রাজধানীতে কিউলেক্স মশার উৎপাতে অতিষ্ঠ নগরবাসী। মশা নির্মূলের মূল দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনের। মশা নিয়ন্ত্রণে করপোরেশনের তৎপরতা তেমন দেখা যাচ্ছে না। ওয়ার্ডভিত্তিক মশক নিধনেও তেমন কোনো তৎপরতা নেই।পাশাপাশি ডেঙ্গু প্রতিরোধ বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতারও অভাব রয়েছে। সচেতনতা বাড়ানোর জন্য মশা নিধন অভিযানে নাগরিকদের সম্পৃক্ততা বাড়ানো প্রয়োজন।
খুব সামান্য পানিতেই এডিস মশা বংশবিস্তার করতে পারে। সাধারণত পরিষ্কার পানিতেই এই মশা বংশবিস্তার করে। মানুষ যত্রতত্র পলিথিনের ব্যাগ, ডাবের খোসা, বোতল, ক্যান, পরিত্যক্ত টায়ার বা বিভিন্ন ধরনের পাত্র ফেলে রাখে। সেগুলোতে জমা বৃষ্টির পানিতে এডিস মশা অনায়াসে বংশবিস্তার করতে পারে। ফুলের টবে কিংবা ছোট-খাটো পাত্রে পানি জমে থাকলে তাতেও বংশবিস্তার হয়। নির্মীয়মাণ ভবনগুলোতে তো রীতিমতো মশার চাষ করা হয়। আর দুই বাড়ির মধ্যখানে সরু জায়গায় রীতিমতো আবর্জনার স্তূপ জমে থাকে। অনেক বাড়ির সানসেটেও আবর্জনা জমে থাকতে দেখা যায়।
এসব জায়গায় এডিস মশার বংশবিস্তার দ্রম্নততর হয়। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে মশার বংশবিস্তারের সুযোগ নষ্ট করতে হবে। সেই সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ মশা ও লার্ভানাশক ওষুধও যথেষ্ট পরিমাণে ছিটাতে হবে। মশার হটস্পটগুলো চিহ্নিত করে সেসব জায়গায় অভিযান সর্বাধিক জোরদার করতে হবে।
বিজ্ঞানীদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশগুলোতে মশা ও পানিবাহিত রোগব্যাধি ক্রমেই বাড়বে। গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশেও এই স্বাস্থ্য সমস্যা ক্রমেই প্রকট হবে। এজন্য জাতীয় নীতিকৌশল ঠিক করে সেই স্বাস্থ্যসমস্যা মোকাবেলায় কাজ করতে হবে। আর ডেঙ্গু যেহেতু নগরের সমস্যা হিসেবে বিবেচিত, তাই নগর কর্তৃপক্ষকে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ ও ড্রেনগুলোর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ না থাকা মশার বংশবিস্তারের অন্যতম কারণ। সঙ্গত কারণেই সংশ্লিষ্টদের কর্তব্য হওয়া দরকার এই বিষয়গুলোকে সামনে রেখে যত দ্রম্নত সম্ভব প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা। আমাদের মনে রাখতে হবে দেশে মশাবাহিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা কমেনি। বরং বেড়েছে কয়েকগুণ। এছাড়াও ডেঙ্গুর ছড়াছড়ি চলছে দেশজুড়ে। প্রাণহানী ঘটছে এতে। ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি কোনোভাবেই এড়ানোর সুযোগ নেই বলেই প্রতীয়মান হয়।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বারবার কর্তৃপক্ষকে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষ যেসব কার্যক্রম পরিচালনা করেছে তা কতটা পর্যাপ্ত ছিল, এ প্রশ্ন উঠতেই পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কর্তৃপক্ষ অতীত থেকে শিক্ষা নেয়নি বলেই ডেঙ্গু এবার এতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এর পরই কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসে। এভাবে সাময়িক পদক্ষেপে যে সুফল মিলবে না, এ কথা বিশেষজ্ঞরা অতীতেও বারবার বলেছেন। কিউলেক্স মশার গুণগুণ শব্দ আর কামড় শহর-নগর-বন্দর জুড়ে মানুষের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাস্তবতা এডিস মশার মতো ভয়াবহ না হলেও এ মশার কামড়ে অনেক সময় গোদরোগ হয়। এটি হলে হাত-পা ফুলে শরীরের বিভিন্ন অংশ বড় হয়ে যায় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। সঙ্গত কারণেই সংশ্লিষ্টদের এটা আমলে নেওয়া জরুরি। কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, যে কোনো উপায়ে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এখনই মশা নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে মশার ঘনত্ব বেড়ে চরমে পৌঁছাবে। এমনকি অতীতের ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মতো ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে- এমন আশঙ্কাও উঠে এসেছে। তবে সংশ্লিষ্টদের এই বিষয়টিকেও সামনে রাখা দরকার। নগর পরিকল্পনাবিদদের অভিমত, মশা বৃদ্ধির পেছনে আবহাওয়া ও পরিবেশের প্রভাব থাকলেও এটিই একমাত্র কারণ নয়। এর নেপথ্যে আরও বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে।
বিশেষ করে নালা, ডোবা, পুকুর ও পরিত্যক্ত জলাশয়ের কচুরিপানা পরিষ্কার এবং মশা মারার ওষুধ কেনা সংক্রান্ত অনিয়মের অভিযোগও উঠে এসেছে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত সংবাদ মাধ্যমে। সেখানে আলোচনায় এসেছে যে, সঠিকভাবে ডোবা, জলাধার পরিষ্কার করা হচ্ছে না। মানহীন মশার ওষুধ কেনার কারণে এই ওষুধে কাজ হয় না। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মশা নিধন কর্মীরা মানহীন ওই ওষুধও নিয়ম মেনে ছিটায় না। বাইরে এসব বিক্রি করে দেয় এমন বিষয়ও খবরের মাধ্যমে উঠেএসেছে- যা সামলে নেওয়া অপরিহার্য। মশা নিধনে শুধু তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নয়, স্থায়ী পরিকল্পনা নিতে হবে।
কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, শীত-পরবর্তী সময়ে সারাদেশে মশার উপদ্রব বাড়ে। এই সময়ে দেশের যে কোনো জায়গায় বছরের অন্য সময়ের তুলনায় মশা অনেক বেশি হয়। এবারো তাই হয়েছে। যদিও এডিসবাহিত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কমেছে। তবে কিউলেক্স মশা বেড়েছে। এই মশাও কম বিপজ্জনক নয়। কিউলেক্স মশার মাধ্যমে ফাইলেরিয়া ছড়ায়। এ রোগে মানুষের হাত-পা ও অন্যান্য অঙ্গ অস্বাভাবিকভাবে ফুলে ওঠে। সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, অন্য সময়ের তুলনায় এ বছর ঢাকায় মশার লার্ভার ঘনত্ব বেড়েছে প্রায় ৩ গুণ। উড়ন্ত মশার ঘনত্ব বেড়েছে প্রায় ৮ গুণ। গবেষকরা আশঙ্কা করছেন, মার্চে মশার ঘনত্ব চরমে পৌঁছাবে। মশা বৃদ্ধির নানা কারণ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে শহর আর গ্রামের অবস্থা ভিন্নতর।
প্রধানত আলোচনায় শহরের কথাই উঠে আসে, তাই শহরকেন্দ্রিক ভাবনাই প্রাধান্য পায়। আবদ্ধ পানি, উন্মুক্ত ড্রেন ও যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা রাজধানীতে মশার বংশবিস্তারের প্রধান কারণ। জানা যায়, ঢাকা শহরের সর্বত্রই এখন কিউলেক্স মশার মাত্রাতিরিক্ত উপদ্রব। প্রকৃত অর্থে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে মশার লার্ভার বিস্তার রোধে আগে থেকেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। এ কার্যক্রম কম দেখা যায়। এছাড়া মশা নিধনে বৈষম্যও রয়েছে। বিশেষ বিশেষ স্থান ও এলাকায় যথারীতি ও নিয়মিত মানসম্পন্ন ওষুধ ছিটানো হলেও অন্য এলাকায় তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায় না। মশা নিধনে বছর বছর বরাদ্দ বাড়াচ্ছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। তারপরও মশার উৎপাতে সারা বছরই অতিষ্ঠ থাকে নগরবাসী।
এ সমস্যা নিয়ন্ত্রণে দুই সিটি করপোরেশনের ভূমিকা নিয়েও নানা অভিযোগ নগরবাসীর। দুই সিটি করপোরেশন অবশ্য বলছে, মশা নিয়ন্ত্রণে তাদের আন্তরিকতার অভাব নেই। করপোরেশনের উদ্যোগে এরই মধ্যে অনেক জায়গা পরিষ্কার করা হয়েছে। সিটি করপোরেশনের এমন উদ্যোগ অব্যাহত রাখতে হবে। মশা নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা থাকলে আবারো ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ফাইলেরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়বে।
বছরের ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত কিউলেক্স মশার প্রজনন মৌসুম। কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, কিউলেক্স মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনের, এটা নগরবাসীর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। কেননা কিউলেক্স মশার প্রজনন স্থান ডোবা-নালায় জমে থাকা পানিতে। আর ঢাকা শহরে এটা পরিষ্কারের দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনের। এসব কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হলে কিউলেক্স মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে থাকবে। মশা নিধনের মতো জরুরি কাজে নিয়োজিত কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করছে কিনা- এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষেরও দৃষ্টি দেয়া আবশ্যক। এখন এডিস মশার প্রাদুর্ভাব কম। সামনে বর্ষাকাল। বৃষ্টি হলেই এডিস মশা বাড়বে।
এজন্য কর্তৃপক্ষকে এখন থেকেই পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে। কেবল এডিস নয়, সব ধরনের মশা নিধনেই সমান গুরুত্ব দিতে হবে। একটি আধুনিক নগরী গড়ে তুলতে সার্বিক পরিচ্ছন্নতার দিকে নজর দেয়া গেলে তার প্রভাব মশা নিধনেও পড়বে। মশা নিধনে শুধু তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নয়, স্থায়ী পরিকল্পনা জরুরি। নগরীকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে নাগরিকদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। মশা নিধনে শুধু বরাদ্দ বৃদ্ধি নয়, প্রয়োজন সব পক্ষের সচেতনতা। সরকারি-বেসরকারি সব মহলের আন্তরিক ও সমন্বিত উদ্যোগে নগরবাসী মশার উপদ্রব থেকে রক্ষা পাবে- এটাই প্রত্যাশা।
মূলত: নগরীকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে নাগরিকদেরও উদ্বুদ্ধ করতে হবে। মশা নিধনে শুধু বরাদ্দ বৃদ্ধি নয়, প্রয়োজন সব পক্ষের সচেতনতা। পরিচ্ছন্নতা, জনসচেতনতা বাড়ানোসহ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। মশাবাহিত বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব ভয়াবহ রূপ নেওয়ার আশঙ্কা এটিকে সামনে রেখে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মশার উপদ্রম্নব রোধে সংশ্লিষ্টদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকুক- এমনটি কাম্য।
লেখক : কলামিষ্ট