শিল্পীদের রাজনৈতিক হাতিয়ার বানানোর সংস্কৃতি: একটি জাতীয় বিপর্যয়

জাফর ফিরোজ প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৪, ২০২৪, ১০:১৬ পিএম

শিল্প একটি দেশের সাংস্কৃতিক বিকাশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি কেবল সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং একটি সমাজের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা এবং ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি।

কিন্তু যখন শিল্পকে রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তখন তা জাতির জন্য একটি বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, এই প্রবণতা জাতির সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ।

বাংলাদেশের শিল্প ও রাজনীতি: ইতিহাসের পর্যালোচনা

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে শিল্প এবং সংস্কৃতি সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত শিল্পীরা জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে এবং সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিতে বড় ভূমিকা রেখেছেন। শিল্পের মাধ্যমে সমাজকে জাগ্রত করার ঐতিহ্য বাংলাদেশের সংস্কৃতির অংশ। তবে স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে শিল্পীদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের প্রবণতা দেখা গেছে, যা দেশের সাংস্কৃতিক অগ্রগতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

রাজনৈতিক প্রভাব এবং শিল্পের অপব্যবহার

বাংলাদেশের রাজনীতি বরাবরই তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও দলীয় বিভক্তিতে আবদ্ধ। এই পরিস্থিতিতে, রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়ই শিল্পীদের তাদের প্রচারণা এবং প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। উদাহরণস্বরূপ, বিভিন্ন নির্বাচনী প্রচারে গায়ক, অভিনেতা, এবং অন্যান্য জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বদের রাজনৈতিক শোডাউনে আনা হয়, যা তাদের সৃজনশীল কাজের সাথে সম্পর্কিত নয়। এই ধরনের ব্যবহার শিল্পীদের জন্য যখন বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায়, তখন তাদের স্বাধীন মতপ্রকাশের সুযোগ সীমিত হয়ে যায়।

শিল্পের উপর রাজনৈতিক চাপের নেতিবাচক প্রভাব

রাজনৈতিক চাপের ফলে শিল্পীরা অনেক সময় তাদের স্বাভাবিক সৃজনশীলতা হারিয়ে ফেলেন। তাদের কাজ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হলে, তারা আর সমাজের প্রকৃত চাহিদা এবং সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করতে পারেন না। এর ফলে শিল্পের গুণগত মানও হ্রাস পায়। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে নাট্যকলা, সঙ্গীত এবং চলচ্চিত্রে রাজনৈতিক প্রভাব দেখা গেছে, যা সৃজনশীলতার স্বাধীনতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

সামাজিক বিভাজন ও সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা

রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে শিল্প ব্যবহারের একটি বড় ক্ষতি হলো এটি সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করে। যখন একজন শিল্পী একটি রাজনৈতিক দলের মুখপাত্র হয়ে ওঠেন, তখন তার কাজ কেবলমাত্র দলীয় সমর্থকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। এটি তার সৃষ্টিশীল কাজকে সব শ্রেণীর মানুষের জন্য উপলব্ধ রাখার পরিবর্তে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জন্য নির্ধারিত করে দেয়। বাংলাদেশে দলীয় ভিত্তিতে শিল্পীদের বিভাজন এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের ফলে জাতীয় ঐক্যের পরিবর্তে বিভক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

শিল্পের প্রকৃত উদ্দেশ্য হারিয়ে যাওয়া

শিল্পের প্রধান উদ্দেশ্য হলো সমাজের প্রতিচ্ছবি হিসেবে কাজ করা এবং মানুষের আবেগ, সংস্কৃতি ও চিন্তার প্রকাশ ঘটানো। কিন্তু যখন শিল্পকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার জন্য ব্যবহার করা হয়, তখন এর প্রকৃত উদ্দেশ্য হারিয়ে যায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, যেখানে শিল্পের একটি গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে, সেখানে রাজনৈতিক প্রভাবের ফলে শিল্পের প্রকৃত রূপ এবং ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা অনেক সময় বাধাগ্রস্ত হয়

