জুলাই - আগস্ট বিপ্লবের অন্যতম কর্মসূচি ছিল রাষ্ট্রের সংস্কার। বছরের পর বছর চলে আসা রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাঠামোর কোনোই পরিবর্তন কিংবা মেরামত কিছুই হয়নি। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি হচ্ছে প্রশাসন। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোয় জনবান্ধব করে গড়ে তুলতে কোনো সরকারের আমলেই কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। প্রশাসন একটি সেবামূলক কার্যক্রম সেই ধারণাও বাংলাদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় লেশমাত্র নেই। উল্টো রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতি প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে ভঙ্গুর করে রেখেছে।
বাংলাদেশের ভূখণ্ডের চাইতে মানুষের সংখ্যা বেশি, বিপুল এই জনগোষ্ঠীকে সেবার আওতায় আনতে একটি উন্নত ও আধুনিক প্রশাসন খুবই প্রয়োজন বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সেবার আওতায় আনতে মাঠ প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোর গুরুত্ব অনেক। যুগের পর যুগ মানুষ সেবাহীন হয়ে নাগরিকরা নিজের মতো করে চলে। রাষ্ট্রের সেবা তাদের স্পর্শ করে না৷ অথচ গণতান্ত্রিক শাসনের প্রধান সুফল পাওয়ার কথা ছিল জনগণের জন্য প্রশাসন। কিন্তু অত্যন্ত বেদনাদায়ক যে, ৫০ দশকে জনগণ তাঁর রাষ্ট্রের স্বাদ আস্বাদন করেনি।
প্রশাসনিক কাঠামোর সংস্কার করে জনবান্ধব প্রশাসন গড়তে নিম্নলিখিত প্রস্তাবনা পেশ করছি :
ক. প্রশাসনের সেবা প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছাতে তা শুরু করতে হবে ইউনিয়ন পর্যায় থেকে। তাই বিসিএস প্রশাসনে নিয়োগ সুপারিশ প্রাপ্তির পর ইউনিয়ন নির্বাহী কর্মকর্তা বা Union executive officer ( UEO) হিসেবে কর্মস্থল শুরু হবে। সেক্ষেত্রে প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্সে আলাদা কার্যালয় থাকবে ইউনিয়ন নির্বাহী কর্মকর্তার।
খ. একজন ইউনিয়ন নির্বাহী কর্মকর্তা কর্মস্থলে যোগদান করার পর ন্যূনতম তিন বছর থাকবেন ইউনিয়ন প্রশাসক হিসেবে। এরপর তাকে ডিপুটি ইউএনও হিসেবে উপজেলা প্রশাসনে পদায়ন করা হবে। সেখানে ইউএনওর সাপোর্ট হিসেবে এবং ইউএনওর বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট দেখতে ন্যূনতম তিনজন ডিপুটি ইউএনও থাকবেন। তারপর ডিপুটি ইউএনও থেকে সফলভাবে যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে ইউএনও হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হইবেন। এইভাবে ইউএনও পরবর্তীতে জেলার সহকারী ডিসি তারপর ডিসি এভাবে ন্যূনতম তিন বছর মেয়াদ করে কাজ করবেন। আর এভাবে একজন যোগ্য প্রশাসক হিসেবে নিজ যোগ্যতা এবং দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারবেন।
গ. উপজেলা এসিল্যান্ড মাঠ প্রশাসনের আওতা হইতে বের করে এনে ভূমি - মন্ত্রণালয়ের আওতায় সম্পৃক্ত করতে হবে।
ঘ. মাঠ প্রশাসনের কার্যক্রম গতিশীল করতে ইউনিয়ন পরিষদের কমপ্লেক্সে ইউনিয়ন নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসকে অনলাইন সেবার আওতায় আনতে হবে। সেখানে সংশ্লিষ্ট সকল নাগরিকদের বিস্তারিত তথ্য থাকবে।
ঙ. মাঠ প্রশাসন প্রতি মাসে ইউনিয়নের সকল আইনশৃঙ্খলা তথ্য, দুর্যোগ মোকাবেলা, শিক্ষা, কৃষি, স্বাস্থ্য সহ গ্রামীণ অর্থনীতির একটি নির্দিষ্ট ফরম্যাটের রিপোর্ট উপজেলা প্রশাসনে প্রদান করবেন। প্রতিমাসে উপজেলা প্রশাসনের মিটিং এ ইউনিয়ন প্রশাসনের রিপোর্ট পর্যালোচনা হবে এবং সেই আলোকে পরবর্তী মাসে কাজের দিকনির্দেশনা প্রদান করবেন ইউএনও।
চ. প্রতি বছর পর পর ২ দিন ব্যাপী প্রশিক্ষণ নিতে বাধ্য থাকিবেন ইউনিয়ন নির্বাহী কর্মকর্তারা। যা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিভাগ ভিত্তিক এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে। সেই প্রশিক্ষণে প্রশাসন, জনসেবা, আইটি, পরিসংখ্যান, আইনশৃঙ্খলা, ক্রিমিনোলজি, সোশ্যাল সায়েন্স, মানবাধিকার ইত্যাদি বিষয়ে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ দেওয়া হইবে। আর এই প্রশিক্ষণ পরবর্তী ছয়মাসে মাঠ প্রশাসনে প্রয়োগ করবে ইউনিয়ন নির্বাহী কর্মকর্তারা।
ছ. সেবার প্রয়োজনে সাধারণ যে কোন মানুষ অনলাইনে আবেদন করে ইউএনও এবং ডিসির সাথে সাক্ষাৎ করার সাপ্তাহিক একটি নির্দিষ্ট দিন ধার্য থাকিবে। সেখানে সেবাপ্রার্থীরা ইনস্ট্যান্ট কিছু বিষয়ে সেবা পেয়ে থাকবেন।
জ. ডিসিরা প্রতিমাসে অন্তত একবার উপজেলা প্রশাসন সফর করিবেন এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিবেন।
ঝ. বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইনশৃঙ্খলা এবং কর্মসংস্থান এই পাঁচটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে মাঠ প্রশাসন অন্যান্য কাজের পাশাপাশি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট