শেখ কামাল : প্রতিভাপ্রদীপ্ত সৃজনশীল সংগঠক

আব্দুর রহমান প্রকাশিত: আগস্ট ৫, ২০২২, ০২:৩১ পিএম

মাত্র ২৬ বছরের জীবনে বাঙালির সংস্কৃতি ও ক্রীড়াক্ষেত্রের এক বিরল প্রতিভাবান সংগঠক ও উদ্যোক্তা হিসেবে শেখ কামাল এক অসামান্য উচ্চতায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। দেশ ও সমাজভাবনায় সচেতন বহুমাত্রিক প্রতিভার এই সংগঠক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি রাজনীতিতেও ছিলেন সমান তৎপর।

আজ ৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামালের জন্মদিন। ১৯৪৯ সালের এই দিনে তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

খুব ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি ছিল তার প্রচণ্ড ঝোঁক। ঢাকার শাহীন স্কুলে পড়াকালীন স্কুলের খেলাধুলার প্রত্যেকটি আয়োজনে তিনি ছিলেন অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর মধ্যে ক্রিকেটের প্রতি টানটা ছিল সবচেয়ে বেশি। দীর্ঘদেহী কার্যকর ফাস্ট বোলার হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন তিনি।

কিন্তু একই সাথে বাঙালি এবং মুজিবপুত্র হওয়ার কারণে অবিভক্ত পাকিস্তানের জাতীয় পর্যায়ের ক্রিকেটে নিদারুণভাবে উপেক্ষিত থেকেছেন। তরুণ বয়সে আজাদ বয়েজ ক্লাবের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন এবং ওই ক্লাবের হয়েই দীর্ঘদিন প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলেছেন। ঢাকার আজাদ বয়েজ ক্লাব তখন প্রতিভাবান তরুণ ক্রিকেটারদের লালনক্ষেত্র।

খেলাধুলার পাশাপাশি সংস্কৃতিচর্চার প্রতি তার আগ্রহ ও কর্মকাণ্ডের ব্যাপকতা তার প্রতিভা ও মননের এক বিশাল দিককে উন্মোচিত করে। অভিনয়, সঙ্গীত চর্চা, বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতাসহ সব ক্ষেত্রে তিনি তার মেধার সাক্ষর রেখেছেন। শাহীন স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন।

সেখান থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হলের ছাত্র হিসেবে হলের বাস্কেটবল টিমের ক্যাপ্টেন ছিলেন শেখ কামাল। বাস্কেটবলে তার অসামান্য দক্ষতার কারণে তার সময়ে বাস্কেটবলে সলিমুল্লাহ হল শেষ্ঠত্ব বজায় রেখেছিল।

১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সামরিকজান্তা সরকার রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ করলে তার প্রতিবাদের ভাষা তথা অস্ত্র হয়ে ওঠে রবীন্দ্র সঙ্গীত। সে সময় বিভিন্ন আন্দোলন পরিস্থিতিতে রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়ে অহিংস পন্থায় প্রতিবাদের উদাহরণ সৃষ্টি করেন শেখ কামাল। সে সময় তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পীদের সংগঠিত করেন এবং রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি শিল্পী জাহিদুর রহিমকে দিয়ে বিভিন্ন সভা ও জমায়েতে গাওয়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর স্বাভাবিকভাবেই তার কর্মপরিধির বিস্তার ঘটে এবং অনেক ব্যাপকতা পায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যাঙ্গনে একজন ভালো অভিনেতা হিসেবে তার সুখ্যাতি গড়ে ওঠে। নাট্য সংগঠন ঢাকা থিয়েটারের তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তার অভিনীত নাটক নিয়ে ভারত সফরও করেছেন। কলকাতার মঞ্চে মুনীর চৌধুরীর বিখ্যাত নাটক ‘কবর’ মঞ্চায়ন করেন। অভিনয় প্রতিভার সাক্ষর রেখেছেন বাংলা একাডেমি মঞ্চেও। সেতার বাজাতে খুব পছন্দ করতেন তিনি। ছায়ানটের সেতার বাদন বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন শেখ কামাল। ওস্তাদ ফুল মোহাম্মদের কাছে নিজ বাড়িতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিতেন।

খেলাধুলার প্রতি অমোঘ আকর্ষণ ও খেলাধুলার প্রসারের লক্ষ্যে দেশের অন্যতম শক্তিশালী ও জনপ্রিয় ক্লাব আবাহনী ক্রীড়াচক্র প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে তার বড় বোন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ধানমন্ডি এলাকায় কোনো ধরনের খেলাধুলার ব্যবস্থা ছিল না। সে (শেখ কামাল) উদ্যোগ নেয় এবং ওই অঞ্চলের সবাইকে নিয়ে আবাহনী গড়ে তোলে। মুক্তিযুদ্ধের পরে ও এই আবাহনীকে শক্তিশালী করে।’

আবাহনী ক্রীড়াচক্র বাংলাদেশের ক্রীড়াক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী বিপ্লবের জন্ম দেয়। প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় ক্লাব মোহামেডানকে পেছনে ফেলে আবাহনীকে তিনি গৌরবের উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ক্রমান্বয়ে সারা দেশে আবাহনীর শাখা গঠনে তৎপর হন। তরুণ সমাজের চিত্তের প্রফুল্লতা নিশ্চিত করা ও বিপথে ধাবিত না হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রয়োজনীয়তা তিনি উপলব্ধি করেছেন সবসময় এবং মাত্র ২৬ বছরের নাতিদীর্ঘ জীবনে তাকে সে অনুযায়ী নানামুখী উদ্যোগ নিতে দেখা যায়।

বন্ধু শিল্পী ও সহকর্মীদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠী’। বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদের সাথে মেশার ক্ষেত্রে তার মধ্যে কেউ কোনোদিন কোনোরূপ অহমিকার প্রকাশ দেখেননি। বন্ধুবৎসল শেখ কামাল জীবনযাপনে ছিলেন খুবই সাধারণ। দেশের স্থপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পুত্র হওয়া সত্ত্বেও কোনোরূপ ক্ষমতার অপব্যবহার তিনি করেননি।

ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের তিন তলায় শেখ কামালের বসবাসের ঘরটিতে থাকত নানারকম বাদ্যযন্ত্রের সমাহার। যে মানুষটির দিন শুরু হতো সঙ্গীত, পিয়ানো ও সেতার বাদনের মধ্য দিয়ে, তারপর ফুটবল, ক্রিকেটের পর্ব শেষ করে সন্ধ্যায় ব্যস্ত হতেন নাটকের মঞ্চে অথবা মহড়ায়— তিনি রুচি ও মানসিকতায় কেমন মানুষ ছিলেন তা অনুমান করতে কারো কষ্ট হওয়ার কথা না।

শেখ কামাল তারুণ্যের প্রতিনিধি হিসেবে তার সময়ে সহকর্মী ও সতীর্থদের মাঝে যে উদ্দীপনা ছড়িয়েছেন, তরুণ ও যুবসমাজের মধ্যে তা একটি সাংস্কৃতিক চেতনার জাগরণ ঘটিয়েছিল। যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনার আলোকে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল, সেই চেতনাকে লালন করেই শেখ কামালের জীবনের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে দেখা যায়।

আজকের বাংলাদেশে সামাজিক মূল্যবোধের যে চরম অবক্ষয় আমরা লক্ষ করি, তখন শেখ কামালের মতো সৃজনশীল রুচি ও মননের অধিকারী সংগঠকের অভাব আমরা খুব করে অনুভব করি। সব ধরনের কূপমণ্ডূকতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে একটি ইতিবাচক সমাজ গঠনের তাগিদ তার মধ্যে সর্বদা জাগরুক ছিল। যুব ও তরুণসমাজের মনন গঠনের উদ্দেশ্য থেকেই তিনি ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে একটি সৃজনশীল প্রজন্ম তৈরির লড়াইয়ে সর্বদা সচেষ্ট থেকেছেন।

