কৃষি প্রযুক্তির বিকাশে এবং দেশীয় কৃষি কৌশলের জন্য নিজস্ব যন্ত্রপাতি তৈরিতে উদ্যোগী হতে হবে। বাড়াতে হবে কৃষি গবেষণার বরাদ্দ। পরিকল্পনার এই দিকগুলো বাজেটে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনাসহ উঠে আসবে এমনটি প্রত্যাশা ছিল। বাজেট ঘোষণায় কৃষি গবেষণায় জোর দেয়ার উল্লেখ আছে। তবে কৃষির উচ্চশিক্ষায় কারিকুলাম আধুনিককরণ জরুরি। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত করতে না পারলে পিছিয়ে থাকতে হবে। ব্লু ইকোনমির বিকাশ এবং সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণের কথা উল্লেখ করে গভীর সমুদ্রে টুনা ও সমজাতীয় পেলাজিক মাছ আহরণের পাইলট প্রকল্পের কথা বলা হয়েছে। ক্লাইমেট স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার এবং ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট বিষয়গুলো জাতীয় বাজেট ঘোষণায় উঠে এসেছে-যা আশা জাগানিয়া
আমার সহকর্মী অফিস সহকারী ফিরোজ। খুব সাদাসিধে ও সৎ একটি ছেলে। জীবনকে সে বেশ সহজ ও অনাড়ম্বরভাবেই যাপন করে। চাহিদা কম। সন্তুষ্টি বেশি। তার কাছে জানতে চাইলাম, আচ্ছা ফিরোজ, এবার বাজেটে তোমার প্রত্যাশা কী? সে জানাল, জিনিসপত্রের দাম কমুক, আর কোনো কিছু চাই না। শুধু ফিরোজ নয়, এ প্রত্যাশা বোধকরি সব নাগরিকের, বলা ভালো সব বিশ্ব নাগরিকের। প্রতি বছরই বাজেট ঘোষণার পর সাধারণ মানুষ মূলত সংবাদপত্র কিংবা টেলিভিশন থেকে জানতে পারে কোন জিনিসের দাম বাড়বে, আর কোন জিনিসের দাম কমবে। কিন্তু জাতীয় বাজেট কেবল পণ্যের দাম বাড়া কিংবা কমার বিষয় নয়। এটি সরকারের কাছে নাগরিকের প্রাপ্তি- অপ্রাপ্তির একটি হিসাব। আমি যখন এই লেখা লেখছি তখন দেশের ৫২তম ও আওয়ামী লীগ সরকারের জাতীয় সংসদে ২৪তম বাজেট ঘোষণা শেষ হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। যা চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের চেয়ে ১২% বেশি। সারা পৃথিবীর যুদ্ধ ও মহামারি আক্রান্ত অর্থনীতির সঙ্গে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়ন, নির্বাচনি বছরের চাপ সব মিলে প্রস্তাবিত বাজেট সংকুচিতই বলা চলে। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এই বাজেটকে বলা হচ্ছে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে প্রথম বাজেট। কৃষি ক্ষেত্রে (কৃষি, খাদ্য এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ) ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৩৫ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। যা গত বছর ছিল ৩৩ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যার বড় একটি অংশ হয়তো খরচ হবে সারের ভর্তুকিতে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য সারের ক্ষেত্রে সরকারের ভর্তুকি ধরা হয়েছিল ১৬ হাজার কোটি টাকা। তবু আন্তর্জাতিক বাজারে সারের মূল্যবৃদ্ধির জন্য আমাদের কৃষকপর্যায়ে সারের দাম বাড়াতে হয়েছে। ফলে বেড়েছে ভর্তুকিও; প্রায় সাড়ে ২৬ হাজার কোটি টাকা। সে ক্ষেত্রে এবার কৃষিতে ভর্তুকি ও প্রণোদনা ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এর পরিমাণ বাড়বে- এমনটাই প্রত্যাশা। না হলে এর প্রভাব পড়বে কৃষিপণ্য উৎপাদনে। বাড়বে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের দাম।
বিভিন্ন ইস্যুতে এখনো রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বৈরী সম্পর্কের বাতাস বইছে। টানাপড়েনে হিমশিম খেতে হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে। সারের আমদানিনির্ভরতা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করতে হবে আমাদের। সার উৎপাদনে সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। সার কারখানার পরিধি এবং কর্মকাণ্ড বাড়াতে হবে। বিশ্ব সারের বাজার যে সবসময় আমাদের অনুকূলে থাকবে এমন কোনো কথা নেই। তাই নিজেদের যা আছে এবং যতটুকু প্রয়োজন, তা চিহ্নিত করে, সঠিক পরিকল্পনা করেই আমাদের কাজ করতে হবে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণায় আমরা কৃষি যন্ত্রপাতির মূল্য কমার একটি ইঙ্গিত পাচ্ছি। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাব পড়ছে বৈশ্বিক কৃষিতে। কৃষি উৎপাদনই হবে আগামীর বিশ্ববাণিজ্যের মূল বিষয়। সেখানে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় নাটকীয় পরিবর্তন আনবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট অব থিংস, কাটিং এজ টেকনোলজির মতো আধুনিক সব প্রযুক্তির ব্যবহার। যার দৃষ্টান্ত আমরা উন্নত দেশের কৃষি ব্যবস্থাপনায় দেখতে পাচ্ছি। এক্ষেত্রে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে। যান্ত্রিক কৃষিতেই আমরা যথেষ্ট এগোতে পারিনি।
আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের নানান ইস্যুর মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিও স্বাভাবিকভাবে চলে আসে। বাজেট ঘোষণায় স্পষ্টত খাদ্য নিরাপত্তার কথা উল্লেখ আছে। কৃষি উৎপাদনে বিভিন্ন খাতে আমাদের অর্জনের কথাও উঠে এসেছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা এখনো আমদানিনির্ভর। আমাদের ৮০ ভাগ গম, ৮০ ভাগ দুধ আমদানি করতে হয়। এখনো পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে এর আমদানি বাড়াতে হয়।
আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে আনতে আমাদের নিজস্ব উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি করা একান্ত প্রয়োজন। বিশেষ করে যে কৃষিপণ্যগুলো আমরা সাধারণত বাইরে থেকে আমদানি করি, সেগুলোর উৎপাদন বাড়াতে হবে। বাজেটে বিষয়গুলোর সুস্পষ্ট ইঙ্গিত নেই। সেচকাজে ব্যবহূত বিদ্যুৎ বিলে ২০ শতাংশ হারে রেয়াত প্রদানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে বাজেটে। এবার খামারিদের প্রত্যাশা ছিল কৃষির অন্য খাত মৎস্য, পোলট্রি ও ডেইরি খাতে ব্যবহূত বিদ্যুতেও রেয়াতের সুবিধা থাকবে।
চলতি বছর সমলয় চাষাবাদ পদ্ধতিতে দেশের কয়েকটি অঞ্চলে চাষ করা হয়েছে। এতে ধানের চারা তৈরি, রোপণ ও কর্তনের কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার সহজ হবে। বছর দুয়েক আগে করোনা মহামারিতে খাদ্য সংকট ও দেশের পুষ্টি চাহিদা মেটাতে অনাবাদি জমিতে ৪৩৮ কোটি ব্যয়ে ‘পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন প্রকল্প’ নেয়া হয়েছিল। এবারও বাজেট ঘোষণায় উল্লেখ করা হয়েছে পারিবারিক পুষ্টি বাগান প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি ইউনিয়নে ১০০টি করে মোট ৪ লাখ ৮৮ হাজার ৪০০টি পারিবারিক সবজি বাগান স্থাপনের কথা।
৭০টির বেশি সবজি ও ফল বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে এবং কৃষিপণ্য রপ্তানিতে ইতোমধ্যে ১০০ কোটি ডলার আয়ের মাইলফলক অতিক্রমের কথা উল্লখ করে কৃষিপণ্য সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ ও রপ্তানির গুরুত্বের কথা বাজেট ঘোষণায় বলেছেন অর্থমন্ত্রী। সামপ্রতিক সময়ে অতি অল্প পর্যায়ে ভালো কৃষিচর্চা (গুড অ্যাগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস) শুরু হয়েছে।
খাদ্যপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ভালো কৃষিচর্চা (গুড অ্যাগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস) যেমন জরুরি, দেশের মানুষের সুস্বাস্থ্যের কথা ভেবেও এই চর্চা আমাদের রাখতে হবে। সে ক্ষেত্রে প্রযুক্তির কৃষির বিকল্প নেই। স্মার্ট ফার্মিং, আধুনিক কৃষির সবকিছুই এখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। আমাদের এ দিকটিতেও জোর দিতে হবে। শুধু পরিকল্পনার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে মাঠে নেমে পড়তে হবে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে এবং আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি বাংলাদেশ তা করে দেখাতে পারবে।
কৃষি প্রযুক্তির বিকাশে এবং দেশীয় কৃষি কৌশলের জন্য নিজস্ব যন্ত্রপাতি তৈরিতে উদ্যোগী হতে হবে। বাড়াতে হবে কৃষি গবেষণার বরাদ্দ। পরিকল্পনার এই দিকগুলো বাজেটে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনাসহ উঠে আসবে এমনটি প্রত্যাশা ছিল। বাজেট ঘোষণায় কৃষি গবেষণায় জোর দেয়ার উল্লেখ আছে। তবে কৃষির উচ্চশিক্ষায় কারিকুলাম আধুনিককরণ জরুরি। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত করতে না পারলে পিছিয়ে থাকতে হবে। ব্লু ইকোনমির বিকাশ এবং সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণের কথা উল্লেখ করে গভীর সমুদ্রে টুনা ও সমজাতীয় পেলাজিক মাছ আহরণের পাইলট প্রকল্পের কথা বলা হয়েছে। ক্লাইমেট স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার এবং ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট বিষয়গুলো জাতীয় বাজেট ঘোষণায় উঠে এসেছে-যা আশা জাগানিয়া। বাজেট ঘোষণায় ছাদকৃষির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। নগরকৃষি তথা ছাদকৃষির বিষয়গুলো নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নিতে হবে সুপরিকল্পনা। বাজেটে এবার জলবায়ু পরিবর্তনকে বেশ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাব প্রতিরোধ করা গেলে কৃষি ও কৃষকের উপকার হবে। পরিকল্পনার পাশাপাশি প্রয়োজন বাস্তবিক প্রয়োগ। প্রয়োজন সম্পদের সুষম বণ্টন এবং উৎপাদনের ভারসাম্য। বিশেষ করে আমরা যদি কৃষিকে কেন্দ্র করে বিশ্ববাজারে আস্থার সঙ্গে অংশ নিতে পারি, আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশ পাল্টে যাবে। আজকের ভর্তুকির কৃষিই একদিন হয়ে উঠবে টেকসই অর্থনীতির নির্ভরতম খাত। কৃষি ও কৃষি বাণিজ্যকে গুরুত্ব দিয়ে আগামীর পরিকল্পনা নিতে না পারলে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর উন্নয়ন অংশীজন হওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।
shykhs@gmail.com