন বিএসসি, শামসুজ্জোহা ও জালালউদ্দিন দুলু প্রমুখ। এখন যারা জীবিত আছেন তাদের মধ্যে হাফিজউদ্দিন আহমেদ, সাইফুল্লাহ কলম, আশুতোষনাথ, সুকুমার নাথ ও মৌলভী স্যারের কথা খুব মনে পড়ে। প্রয়াত মজিদুল স্যারের বিখ্যাত ডায়লগ-“ডোন্ট টক”, হাফিজউদ্দিন স্যারের-“নো দাইসেল্ফ” ও আশুতোষ স্যারের পড়া না পারলে সেই বিখ্যাত ডায়ালগ-“এ তো দেখছি জঙ্গল থেকে এসেছে, জঙ্গলিয়ারে” আজও ভুলিনি।
আশুতোষ স্যার একজন সব্যসাচী শিক্ষক ছিলেন। তিনি বাংলা সাহিত্য, বাংলা ব্যাকরণ ও ইংরেজি গ্র্রামার তিন বিষয়েই সমান পারদর্শী ছিলেন। নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় স্যার যখন ছুটি গল্পটি পড়াচ্ছিলেন তখনকার একটি দৃশ্য আজও মনে পড়ে। গল্পটি পড়ানোর সময় স্যার কখনো ফটিক হচ্ছেন তো কখনো ফটিকের মামা হচ্ছেন। প্রতিটি চরিত্রের সংলাপের সাথে স্যারের কন্ঠ-স্বরের ওঠানামা খুব অবাক করতো আমাদেরকে। “মামা আমার ছুটি হয়েছে মামা, আমি বাড়ি যাচ্ছি”-ছুটি গল্পের এই শেষ লাইনটি পড়ানোর সময় স্যারের মায়া জড়ানো ছলছল চোখ দুটো আজও চোখে ভাসে। সেদিন ফটিকের শোকে
পুরো ক্লাস যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। এখানেই তো একজন শিক্ষকের শ্রেষ্ঠত্ব,অসীম স্বার্থকতা। এমন করেই ইংরেজি পড়াতেন হাফিজ উদ্দিন হাবু স্যার। তিনি ইংরেজীতে খুব দক্ষ ও ভীষণরকম শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষক ছিলেন। ক্লাসে পড়ানোর সময় মাঝে-মাঝে স্যারের বুয়েট পড়–য়া দুই ছেলে ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত মেয়ের সাফল্যের গল্প বলতেন। আমরা তন্ময় হয়ে স্যারের সেসব গল্প শুনতাম আর অনুপ্রাণিত হতাম। কলম স্যার জীববিজ্ঞান এমনভাবে পড়াতেন যে বাসায় গিয়ে খুব বেশি পড়ার প্রয়োজন হতোনা। স্যার সবসময় পরিপাটি আর ভীষণ স্মার্টলি চলাফেরা করতেন। তাঁর প্রখর ব্যাক্তিত্ববোধ
আমাদের মুগ্ধ করতো। তাজিমউদ্দিন স্যার পদার্থবিজ্ঞান পড়াতেন খুব সহজভাবে।খুব মনখোলা ও উদারচিত্তের মানুষ ছিলেন তিনি। সাধারণ গণিত ও উচ্চতর গণিতে সুকুমার স্যার ও জালাল স্যারের ছিল অসামান্য দক্ষতা। তাঁদের সহজসাধ্য পড়ানোর স্টাইলের কারণেই গণিতের ভীতি চিরতরে দূর হয়েছিল আমার মতো অনেকের। ভীষণরকম ভক্ত ছিলাম জালাল স্যারের। তাঁর শিশুসুলভ হাসিটা ভুলতে পারিনি আজও। মৌলভী স্যার(খলিল স্যার) ও ইব্রাহীম স্যার এখনও পড়িয়ে যাচ্ছেন। মৌলভী স্যারের পরিষ্কার ও শুদ্ধ বাচনভঙ্গী এখনো কানে বাজে। ইব্রাহীম স্যারও ভালো শিক্ষক ছিলেন। একজন শিক্ষক কেবল শ্রেণী কক্ষে পড়ান-ই না, তিনি একই সাথে তাঁর ছাত্রদের জন্য তৈরি করে দেন সুচিন্তার জগত। স্বপ্ন দেখান, দিক নির্দেশনা দেন ভবিষ্যতের পথ ও পাথেয় সর্ম্পকে। এভাবেই শিক্ষকরা হয়ে যান আমাদের বন্ধু,ফিলোসোফার, গাইড কিংবা অনুকরণীয় রোল মডেল। আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের কথা লিখতে গিয়ে মনে পড়ছে দুটি বিখ্যাত মুভি Dead Poets Society Ges Chalk & Duster এর কথা। শিক্ষকরা তাদের পড়ানোর স্টাইল,জীবনবোধের ধারণা ও দর্শন দিয়ে কীভাবে শিক্ষার্থীদের জীবন বদলে দেন তারই
প্রতিফলন ছিল মুভি দুটোতে। আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে অনেকে ছিলেন এরকম আর্দশের ধারক ও বাহক। পরিচ্ছন্ন জীবনবোধ ও প্রামাণিক মূল্যবোধ সমেত যে প্রগাঢ় ব্যাক্তিত্ববোধ তাঁরা ধারণ করতেন তাতে দারুণভাবে আন্দোলিত হতাম আমরা।
পূর্বসূরীদের মতো বর্তমান শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা এই স্কুলের সম্মান রক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বর্তমান প্রধান শিক্ষক জিল্লুর রহমান স্যারের কর্মদক্ষতা ও পরিশ্রমের কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই স্কুলের শিক্ষার্থীরা ভালো ফলাফল করে স্কুলটিকে আরো সামনের কাতারে নিয়ে এসেছে। শিক্ষার পাশাপাশি স্কুলের শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, বিতর্ক প্রতিযোগিতা,স্কাউটিং, বিভিন্ন সৃজনশীল ও সমাজসেবা মূলক কাজে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রেখে সবসময় সরব রেখেছে স্কুলের ধারাবাহিক সুনাম-সম্মান ও ঐতিহ্যকে। এই ধারাকে সামনে আরো বেগমান করতে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরকে আরো বেশী যত্মবান ও স্বপ্নবান হওয়ার সফল প্রয়াস চালাতে হবে, তবেই তিল-তিল
করে গড়ে ওঠা তিলোত্তমা এই বিদ্যাপীঠ পাড়ি দিতে পারবে আরও অনাগত
অযুতকাল। যে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য শতবর্ষের মাইফলক অতিক্রম একশ্লাঘণীয় অর্জন। আর এই অর্জন কেবল প্রতিষ্ঠানের চৌহদ্দিতেই সীমাবদ্ধ থাকেনা, তার সেই কৃতিত্বের দ্যুতি প্রাণিত করে দেশ ও সমাজের সকল কল্যাণযাত্রীকেই। এ বিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তি আমাদেরকেও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ধ্বজাতলে একনিষ্ঠ আলোর পথযাত্রী হতে। এই প্রিয় বিদ্যাপীঠ শতবর্ষ আগে আলোকের ঝর্ণাধারায় যে মঙ্গলদীপের শিখা জ্বালিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল সেই শিখার দ্যুতি উজ্জ্বল থেকে আরো উজ্জ্বলতর হোক। জয় লাহিড়ী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়।
(লেখকঃ সাবেক শিক্ষার্থী, লাহিড়ী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় (১৯৯৬-
২০০১) ও অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ,ঢাকা