পারিবারিক পরিবেশ থেকেই এ সব কিছুর পাশাপাশি রাজনীতির পাঠও গ্রহণ করেছিলেন শেখ কামাল। বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধারাবাহিক আপসহীন সংগ্রামের বিষয়টি প্রত্যক্ষ করার ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় তিনি নিজেকে তৈরি করেছেন। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগের জন্মের বছরেই শেখ কামালেরও জন্ম। আওয়ামী লীগের পথচলার যে ধারাবাহিকতা, বঙ্গবন্ধুর জীবন পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়, তার প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই শেখ কামালের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়ে গেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ শিরোনামের স্মৃতিকথায় এক জায়গায় লিখেছেন— ‘কামাল তখন অল্প কথা বলতে শিখেছে। কিন্তু আব্বাকে ও কখনো দেখেনি, চেনেও না। আমি যখন বারবার আব্বার কাছে ছুটে যাচ্ছি, আব্বা আব্বা বলে ডাকছি ও অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে। গোপালগঞ্জ থানায় একটা বড় পুকুর আছে, যার পাশে বড় খোলা মাঠ। ওই মাঠে আমরা দুই ভাইবোন খেলা করতাম ও ফড়িং ধরার জন্য ছুটে বেড়াতাম। আর মাঝে মাঝেই আব্বার কাছে ছুটে আসতাম।

অনেক ফুল, পাতা কুড়িয়ে এনে থানার বারান্দায় কামালকে নিয়ে খেলতে বসেছি। ও হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘হাসু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি?’ কামালের সেই কথা আজ যখন মনে পড়ে, আমি তখন চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না।’ বঙ্গবন্ধুর পুত্র-কন্যাদের এমনই সংগ্রামমুখর পথ পাড়ি দিয়ে বেড়ে উঠতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতার সুদীর্ঘ সংগ্রামের পথে বাঙালির ওপর যত আঘাত এসেছে, প্রত্যক্ষভাবে ওই পরিবারটিকে তা স্পর্শ করে গেছে।

পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের জেল-জুলুমের যে সংগ্রামমুখর জীবন, তা প্রত্যক্ষ করেই বেড়ে ওঠা শেখ কামালের জীবনের দীক্ষাও ছিল সবসময় মানুষ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে নানাভাবে ভূমিকা রাখার। ছাত্রলীগের কর্মী ও সংগঠক হিসেবে তিনি ছয় দফা, ১১ দফা আন্দোলন এবং উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে বীরোচিত অংশগ্রহণ ছিল তার। অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতার অধিকারী শেখ কামাল সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ওয়ার কোর্সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে মুক্তিবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে ষড়যন্ত্রকারীদের পৈশাচিক হামলায় নিহত হওয়ার সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের এমএ শেষ পর্বের পরীক্ষার্থী ছিলেন। এর মাত্র এক মাস আগে ১৯৭৫ সালের ১৪ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লু খেতাবপ্রাপ্ত দেশসেরা অ্যাথলেট সুলতানা খুকুকে তিনি পারিবারিকভাবে বিয়ে করেন।

১৫ আগস্ট ভোররাতে বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কিত ও বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে বঙ্গবন্ধুসহ সপরিবারে নিহত না হলে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সুমহান নেতৃত্বের পাশাপাশি বাংলাদেশ পেতে পারত বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই সংগঠক ও নেতাকে। তার মেধা ও রুচির প্রয়োগ ঘটিয়ে তরুণ প্রজন্মকে যে সুন্দর ও সম্ভাবনার পথ তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন, সেই পথটি যেন আমরা খুঁজে নিতে পারি। ৭৪তম জন্মদিনে অনন্য সংগঠক শেখ কামালের প্রতি আমার হূদয়ের গভীর থেকে প্রগাঢ় শ্রদ্ধা।

লেখক : সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