মাঝ রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। মনে হল রাত ভোর হয়ে এসেছে। হাত বাড়িয়ে মোবাইল দেখলাম। রাত তিনটা বেজে দশ। বহুদিন পর রাত ১১ টায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙার পর খুব প্রশান্তি অনুভব করলাম। রাতের শেষ প্রহরের ঢাকা দেখতে বের হলাম। গলির মোড়ে এসে থেমে গেলাম। দূর থেকে ভেসে আসিছলো পার্থ বড়ুয়ার গান- ‘একলা ঘর/ধূলো জমা গীটার/পড়ে আছে লেলিন/পড়ে আছে শেক্সপিয়ার/টিশার্ট জিন্সগুলো দেরাজে আছে/শুধু মানুষটা তুই নেইতো, নেইরে কাছে/ও বন্ধু তোকে মিস করছি ভীষণ/ তোকে ছাড়া কিছুই আর জমেনা এখন। শুনতে শুনতে অজান্তেই চোখের কোনে গড়িয়ে পড়লো অশ্রুবিন্দু..... বেদনা, বিচ্ছেদে বন্ধুত্বের এমন মধুর বহিঃপ্রকাশ!
ছেলেবেলায় প্রথম যে মানুষটা চারদেয়ালের বাইরের পৃথিবীতে আপন হয়-তাকেই বলে বন্ধু। আবেগ, অনুভব অনুভূতির কথা নির্দ্ধিধায়, নির্ভাবনায়, নিঃসংকোচে যাকে বলা যায় সে-ই বন্ধু। কখনও যদি এমন কঠিন সময় আসে সবাই দূরে সরে যাচ্ছে, সেই দুঃসময়ে মুষ্টিমেয় যে কজন তখনও আঁকড়ে ধরে তারাই বন্ধু। তাই বলা যায় বন্ধু হাত বাড়িয়ে ছোঁয় না, মন বাড়িয়ে ছোঁয়। বন্ধু এক ধরণের টনিক তাই শুধু বন্ধুকেই বলা যায়, ‘তুমি ছুঁয়ে দিলে মন, আমি উড়বো সারাক্ষণ’।
বন্ধুত্বকে সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। কথায় আছে ‘বিপদে বন্ধুর পরিচয়’। ছেলেবেলায় ট্রান্সলেশন মুখস্ত করেছি- A friend is need is a friend in deed.অর্থাৎ অসময়ের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু। আর ভাল্লুক ও দুই বন্ধুর গল্প কে না জানে। এ জন্যই অনেকে বলে থাকেন- `সুসময়ে অনেকেই বন্ধু বটে হায়, অসময়ে হায় হায় কেউ কারো নয়`। বাগধারায় আছে `দুধের মাছি`- অর্থাৎ সুসময়ের বন্ধু। বাক্য রচনা হয়- টাকা থাকলে দুধের মাছির অভাব হয় না। এ জন্যই উপদেশ: `বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও’।
উইলিয়াম সেক্সপিয়র বলেছেন, কাউকে সারাজীবন কাছে পেতে চাও? তাহলে প্রেম দিয়ে নয়, বন্ধুত্ব দিয়ে আগলে রাখো। কারণ প্রেম একদিন হারিয়ে যাবে-কিন্তু বন্ধুত্ব কোনদিন হারাবে না।
সময় কখনও বন্ধুত্বকে ম্লান-মলিন-ম্রিয়মান করতে পারেনা। দিনের আলোর গভীরে যেমন, সকল তারা লুকিয়ে থাকে, তেমনি মনের গোপনে-গহীনে বন্ধুত্ব অটুট-অম্লান থাকে। দূরত্ব বরঞ্চ বন্ধুত্বকে জীবন্ত ও জলন্ত করে তোলে- তাইতো সুমন গেয়ে ওঠেন-
হঠাৎ রাস্তায় আপিস অঞ্চলে
হারিয়ে যাওয়া মুখ চমকে দিয়ে বলে
“বন্ধু, কী খবর বল?
