বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ কতটা প্রাসঙ্গিক?

ড. শিকদার ওয়াহিদুজ্জামান প্রকাশিত: মে ৬, ২০২৪, ১০:১৩ পিএম

সারাদেশে সরকারি সকল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি বিদ্যমান আছে। সে সকল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কখনো কখনো কোনো দুর্ঘটনা ঘটে না তা কিন্তু নয়। আর সে কারণে ঐ সকল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি কিন্তু বন্ধ করা হয়নি। মতের অমিল কিংবা বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব প্রায় সবজায়গাতেই আছে।

দেশে আইন আছে। কেউ কোনো অপরাধ করলে তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে। বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। তার জন্য গোটা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধকরণ দাবি কতটা যৌক্তিক সেটা ভেবে দেখা মোক্ষম সময় এখন।

আমাদের দেশে ছাত্র রাজনীতির একটা ঐতিহাসিক বাস্তবতা ও ভূমিকা রয়েছে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও দেশের স্বার্থে ছাত্ররা বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনের মাধ্যমে সাফল্য ছিনিয়ে এনেছে। একদিনে বা রাতারাতি কেউ দেশের নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন করতে পারে না।

ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে ছাত্ররা রাজনীতির প্রথম পাঠ অনুশীলন করে। অভ্যস্ত হয়, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করে এবং প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়। যারা পরবর্তীকালে দেশ সেবা ও রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে ভূমিকা রাখতে পারে। কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনো সমস্যা হলে সেই সমস্যার সমাধান করা প্রয়োজন। তবে শুধুমাত্র সেই কারণে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা সমীচীন কিনা সেটা অবশ্যই বিবেচনার দাবি রাখে।

ফিরে দেখি ইতিহাসের পাতায়-

২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বুয়েট শাখার সদস্যদের হাতে নিহত হন বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ। এই হত্যার ঘটনায় গোটা দেশ কেঁপে উঠে। এবং তাদের অনুগামীরা। ছাত্রলীগ এ ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে জড়িত সদস্যদের বহিষ্কার করে। এরপর থেকে বুয়েট ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ করা হয় ছাত্র রাজনীতি। শুধু আবরারই এমন হত্যার শিকার নন। ২০০২ সালে বুয়েট ছাত্রদলের ২ গ্রুপের গোলাগুলির মাঝে পরে নিহত হন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী সাবেকুন নাহার সনি। ২০১৩ সালে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী আরিফ রায়হান দ্বীপকে। এমন আরও উদাহরণ আছে। প্রশ্ন জাগে, যে দেশের স্বাধীনতায় ছাত্ররাজনীতির গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে, সেখানে ছাত্র রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব ঠেকাতে এটি নিষিদ্ধ করাই কি একমাত্র সমাধান?

ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে নানা বিষয়ে বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে এবং শিক্ষার্থীদের নানা সমস্যা সমাধানে ছাত্র সংগঠনগুলোর ভূমিকা থাকে। সব রাজনৈতিক দলকে একই কাতারে ফেলা বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা চাওয়া খুবই সহজ কাজ। কিন্তু সত্যিকারে প্রয়োজন হচ্ছে ছাত্র রাজনীতির ফলে সৃষ্ট সমস্যা ও সমস্যা সৃষ্টিকারীদের চিহ্নিত করা এবং এসব সমস্যার সমাধান করা। তবেই ছাত্ররাজনীতির যে চেতনায় আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, সেই চেতনা স্বাধীন এই দেশকে এগিয়ে নিতে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।

২০০২ সালে ছাত্রদলের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের মধ্যে ক্রসফায়ারে পড়ে বুয়েটের শিক্ষার্থী সাবেকুন নাহার সনি নিহতের পরও বড় রকমের আন্দোলন সংগঠিত করেছিল শিক্ষার্থীরা। 

ওই আন্দোলনের পরে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে ছাত্রদলের কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবি তুলেছিলেন শিক্ষার্থীরা। আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো সংগঠনকে প্রশাসন নিষিদ্ধ না করলেও আন্দোলনের কারণে ছাত্রদল ‘কোণঠাসা’ হয়ে পড়ার কথা জানিয়েছেন তখনকার ছাত্র নেতারা। ২০০২ সালের ৮ জুন বুয়েটে দরপত্র নিয়ে ছাত্রদলের দুই পক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান কেমিকৌশল বিভাগের ৯৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী সনি। ছাত্র রাজনীতির পথ খুলল বুয়েটে, শিক্ষার্থীদের শঙ্কা কাটবে কীভাবে বুয়েট ছাত্রদল সভাপতি মোকাম্মেল হায়াত খান মুকি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হলের টগর গ্রুপের সংঘর্ষের মধ্যে পড়েছিলেন তিনি।  দীর্ঘ আন্দোলনের পর আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। বিচারে নিম্ন আদালতে মুকি, টগর ও নুরুল ইসলাম সাগরের মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়। ২০০৬ সালের ১০ মার্চ হাই কোর্ট তাদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বাতিল করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। এ ছাড়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত এসএম মাসুম বিল্লাহ ও মাসুমকে খালাস দেয় হাই কোর্ট। মুকি পরে পালিয়ে যান অস্ট্রেলিয়ায়। সাগরও পলাতক রয়েছেন। কারাগারে রয়েছেন টগর।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত দল জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রকাশ্যে কর্মকাণ্ড চালাতে পারছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রকাশ্যে কর্মকাণ্ড চালাতে গিয়ে তারা প্রতিরোধের মুখে পিছু হটে। এমন অবস্থায় বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ থাকাটা শিবিরের জন্য সংগঠন গোছানোর সুযোগ হিসেবে দেখা দিয়েছে। তারা ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রতিরোধ ছাড়াই তৎপরতা চালিয়ে যেতে পারছে। বুয়েটের একাধিক সূত্র মতে, মূলত নেতিবাচক ছাত্ররাজনীতি নিয়ে হতাশা থেকেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনেকে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধে সমর্থন দিচ্ছেন। আর সাধারণ শিক্ষার্থীদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের শক্তিশালী করছে হিযবুত তাহরীর ও শিবির।

