বিবেচনায় নিতে হবে প্রজন্ম- জেডকে: সতর্ক থাকতে হবে ষড়যন্ত্রকারীদের বিষয়ে

ড. প্রশান্ত কুমার রায় প্রকাশিত: আগস্ট ৩, ২০২৪, ১১:৫১ পিএম

আমরা সংঘাত চাই না, সংলাপ চাই- কোটা আন্দোলন সমাধানের পথে সরকারের স্পষ্ট অবস্থান। ছাত্রদের জন্য গণভবনের দুয়ার সব সময় খোলা- ঘোষণা প্রধানমন্ত্রীর। সকল ছাত্রদের নি:শর্ত মুক্তির নির্দেশও দিয়েছেন তিনি। এবার নিশ্চয়ই বরফ গলবে, অবসান হবে পরস্পরের মুখোমুখি অবস্থানের। ফিরবে স্বস্তি ও শান্তি। দীর্ঘ ১৫ দিনের আন্দোলন সংগ্রাম, দাবী ও তা আদায়, আদালত থেকে রাজপথ, পথে-বিপথে ছাত্র, যুবক ও পুলিশের জীবনাবসান- এখান থেকে পরিত্রানের পথ কোনটি? প্রথমে বিষয়টি সহজ ছিল, এখন যা পঙ্কিলে পরিণত হয়েছে। তারপরও হতাশ হবার কিছু নেই। সমস্যা থাকবে, তার সমাধানও থাকতে হবে। সমাজ দ্রুত বিবর্তীত হচ্ছে- আমাদেরও অনুরূপ নবাগত সমাজের চাহিদা ও চ্যালেঞ্জ পূরণে থাকতে হবে প্রস্তুতি।

সরকার ও সমাজকে বিবেচনায় নিতে হবে- সম্প্রসারণমান তথ্যপ্রযুক্তি ও বিশ্বায়নের মধ্যে বেড়ে উঠা নতুন প্রজন্ম, জেনারেশন- জেডকে (Gen-Z), যাদের বয়স ১২ -২৭ বছর। এই প্রজন্মই এখন বিশ্বের চালিকাশক্তির আসনে অধিষ্ঠিত। ইসরাইলের অমানবিক নির্যাতনের শিকার প্যালেস্টাইনিদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল খোদ আমেরিকার তরুণ প্রজন্ম যা বিশ^ব্যাপী বিস্তৃতি লাভ করে। এমনকি ইসরাইলের তরুণ প্রজন্ম তার দেশের এই সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। আমাদের উচিৎ নতুন প্রজন্মের নাড়ির গতি, হৃদস্পন্দন ও চাওয়া কি তা বোঝার চেষ্টা করা। সময় ও সংস্কৃতি দুটোই বদলে গেছে। সন্তান চিন্তা ও চেতনায় নিজেদের বৈশি^ক অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। পিতামাতাকে জ্ঞান দেয় এবং নিয়ন্ত্রণ করে। কারণ, প্রোলেতারিয়েত শ্রেণীর সন্তানেরা আজ লেখাপড়া শিখেছে, তাদের জ্ঞানের দরজা উন্মুক্ত হয়েছে। তাদের সংখ্যাই বেশি। আজ তারাই নতুন সংস্কৃতিতে সমাজ পরিবর্তনে নেতৃত্ব দিতে চলেছে- ফলে নতুন শ্রেণীসংগ্রামের অঙ্কুরোদ্গম হচ্ছে।