কত দিন দেখা হয় নি…
স্বনামখ্যাত বাম রাজনীতিক রাশেদ খান মেনন তাঁর আত্মজীবনীমূলক ‘এক জীবন: স্বাধীনতার সূর্যোদয়; গ্রন্থে আরেক বাম রাজনীতিক হায়দার আকবর খান রনোর সাথে বন্ধুত্ব সম্পর্ক নিয়ে বলেন, ‘যশোরেই আমার সঙ্গে পরিচয় হয় হায়দার আকবর খান রনো ও হায়দার আনোয়ার খান জুনোর। ওরা দুই ভাই যশোর জিলা স্কুলে পড়ত। আমরা দুভাই-আমি ও মনন (সুলতান মাহমুদ খান) খুলনা থেকে ওই যশোর জিলা স্কুলেই ভর্ত্তি হয়েছিলাম। রনোর আব্বা ছিলেন যশোরের এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার। আমাদের পুরতান কসবার জেলা জজের বাসার কাছেই ওদের বাসা। এ সুবাদে রনোর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। আমরা দুজনই একই রাজনীতির সঙ্গে সংযুক্ত হই।‘ (পৃষ্ঠা-২৫)। পৃষ্ঠা-২৬ এ লিখেছেন, ‘রনোর আব্বা হাতেম আলী খান নিজে ধূমপায়ী ছিলেন। রনো তাঁর পকেট থেকে চুরি করে ‘পাসিং শো’ এর প্যাকেট আমাদের জন্য নিয়ে আসত। এই ‘পাসিং শো’ তখন খুবই জনপ্রিয় সিগারেট ছিল।‘
৯০’র দশকে ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা জাতীয় ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক রাউফুন বসুনিয়া হত্যাকান্ডে দারুণ মর্মাহত কবি মোহন রায়হান প্রিয় বন্ধুকে নিয়ে লিখেছেন ‘তোমাকে মনে পড়ে যায় কবিতা-
‘মধুর ক্যান্টিনে যাই
অরুণের চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে
বসু, তোমাকে মনে পড়ে যায়।
তোমার সেই সদাহাসিমাখা ফুল্ল ঠোঁট
উজ্জ্বল চোখের দ্যুতি সারাক্ষণ চোখে চোখে ভাসে।
বুঝি এখনি সংগ্রাম পরিষদের মিছিল শুরু করার তাগিদ
দেবে তুমি’
বসুনিয়াকে হারিয়ে বেদনাভরা চিত্তে কবি আরও বলেন-
কাউন্টারের সামনে কতদিন তোমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
চা খেয়েছি, কতদিন তুমি আমাকে চা’র পয়সা দিতে দাওনি’
কতদিন চায়ের সঙ্গে একটি সিঙারা বা কেকের আবদার করেছ,
কতদিন তোমার সঙ্গে খোশগল্প, হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠেছি
বসু, আজ সব কথা মনে পড়ে যায়
রিপার বিয়েতে তুমি বলেছিলে- অ্যাকশানে আপনার আর আগে
থাকার দরকার নেই, আমরা তো আছি।’
বসু তুমি রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে সে কথা প্রমাণ করে গেলে
বসু, তুমি আমার শ্রেষ্ঠ ভালোবাসার একটি রক্তকরবী বৃক্ষ।
বন্ধুত্ব মানেই হল একে অন্যের সুখের সাথী হবে, দুঃখের অংশীদার হবে, ব্যাথার নিকটতম প্রতিবেশী হবে। পুরোটা জীবন জুড়ে জড়িয়ে থাকবে। তখনই এই কথা বলা সার্থক হবে যে-
‘বন্ধু এসো স্বপ্ন আঁকি চারটা দেয়াল জুড়ে
বন্ধু এসো আকাশ দেখি পুরোটা চোখ খুলে
বন্ধু এসো জলে ভাসি দুখ ভাসানোর সুখে’।
বন্ধুত্ব কোন আইন মানেনা, মানেনা নিয়ম-কানুন, কিংবা রীতি-নীতি অথবা সংস্কার। তাই যে কারো সাথে বন্ধুত্ব হতে পারে। বিপত্তিটা ঘটে তখনই যখন ছেলে-মেয়ের বন্ধুত্ব হয়। এ বন্ধুত্ব কিছুদিন পার হলেই আরও অনেক দাবি; চোখের দাবি, মনের দাবি নিয়ে হাজির হয়। আর এক পর্যায়ে এটা ভালোবাসার দিকে টার্ন করে। তখনই বিপত্তিটা বাধে। শুরু হয় মান-অভিমান-অভিযোগ-অনুযোগ- কেউ কেউ প্রাণের গভীরে গান গেয়ে ওঠে-
মেয়ে, তুমি এখনও আমায় বন্ধু ভাবো কি?