শিল্পীদের উপর চাপ ও নিরাপত্তার হুমকি

বাংলাদেশে অনেক সময় শিল্পীরা রাজনৈতিক সমর্থন বা বিরোধিতার কারণে নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হন। যারা সরকারের সমালোচনা করেন বা বিরোধী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন, তাদের উপর বিভিন্ন সময়ে চাপ সৃষ্টি করা হয় বা তারা নিষিদ্ধের সম্মুখীন হন। উদাহরণস্বরূপ, কিছু নাট্যকার, লেখক, চলচ্চিত্র পরিচালক এবং সংগীতশিল্পী যারা সরকারের সমালোচনা করেছেন, তাদের কাজ সীমাবদ্ধ করা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এটি শিল্পীদের স্বাধীনতা এবং সৃজনশীলতার উপর চাপ সৃষ্টি করে এবং তাদের কাজকে প্রভাবিত করে।

সমাধানের পথ: শিল্পের স্বাধীনতা রক্ষা

বাংলাদেশে শিল্পকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার বন্ধ করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:

শিল্পের স্বাধীনতা রক্ষা: শিল্পীদের উপর রাজনৈতিক চাপ কমিয়ে তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।

সাংস্কৃতিক সংস্থাগুলোর বিকেন্দ্রীকরণ: রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত সাংস্কৃতিক সংস্থা গঠন করতে হবে, যারা শিল্পীদের অধিকার রক্ষায় কাজ করবে।

জনগণের সমর্থন: সাধারণ মানুষের মধ্যে শিল্পের প্রকৃত উদ্দেশ্য এবং রাজনৈতিক প্রভাব থেকে এর মুক্তির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

আইনি সুরক্ষা: শিল্পীদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় এবং তাদের কাজকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে শক্তিশালী আইনি কাঠামো গঠন করতে হবে।

শিল্পীদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন দেশের কিছু সফল উদাহরণ রয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্যও একটি কার্যকর রোডম্যাপ হতে পারে। নিচে এই উদাহরণগুলোর আলোকে প্রস্তাবনা তুলে ধরা হলো:

ফ্রান্সের উদাহরণ: সাংস্কৃতিক সংস্থার বিকেন্দ্রীকরণ

ফ্রান্সের ক্ষেত্রে, সরকার সাংস্কৃতিক সংস্থাগুলোর বিকেন্দ্রীকরণে বিশ্বাস করে, যা শিল্পীদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেয়। দেশটি শিল্পকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে দূরে রাখতে একটি শক্তিশালী আইনি কাঠামো গঠন করেছে। ফ্রান্সে ‘Ministry of Cultur’ শিল্পীদের এবং তাদের কাজকে রক্ষা করে, যাতে তারা রাজনৈতিক চাপ ছাড়াই সৃজনশীল কাজ করতে পারে।

বাংলাদেশের জন্য প্রস্তাবনা: বাংলাদেশে শিল্প এবং সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে, যাতে তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকে। সরকারের উচিত একটি স্বাধীন সাংস্কৃতিক সংস্থা গঠন করা, যা শিল্পীদের সৃজনশীল কাজকে রক্ষা করবে এবং তাদের স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সুযোগ দেবে।

জার্মানির উদাহরণ: আইনি সুরক্ষা প্রদান

জার্মানি শিল্পীদের স্বাধীনতার ব্যাপারে একটি শক্তিশালী আইনি কাঠামো তৈরি করেছে। দেশটির সংবিধান শিল্প এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য নিশ্চিত সুরক্ষা দেয়। ফলে, রাজনৈতিক দলগুলো শিল্পীদের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। জার্মানির ‘Federal Commissioner for Culture and Media’ প্রতিষ্ঠানটি শিল্পীদের আইনি সুরক্ষা প্রদান করে।

বাংলাদেশের জন্য প্রস্তাবনা: বাংলাদেশের সাংবিধানিক কাঠামোতে শিল্পের স্বাধীনতার ব্যাপারে আরও পরিষ্কার নির্দেশনা থাকতে হবে। শিল্পীদের আইনি সুরক্ষা দিতে শক্তিশালী আইনি কাঠামো প্রয়োজন, যাতে তাদের রাজনৈতিক প্রভাব বা চাপ থেকে মুক্ত রাখা যায়। এই ক্ষেত্রে একটি ‘শিল্পী সুরক্ষা কমিশন’ গঠন করা যেতে পারে, যা শিল্পীদের অধিকার রক্ষা এবং তাদের কাজের সুরক্ষায় কাজ করবে।