চলমান কোটা আন্দোলনকে যদি নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করা যায়, দুটি প্রকট দিক দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রণীত সাংবিধানিক ইকুইটি ও ন্যায়পরায়ণতার ওপর ভিত্তি করে আওয়ামী লীগ সরকারের গণমুখী শিক্ষা ও প্রযুক্তির সহজলভ্যতা, দারিদ্র্য বিমোচন এবং সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ব্যাপক সহযোগিতায় বেড়ে উঠা জেনারেশন- জেড বৈশ্বিক উন্মুক্ত চিন্তায় উদ্ভাসিত একটি তরুণ শ্রেণী। একইসাথে তারা বাংলাদেশী মা-বাবার কোলে-পিঠে বেড়ে উঠা স্নেহাষ্পদ ও আহ্লাদিত সন্তান। তাই তারা ঔচিত্যবাদী ও স্নেহশীল আচরণ প্রত্যাশী। পুলিশী শাসন বা আচরণ কোনভাবেই তাদের কাছে সহনীয় নয়। আমি আবারো বলছি, তাদের হৃদস্পন্দন ও ভাষা আমাদের অনুধাবন করতে হবে। অপ্রিয় হলেও এই সত্যকে আমরা অনুধাবন করতে পারিনি, ফলে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানেও সময়মতো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। যে ইস্যুটি সরকারের কোনো সমস্যাই নয়, সেটি পরিণত হলো কোমলমতি ছাত্রদের বন্দুকের নলের মুখে আত্মাহুতি এবং লাখো কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির এক নাটকীয় বিপর্যয়ে। বিশ্ব দরবারে ভুলুন্ঠিত হলো বাংলাদেশের ভাবমূর্তি। ক্ষতিগ্রস্থ হলো জাতীয় অর্থনীতি।

দ্বিতীয়, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার বিরুদ্ধে দেশি ও বিদেশি যে চক্র ছিল, তারা আজও বহাল তবিয়তে, এমনকি আরো বেশি শক্তি নিয়ে সুসংগঠিত। সাথে বেশকিছু রাজনৈতিক দল সক্রিয় রয়েছে যারা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে না। অর্থাৎ তারা গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করতে আগ্রহী নয়। বিকল্প কোন উপায়ে ক্ষমতায় যাবার পথ খোজে এবং সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। তারাও স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের সাথে এই আন্দোলনে ছদ্দবেশে ও সরাসরি আক্রমনাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। রাতারাতি তারা সরকারের অর্জনসমূহকে ধূলিস্মাৎ করাসহ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি সৃষ্টিতে পূর্ণভাবে সফল হয়েছে। সুরক্ষিত কারাগার দখল করে ৮২৬ জন কয়েদিকে মুক্ত করাসহ ৮৫টি আগ্নেয়াস্ত্র লুট করেছে। ১৯৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান, ১৯৭১ এর অসহযোগ আন্দোলন, এমনকি স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও এত ভয়ংকর নাশকতা ও অগ্নিসংযোগ ঘটেনি। এক্ষেত্রে গোয়েন্দা বাহিনীগুলোর ব্যর্থতা অত্যন্ত স্পষ্ট। তাদের কাছে কোনো আগাম তথ্য ছিল না তাই প্রস্তুতির প্রসংগই আসে না। উপরন্তু পুলিশ বাহিনীর কোনো কোনো সদস্য তরুণদেরকে প্রতিপক্ষ ভেবে অনরূপ প্রতিহিংসামূলক আচরণ করেছেন যা এই প্রজন্মকে আরও বেশি প্রতিবাদী ও একরোখা করে তুলেছে। তাদের প্রত্যাশা পুলিশ চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারী, ধর্ষণকারীদের ধরবে ও মারবে, পক্ষান্তরে আমাদের লালন করবে এবং রক্ষা করবে, মারবে কেন? আমরাতো দাবি আদায়ে আন্দোলন করছি। বাস্তবে পুলিশ মারছে সন্ত্রাসী হিসেবে, আর ছাত্র ভাবছে আমাকে মারবে কেন? দাবি ও আন্দোলন করাতো আমার অধিকার। 

এসবের মধ্যে দু-একটা যে ভিন্নরকম ও ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি তা নয়। এ ঘটনাগুলো দ্রুত সরকার ও আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদেরকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এসবের মাঝে সরকার পক্ষ থেকে নেতাদের কিছু বিশেষ্য ও বিশেষণ বিদ্রুপাত্মকভাবে উপস্থাপিত হওয়ার ঘটনায় বিরোধ আরও বেশি ব্যাপকতা লাভ করেছে। সব মিলিয়ে কোটা সংস্কার বিষয়ে সরকার ও আন্দোলনকারীরা একই সীমায় প্রায় শূন্য ব্যবধানের অবস্থান থেকে ছিটকে মুখোমুখি শত্রুপক্ষে পরিণত হয়ে গেল। বিষয়টি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন ছিল। যেটা সরকারের জন্য পজেটিভ ভেবে তারা প্রায় দেড় সপ্তাহের ছাত্র আন্দোলনকে গুরুত্ব সহকারে নেয়নি। সমস্যা এখানে- আমি আগেই বলেছি, জেনারেশন- জেড এর সেন্টিমেন্টকে বোঝার চেষ্টা করা হয়নি এবং এর বদলে গতানুগতিক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।  

