রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগেও নারীরা নামাজের জন্য, দৈনন্দিন কাজের প্রয়োজনে, এমনকি জিহাদে অংশ নিতেও ঘর থেকে বের হতেন। তবে তাঁরা বের হতেন আল্লাহর নির্দেশ ফরজ পর্দা মান্য করে এবং নবীজি (সা.)-এর নির্দেশিত সুন্নত পোশাক পরিধান করে। তাঁদের পোশাকের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল—তা ফেতনা ছড়িয়ে দিত না, পুরুষদের প্রলুব্ধ করত না এবং তা নারীর প্রতি সম্মানবোধ বাড়িয়ে তোলে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মানবসন্তান, তোমাদের লজ্জাস্থান ঢাকার ও বেশভূষার জন্য আমি তোমাদের পোশাক দিয়েছি এবং তাকওয়ার পরিচ্ছদই সর্বোত্কৃষ্ট।
’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ২৬)
কোরআনের নির্দেশনা : নারীর পোশাকের ব্যাপারে কোরআনের নির্দেশনা হলো, তাঁরা এমন পোশাক পরিধান করবেন, যা তাঁদের ব্যক্তিত্বের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করবে, তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তার স্বার্থে সহায়ক হবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘মুমিন নারীদের বোলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে ও তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে; তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশ থাকে তা ছাড়া তাদের আভরণ প্রদর্শন না করে। ’ (সুরা নুর, আয়াত : ৩১)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে নবী, স্ত্রীদের, কন্যাদের ও মুমিনদের নারীদের বোলো, তারা যেন তাদের চাদরের কিছু অংশ নিজেদের ওপর টেনে দেয়। এতে তাদের চেনা সহজতর হবে, ফলে তাদের উত্ত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। ’ (সুরা আহজাব, আয়াত : ৫৯)
নারীদের পোশাকের মৌলিক বৈশিষ্ট্য : ইসলামের দৃষ্টিতে শরীর ও শরীরের অবয়ব প্রকাশ পায়—এমন পাতলা কাপড় পরিধান করা নারীদের জন্য নিন্দনীয়। হাদিসে এসেছে, ‘হাফসা বিনতে আবদুর রহমান (রা.) একটি পাতলা ওড়না পরে আয়েশা (রা.)-এর ঘরে প্রবেশ করলে তিনি তা সরিয়ে মোটা কাপড়ের ওড়না পরিয়ে দেন। ’ (মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস : ৬৬)
অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘এমন নারী যারা পোশাক পরিধান করেও উলঙ্গ, যে নিজেও পথভ্রষ্ট এবং অন্যকে পথভ্রষ্ট করে। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। অথচ জান্নাতের ঘ্রাণ পাঁচ শ বছরের দূরত্ব থেকে পাওয়া যায়। ’ (মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হাদিস : ১৬৬১)
এ ছাড়া আহকামুন নিসা গ্রন্থকার নারীদের ইসলামী পোশাকের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। যেমন ক. নারীদের পোশাক পুরুষসুলভ না হওয়া, খ. নারীদের জন্য (জামা-পা অধিক নিরাপদ পোশাক। তবে) শাড়ি পরিধান করাও জায়েজ, গ. এমন আঁটসাঁট পোশাক পরিধান না করা উচিত, যাতে শরীরের অবয়ব প্রকাশ পায়, ঘ. নারীদের জন্য সব ধরনের সুতা ও রেশমের কাপড় পরিধান করা বৈধ ইত্যাদি। (আহকামুন নিসা, পৃষ্ঠা ৫২৯)
চলাফেরায় অসুবিধা হয় এমন পোশাক নয় : ইসলাম নারীদের শালীন ও সভ্য পোশাক পরিধানের নির্দেশ দিয়েছে। তবে ইসলাম নারীকে এমন পোশাক পরিধান করতে বলেনি, যাতে তার স্বাভাবিক চলাফেরা ব্যাহত হয়। একবার নবী (সা.)-এর স্ত্রী উম্মে সালমা (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে প্রশ্ন করলেন, যখন তিনি পরিধেয় বস্ত্র সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন, হে আল্লাহর রাসুল, নারীদের ইজার (লুঙ্গিবিশেষ) ব্যবহারের বিধান কী? তিনি বললেন, তারা এক বিঘত নিচে পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখতে পারে। উম্মে সালমা (রা.) বলেন, এতেও তার কিছু অংশ খোলা থাকবে। তিনি বললেন, তবে এক হাত ঝুলিয়ে পরবে; এর বেশি নয়। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৪১১৭)
রুচিশীল ও আরামদায়ক পোশাক পরিধান : নারীদের সুন্দর, রুচিশীল ও আরামদায়ক পোশাক পরিধান করার অনুমতি দেয়; বরং নারীদের পোশাকে সৌন্দর্যবর্ধক কারুকাজ ও নকশাকে উৎসাহিত করে। আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মেয়ে উম্মে কুলসুমের গায়ে হালকা নকশা করা রেশমি চাদর দেখেছেন। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৮৪২)
ব্যক্তিগত সাজসজ্জায় উৎসাহ : ইসলাম নারীদের ব্যক্তিগত সাজসজ্জাকে উৎসাহিত করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) নারীদের পরিপাটি থাকতে উৎসাহিত করেছেন। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘এক নারী আড়াল থেকে একটি কিতাব হাতে নিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দিকে বাড়িয়ে দিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর হাত না বাড়িয়ে বললেন, আমি বুঝতে পারছি না এটা কোনো পুরুষের হাত নাকি নারীর হাত? সে বলল, বরং নারীর হাত। তিনি বললেন, তুমি নারী হলে অবশ্যই তোমার নখগুলো মেহেদির রং দ্বারা রঞ্জিত করতে। ’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৪১৬৬)
ইসলাম নারীর সাজসজ্জায় রংকে প্রাধান্য দিয়েছে এবং পুরুষের সাজসজ্জায় সুগন্ধিকে। নারীদের ঘরের বাইরে সুগন্ধি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘পুরুষদের সুগন্ধি হলো, যার সুগন্ধি স্পষ্ট কিন্তু রং চাপা আর নারীদের সুগন্ধি হলো, যার রং স্পষ্ট কিন্তু গন্ধ চাপা। ’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৫১১৭)
সন্তানকে শালীন পোশাকে অভ্যস্ত করা : ইসলাম ছেলে ও মেয়ে উভয়কে শালীন ও ভদ্র পোশাক পরিধান করার নির্দেশ দিয়েছে, বিশেষত যখন তারা সাবালক হয়ে উঠবে। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার আয়েশা বিনতে আবি বকর (রা.) পাতলা কাপড় পরিহিত অবস্থায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এলে রাসুলুল্লাহ তার থেকে নিজের মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলেন, ‘হে আসমা, মেয়েরা যখন সাবালিকা হয়, তখন এই দুটি অঙ্গ ছাড়া অন্য কোনো অঙ্গ প্রকাশ করা তার জন্য সংগত নয়; এই বলে তিনি তাঁর চেহারা ও দুই হাতের কবজির দিকে ইশারা করেন। ’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৪১০৪) ইমাম গাজালি (রহ.)-সহ দার্শনিক আলেমরা বলেন, মা-বাবার দায়িত্ব হলো সন্তানকে শৈশব থেকে শালীন ও ভদ্র পোশাকে অভ্যস্ত করা। যেন তারা বড় হওয়ার পরও এমন পোশাক পরতে আগ্রহ বোধ করে। আল্লাহ সবাইকে রুচিশীল ও আদর্শ পোশাক পরিধানের তাওফিক দান করুন। আমিন।
আমারসংবাদ/আরইউ