সম্প্রতি ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার যে দাবি উঠেছে, তার প্রাসঙ্গিকতা এককথায় নস্যাৎ করাও সম্ভব নয়। সম্প্রতি বুয়েট কর্তৃপক্ষ ওই ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে; শিক্ষকদেরও রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করেছে। ছাত্র–শিক্ষক উভয়েই এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করেছেন। কোনো কোনো সাবেক ছাত্রনেতা এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন, কিন্তু আমার মনে হয়, জনমত যাচাই করলে দেশের অধিকাংশ মানুষই এই দাবি সমর্থন করবে। এটা স্বীকার করেও আমার মনে হয় ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব শুধু নাগরিক অধিকারবিরোধী নয়, নির্বুদ্ধিতাও। আজ সহিংসতার কারণে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা হলে দুদিন পর একই কারণে শ্রমিকদের রাজনীতিও বন্ধ করা হতে পারে। ‘ক্ষতিকর’ বিবেচনায় পরিবেশবাদী বা নারী অধিকার সংগঠনের কার্যকলাপও নিষিদ্ধ হতে পারে। ইতিহাসের পাঠ থেকে আমরা জানি, নির্বাচিতভাবে রাজনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধের ভেতর দিয়েই শুরু হয় ফ্যাসিবাদ।

ছাত্রদের ক্ষেত্রে সমস্যা রাজনীতি নয়। সমস্যার কেন্দ্রে ক্যাম্পাসে ছাত্রসংগঠনের নামে জাতীয় রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর অবাধ অনুপ্রবেশ। নামে ছাত্রসংগঠন হলেও বাংলাদেশে কোনো ছাত্রসংগঠন প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো থেকে বিযুক্ত নয়। বস্তুত তারা প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়মাত্র। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাম্পাস রাজনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির এটাই প্রধান ভিন্নতা। ছাত্ররাই যদি সব প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন, তাহলে অবস্থা ভিন্ন হতো।

ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি সমর্থন করেন এমন অনেকের যুক্তি, ছাত্রদের কাজ লেখাপড়া করা, রাজনীতি করা নয়। উদাহরণ হিসেবে এঁরা আমেরিকার কথা বলে থাকেন। এঁদের ধারণা, আমেরিকায় শিক্ষার মান উন্নত, কারণ, সেখানে ছাত্ররাজনীতি নেই। ভুল, আমেরিকায় আগেও ছাত্ররাজনীতি ছিল, এখনো আছে। শুধু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, এখানে স্কুল পর্যায়েও ‘স্টুডেন্ট গভর্নমেন্ট’ রয়েছে, যার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীরা দেশের প্রধান রাজনৈতিক প্রশ্নগুলোতে বিতর্কের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়। এমনকি কোন খাতে কীভাবে অর্থ ব্যয় হবে, সে ব্যাপারেও কোনো কোনো বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নাক গলাতে পারে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোরও ক্যাম্পাসে নিজেদের ছাত্রসংগঠন আছে। যেমন কলেজ ডেমোক্র্যাটস অব আমেরিকা। আমেরিকার কেন্দ্রীয় ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে সংযুক্ত এই ছাত্রসংগঠনের সদস্যসংখ্যা এক লাখেরও বেশি। অন্য প্রধান দল রিপাবলিকান পার্টিরও আছে একই রকম ছাত্রসংগঠন। সুতরাং ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করাই সমাধান নয় বরং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা চর্চায় এবং আগামী প্রজন্মের জন্য সঠিক নেতৃত্ব উপহার দিতে অবশ্যই সঠিক নিয়মে ছাত্ররাজনীতি চলতে পারে। 

সর্বোপরি, বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ রাখা কোনো সমাধান নয়। নেতিবাচক ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে ইতিবাচক, মানসম্মত ছাত্ররাজনীতি গড়ে তুলতে হবে। তাহলে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট কিংবা শিক্ষার্থীদের নির্যাতিত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটবে না। কোনো প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ থাকাটা ক্ষতির। কিন্তু ছাত্ররাজনীতির যেসব নেতিবাচক বিষয় শিক্ষার্থীদের আক্রান্ত করে, সেগুলো বন্ধে রাজনৈতিক দলগুলোকে ভূমিকা নিতে হবে। বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা কেন ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে তা আমলে নিয়ে সেগুলোর সমাধান করতে হবে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ (অব.), সাবেক সচিব, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল এবং অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

ইএইচ