ক্যাম্পাসে সাংবাদিকতা করায় ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি সাংবাদিক সমিতির (ডিআইইউসাস) ১০ জনকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আর এই বিষয়ে অপরাধ হিসেবে- বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনুমতি না নিয়ে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি সাংবাদিক সমিতির (ডিআইইউসাস) নতুন কমিটি গঠন করেছেন, এমনটা দাবি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিক বহিষ্কার অবশ্য নতুন নয়। একটি রাষ্ট্রের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ যেখানে সম্পূর্ণভাবে বিকশিত হয়নি, ন্যায্যতার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে সেখানে সংবাদমাধ্যমের কাজের ক্ষেত্র সংকুচিত হবে এটি অস্বাভাবিক নয়।
তারই ধারাবাহিকতায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে অ্যাকাডেমিক স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো অন্যতম উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার ফলাফল হিসেবে বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের সুনামধন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালগুলোতেও সাংবাদিক বহিষ্কারের মত ঘটনা ঘটে আসছে।
বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে মুক্তবুদ্ধি চর্চার কেন্দ্র। এখানে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করে অর্জনকৃত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে দেশ ও জনগণের কল্যাণে নিজেদের মেধা নিয়োগ করছেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিকেরা সবচেয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। একজন সাংবাদিক পরিচয়ের আগে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। একদিকে তাঁরা অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে যেমন অংশ নেন, তেমনি পেশাদারির জায়গায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া অনিয়ম দুর্নীতির সংবাদ জাতির সামনে তুলে আনেন।
যেখানে ছাত্র রাজনীতির নামে ক্যাম্পাসে সন্ত্রাস ও দখলদারিত্বের রাজনীতি শুরু হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ছাত্র রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা নিয়ে কোন সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। কারণ ছাত্র রাজনীতিকে নিজেদের টিকে থাকার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে শিক্ষকদের যে দলীয় রাজনীতি টিকিয়ে রাখার এজেন্ডা, তা বেশ পুরোনো। অথচ সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাংবাদিকতার চর্চা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জন্য ভীতিকর হয়ে উঠছে কেন? অনুমতি ছাড়া সমিতি - দাবির নেপথ্যে সুকৌশলে কোন বড় বিষয় ধামাচাপা দেয়ার প্রচেষ্টা নয় তো?
সাংবাদিক সমিতি ইউনিভার্সিটির অনুমতি না নিয়ে ক্যাম্পাসে ক্লাস রুম ব্যবহার করে ৯ মার্চ একটি সাধারণ সভার আয়োজন করে এবং ১০ মার্চ ২০২৪-২৫ সালের কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করে, যা ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির নিয়ম বহির্ভূত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষ স্পষ্টভাবে বলেছেন, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে এ ধরনের কোন সাংবাদিক সমিতি নেই এবং ইউনিভার্সিটির কর্তৃপক্ষ এ ধরনের সাংবাদিক সমিতিকে কোন স্বীকৃতি প্রদান করেননি।
সাংবাদিকতার স্বাধীনতা কারো অনুদান বা দয়ার উপর নির্ভর করে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেখানে ক্যাম্পাসে সাংবাদিক সমিতি গঠনে উৎসাহ দিয়ে আসছে, সেখানে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ডিআইইউ) কর্তৃপক্ষের এমন বিবৃতি এবং বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। ডিআইইউ প্রশাসনের বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বেশকিছু প্রতিবেদন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি সাংবাদিক সমিতির সাহসী সদস্যরাই এসব প্রতিবেদন করেছেন। হয়ত সে কারণে প্রশাসন চায় না বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা থাকুক। সাংবাদিকদের নামে কোন সংগঠন না থাকুক। সমিতি থাকলে হয়ত তাদের আরও অনিয়ম সামনে আসবে। তাই কর্তৃপক্ষ বারবার সমিতি বন্ধে নোটিশ দিয়ে আসছে এবং বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের কলম ও কণ্ঠরোধ করার উদ্দেশ্যেই ডিআইইউর এমন বহিষ্কারাদেশ।
[275756]
সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে তৈরি করা হয়েছে বলা হলেও এই আইনে অনেক ধোঁয়াশা আছে। আর এই ধোঁয়াশা কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত অনৈতিক ফায়দা অর্জন করার মত যথেষ্ট ঘটনা সামনে এসেছে। তাই সাংবাদিকতার মুখ চেপে ধরার চেষ্টা, মামলার হুমকি, ছাত্রত্ব কেড়ে নেয়ার মত স্বাধীনতা বিরোধী সব কানুন বাতিল হওয়া সময়ের দাবি।
মনে রাখতে হবে, আজ দেশের যাঁরা সাংবাদিকতায় ভালো করছেন, তাঁদের একটি বড় অংশের সাংবাদিকতার হাতেখড়ি কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিকতায় হয়েছিল। আজ ক্যাম্পাসে পড়াশোনা চলাকালীন যে অভিজ্ঞতা হচ্ছে, তা কাজে লাগিয়ে এই তরুণ সাংবাদিকরাই একসময় বাংলাদেশের মূলধারা সংবাদপত্রে বেশ দায়িত্বশীল ও পেশাদারির পরিচয় বহন করবেন। সম্মানিত শিক্ষক এবং কর্তৃপক্ষকে মনে রাখতে হবে, শ্রেণীকক্ষে একজন শিক্ষার্থীর বড় পরিচয় সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আর যখন সাংবাদিকতার পরিচয় বহন করবে, তখন তাদের গ্রহণযোগ্যতা দেশের সকল সাংবাদিকদের মতোই হবে।
লেখক: আইনজীবী ও কলামিস্ট ইংল্যান্ড, ইউনাইটেড কিংডম।
ইএইচ