ইতোমধ্যে আদালত থেকে আদেশ হয়েছে। সেমতে জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয় থেকে মাত্র ৭% কোটা রেখে গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। এখন ছাত্রদের খুশিমনে শ্রেণীকক্ষে ফিরে যাবার কথা। কিন্তু ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ সন্ত্রাসীদের দ্বারা ব্যাপক ধ্বংসাত্মক কাজকে আমলেই নিচ্ছে না তাঁরা তৃতীয় পক্ষের উস্কানী হোক বা নিজেদের গরজে হোক, নতুন ইস্যু- সরকারকে গুলিকরে ছাত্রহত্যার জন্য আসামীর কাঠগড়ায় দাড় করিয়েছে। এটিকে এখন জাতীয় ইস্যুতে রূপান্তরের পরিকল্পনা চলছে যার পিছনে ভয়ংকর ভবিষ্যৎ ওৎপেতে আছে। যথাসময়ে কারফিউ দেয়ায় শ্রীলংকান স্টাইলে সরকার পতনের নাটকটা মঞ্চস্থ করতে পারেনি, কিন্তু সে আশাও সরকারবিরোধী চক্র পরিত্যাগ করেনি। শ্রীলংকায় মৌলবাদী বা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি নেই, ক্ষমতার পরিবর্তনে জাতীর অস্তিত্ব বিলোপ হবার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু বাংলাদেশ এই বিষয়ে একেবারে গান-পয়েন্টে অবস্থান করছে। ইতোমধ্যে সরকার জামাত ও শিবিরের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেছে এবং গোয়েন্দা ও পুলিশী তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে যা অনেকাংশে তাদের কার্যক্রম দমনে সহায়ক হবে। তবে ভিতরে ভিতরে কঠিন কোনো আঘাত হানার বিষয়টিকে হালকাভাবে নেয়া যাবে না; সজাগ থাকতে হবে।    

দ্বিতীয়ত, শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীর মৃত্যু ও মায়েদের কোল খালি হওয়ায় গড়ে উঠা সেন্টিমেন্ট যতদ্রুত সম্ভব নিরসন করা প্রয়োজন। আন্দোলনরত এক ছাত্রীর বরাতে বলছি, “আমি তিন সন্তানের মা। আমিতো তাদের বকি, তারাও আমার সাথে বিবাদ করে- আমি সরি বলি। আমরাতো প্রধানমন্ত্রীর সন্তান। তিনি আমাদের কাছে নিয়ে কি একটু সরি বলতে পারে না!” এই মেয়েটির আকাক্সক্ষা ও দাবিটা বিবেচনা করে দেখার বিনীত অনুরোধ রইলো। নিবেদনটি করলাম, তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা সে কারণে- কারণ, তিনি ছাড়া এমন উদারতা ও ভালোবাসার কথা আর কারো কন্ঠে বেমানান- এটি শুধু তাঁর কন্ঠেই মানায়। এ লেখাটা টাইপ করার সময় টেলিভিশনের স্ক্রলে দেখলাম এই আন্দোলনকারী মেয়েটির আঙকাঙ্খা পূরণ হতে চলেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কথা বলার লক্ষ্যে আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য গণভবনের দুয়ার সবসময় খোলা বলে আহ্বান জানিয়েছেন। আমার বিশ্বাস স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিকে রুখে দিতে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে জাগ্রত সেকুলার ও প্রগতিশীল স্পিরিটকে কাজে লাগিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা নতুন ইতিহাস তৈরি করতে সক্ষম হবেন। যেমনটি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু, তরুণদের সাথে নিয়ে নতুন ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিলেন। অভ্যুত্থান ঘটেছিল বাংলাদেশ নামক এক স্বাধীন ভূখন্ড- একটি সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র। জীর্ণতা ও দুর্নীতিকে মুছে ফেলে, নতুন প্রজন্ম- জেনারেশন জেড এর হাত ধরে তৈরি হবে দুর্নীতি ও ক্ষুধামুক্ত স্মার্ট বাংলাদেশ- এই আকাঙ্ক্ষা রইলো।

লেখক: সাবেক সচিব ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

ইএইচ