নরওয়ের উদাহরণ: সরকারি ফান্ডিং এবং স্বাধীনতা

নরওয়েতে সরকার শিল্পকে আর্থিকভাবে সমর্থন করে, তবে শিল্পীদের সৃজনশীলতা এবং মতপ্রকাশে কোনো বাধা দেয় না। নরওয়ের ‘Arts Council Norway’ একটি স্বাধীন সংস্থা হিসেবে কাজ করে, যা সরকারের থেকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা এবং শিল্পীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। এর ফলে, শিল্পীরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকে।

বাংলাদেশের জন্য প্রস্তাবনা: বাংলাদেশেও একটি স্বাধীন ‘Arts Council’ গঠন করা যেতে পারে, যা শিল্পীদের কাজের সুবিধার্থে মেধার ভিত্তিতে আর্থিক অনুদান প্রদান করবে কিন্তু তাদের সৃজনশীলতায় হস্তক্ষেপ করবে না। এটি শিল্পীদেরকে স্বাধীনভাবে কাজ করার একটি নিরাপদ পরিবেশ দেবে এবং রাজনৈতিক চাপ থেকে মুক্ত রাখবে।

দক্ষিণ কোরিয়ার উদাহরণ: রাজনৈতিক সচেতনতা এবং জনসাধারণের সমর্থন

দক্ষিণ কোরিয়ায় শিল্প এবং রাজনৈতিক মতপ্রকাশের মধ্যে একটি শক্তিশালী সম্পর্ক আছে, যেখানে শিল্পীরা জনগণের সমর্থন নিয়ে কাজ করে। বিশেষ করে, কোরিয়ার ‘Candlelight Protests’ এর সময় শিল্পীরা তাদের কাজের মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিবর্তনের দাবিতে সমর্থন পেয়েছিল, তবে তা কোনো রাজনৈতিক দলের হাতিয়ার হয়ে ওঠেনি। জনগণের সমর্থনই এখানে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে।

বাংলাদেশের জন্য প্রস্তাবনা: বাংলাদেশের মতো একটি দেশে, যেখানে শিল্পীরা সবসময় সমাজের অগ্রগতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন, সেখানে শিল্পীদের স্বাধীন অবস্থান নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। শিল্পীদের কাজ হলো জনসাধারণের পক্ষে কথা বলা, তাদের কণ্ঠকে সামনে নিয়ে আসা, কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলের হাতিয়ার না হওয়া। এই প্রস্তাবনার লক্ষ্য হলো শিল্পীদের জন্য একটি দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা, যেখানে তারা জনতার মুখপাত্র হিসেবে ভূমিকা পালন করবে, কিন্তু কোন রাজনৈতিক দলের প্রচারণার অংশ হবে না।

কানাডার উদাহরণ: মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং শিল্পী অধিকার রক্ষা

কানাডায় শিল্পীদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আইন দ্বারা সুরক্ষিত। ‘Canada Council for the Arts’ শিল্পীদেরকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে, কিন্তু তাদের কাজের বিষয়বস্তুতে হস্তক্ষেপ করে না। এর ফলে, শিল্পীরা মুক্তভাবে তাদের চিন্তা-ভাবনা প্রকাশ করতে পারে এবং তারা রাজনৈতিক চাপমুক্ত থাকে।

বাংলাদেশের জন্য প্রস্তাবনা: বাংলাদেশেও শিল্পীদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় আইনি ও আর্থিক সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা থাকা উচিত। "শিল্পী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ" নামে একটি স্বাধীন সংস্থা গঠন করা যেতে পারে, যা শিল্পীদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে এবং তাদের বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিরোধে সহায়তা করবে।

উপসংহার

শিল্পের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সরকার, জনগণ এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন। বিভিন্ন দেশের উদাহরণ থেকে বোঝা যায়, রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত শিল্পী সমাজ গঠনের জন্য আইনি সুরক্ষা, স্বাধীন আর্থিক সহায়তা, এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশেও এই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করলে শিল্পীদের উপর থেকে রাজনৈতিক চাপ কমবে এবং তারা স্বাধীনভাবে তাদের সৃজনশীলতা প্রকাশ করতে পারবেন, যা একটি সুস্থ ও সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক সমাজ গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, কুয়ালালামপুর ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম একাডেমি এওয়ার্ডস।

ইএইচ