কখনোও কি আমায় ভেবেছিলে বন্ধুর চেয়ে একটুখানি বেশী?
বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, বন্ধুত্ব ও ভালবাসায় অনেক তফাৎ আছে, কিন্তু ঝট্ করিয়া সে তফাৎ ধরা যায় না। বন্ধুত্ব আটপৌরে, ভালবাসা পোশাকী। বন্ধুত্বের আটপৌরে কাপড়ের দুই-এক জায়গায় ছেঁড়া থাকিলেও চলে, ঈষৎ ময়লা হইলেও হানি নাই, হাঁটুর নীচে না পৌঁছিলেও পরিতে বারণ নাই। গায়ে দিয়া আরাম পাইলেই হইল। কিন্তু ভালবাসার পোশাক একটু ছেঁড়া থাকিবে না, ময়লা হইবে না, পরিপাটি হইবে। বন্ধুত্ব নাড়াচাড়া টানাছেঁড়া তোলাপাড়া সয়, কিন্তু ভালবাসা তাহা সয় না। আমাদের ভালবাসার পাত্র হীন প্রমোদে লিপ্ত হইলে আমাদের প্রাণে বাজে, কিন্তু বন্ধুর সম্বন্ধে তাহা খাটে না; এমন-কি, আমরা যখন বিলাস প্রমোদে মত্ত হইয়াছি তখন আমরা চাই যে, আমাদের বন্ধুও তাহাতে যোগ দিক! প্রেমের পাত্র আমাদের সৌন্দর্য্যের আদর্শ হইয়া থাক্ এই আমাদের ইচ্ছা— আর, বন্ধু আমাদেরই মত দোষে গুণে জড়িত মর্ত্ত্যের মানুষ হইয়া থাক্ এই আমাদের আবশ্যক। আমাদের ডান হাতে বাম হাতে বন্ধুত্ব। আমরা বন্ধুর নিকট হইতে মমতা চাই, সমবেদনা চাই, সাহায্য চাই ও সেই জন্যই বন্ধুকে চাই।
বিদ্রোহী কবি নজরুল বন্ধুদের উদ্দেশে বলেছেন-
তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু, আর আমি জাগিব না,
কোলাহল করি’ সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙিব না |
-- নিশ্চল নিশ্চুপ
আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধূর ধূপ !------
এভাবেই চিরতরে চলে যাওয়ার কথা বলেছিলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তার লেখনী সত্য হয়েছে। জ্যৈষ্ঠের খরতাপে ঝড়ের মতোই তার আবির্ভাব হলেও বিদায় নিয়েছিলেন নীলাকাশে সাদা মেঘ ভেসে বেড়ানোর দিন- শরতে।
মাতা-মাতৃভাষা আর মাতৃভূমি প্রত্যেক মানুষের পরম শ্রদ্ধার বস্তু। যখন এ গুলোর ওপর আঘাত আসে তখন সমস্ত উদ্বেগ- উৎকন্ঠা ঝেড়ে ফেলে বন্ধুত্বের সমস্ত শক্তি দিয়ে, সাহস দিয়ে, আবেগ দিয়ে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয়। অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মাঝেই বন্ধুত্বের মহিমা নিহিত। কিশোর কবি সুকান্ত তাই উচ্চারণ করেন-
বন্ধু তোমার ছাড় উদ্বেগ, সুতীক্ষ্ণ কর চিত্ত
বাংলা মাটি, দুর্জয় ঘাটি, বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।
সময়ের প্রয়োজনে আমরা হেঁটে চলছি নিরন্তর। আমাদের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। সকল বাথা বিপত্তি, মোকাবেলা করে আমাদের চলতে হবে। আর সেই বন্ধুর পথ চলা হোক বন্ধুর সাথে। তখন আর কোন কষ্ট থাকবে না। তখন গাইবো- আমার এই পথ চলাতে আনন্দ যে।
লেখক: মাহবুবুর রহমান তুহিন
জনসংযোগ কর্মকর্তা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
ইএফ