সিয়াম সাধনা তথা রমদানুল মুবারকের সামাজিক গুরুত্ব

মুহাম্মদ আল্-হেলাল প্রকাশিত: মার্চ ২৫, ২০২৪, ০৩:১১ পিএম

মানব ও জীন জাতিকে সৃষ্টি করেছেন মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা এবং সৃষ্টির উদ্দেশ্য বিষয়ে স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা পবিত্র কুরআনে সূরা আয-যারিয়াতের ৫৬ নং আয়াতে বলেন “আমি জীন ও মানবজাতিকে শুধু আমার দ¦াসত্বের জন্যই সৃষ্টি করেছি।”

এ আয়াত থেকে বুঝা যায় মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা জীন ও মানবজাতীকে সৃষ্টি করেছেন শুধু তার দ¦াসত্ব বা ইবাদতের জন্য অন্য কোন কাজের জন্য নয়। কিন্তু পবিত্র মহাগ্রন্থ কুরান মাজীদের সূরা জুমআহ্ এর ১০ নং আয়াতে ঘোষণা করেন “যখন তোমাদের নামাজ শেষ হয় তখন তোমরা দুনিয়ার বুকে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ অনুসন্ধান কর আর আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ কর সম্ভবত তোমরাই সফলকাম হবে।”

এ আয়াত দ্বারা বুঝা যাচ্ছে শুধু নামাজ আদায় করলেই চলবে না সফল হতে দুনিয়ার বুকে ছড়িয়ে পড়তে হবে এবং আল্লাহর অনুকম্পার অনুসন্ধান করতে হবে তবে মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালাকে ভুলে গিয়ে নয় বরং তাঁকে অধিক পরিমাণে স্মরণে রেখে অর্থাৎ আল্লাহর প্রদত্ত সংবিধান অনুযায়ী কোন ভাবেই মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার সংবিধানের বাইরে যাওয়া যাবেনা। 

সফলতা কীভাবে পাওয়া যাবে তা এই আয়াতে মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলে না দিলেও বিজ্ঞানময় কোরানের সূরা আশ-শামসের ৯ নং আয়াতের মধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন “সেই সফলকাম হয়েছে যে পরিশুদ্ধতা অর্জন করেছে।” অন্যদিকে বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন “দুনিয়ার কাজে এমনভাবে মশগুল হও যেন তুমি সারাজীবন বেচে থাকবে এবং আখিরাতের কাজে এমনভাবে মশগুল হও যেন আগামীকালই তোমার মৃত্যু হবে।” 

একথাটি বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায় দুনিয়ার কাজ এমনভাবে গুরুত্ব সহকারে করতে হবে যেন সারাজীন বেচে থাকলেও অভাব হবেনা আর আখিরাতের কাজ এমনভাবে গুরুত্ব সহকারে করতে হবে যেন আগামীকাল মৃত্যু হলেও পরকালীন মুক্তি পাওয়া যায়।

উপরিউক্ত আলোচনার মাধ্যমে প্রতীয়মান হলো দুনিয়ার এবং আখিরাতের উভয় কাজই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং উভয় কাজই মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার প্রদত্ত সংবিধান অনুযায়ী করতে হবে তাহলেই সেটি আমাদের ইবাদত হিসাবে কবুল হবে মহান আল্লাহর দরবারে। কেননা মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আমাদের শুধু তাঁর ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছেন।

এমনিভাবে ইবাদতের মাধ্যমেই আমরা দুনিয়ায় শান্তি এবং পরকালীন মুক্তি পেতে পারি। সিয়াম এমনই একটি কর্মসূচি তথা ইবাদত যেটি যথাযথভাবে পালনের মাধ্যমে আমরা উভয়জীবনের মুক্তি আশা করতে পারি। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা সূরা বাকারার ১৮৩ নং আয়াত দ্ধারা আমাদের উপর রোযা ফরজ করেছেন যেমন  তিনি ঘোষণা করেন “হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য রোযা ফরজ করা হয়েছে যেমনভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছে যেন তোমরা মুত্তাকী হতে পার।”

এখানে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা জানিয়ে দিলেন ইমানদারদের সম্বোধন করে যে এটা তোমাদের জন্য নতুন আরোপিত কিছু নয় বরং তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপরও রোযা ফরজ করা হয়েছিল তাক্কওয়া অর্জন করার জন্য। এতে প্রমাণিত হয় মুত্তাকী হওয়ার অন্যতম একটি পন্থা হলো সিয়াম সাধনা করা। সিয়াম সাধনা যারা করেন এবং মুত্তাকী হন তাদের মর্যাদা আল্লাহ তায়ালার নিকট যেমন বৃদ্ধি পায় সমাজেও তেমন বৃদ্ধি পায়।

সুতরাং সিয়াম সাধনা বা রমদানুল মুবারকের যেমন রয়েছে পরকালীন গুরুত্ব তেমন রয়েছে ইহকালীন গুরুত্ব। ইহকালীন গুরুত্বের মধ্যে সামাজিক গুরুত্ব অপরিসীম। সিয়াম সমাজ থেকে ক্ষুধা, দারিদ্রতা, অভাব ইত্যাদি দূর করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যেমন সূরা বাকারার ১৮৪ নং আয়াতের ঘোষণা করেন-“(সিয়াম)নির্দিষ্ট কয়েকটি দিনের জন্য তোমাদের মধ্যে যদি কেউ অসুস্থ বা সফরে থাকে তবে অন্যসময়ও এ সংখ্যা পূরণ করে নিতে পারে। 

আর যার পক্ষে সিয়াম পালন করা কষ্টকর সে একজন মিসকিন কে খাদ্য দান করবে। তবে যদি কেউ স্বেচ্ছায় ভালো কাজ করে তবে তা তার জন্য হবে অধিক কল্যাণকর। এবং যদি তোমরা সিয়াম পালন করতে পার সেটি তোমাদের জন্য অধিক কল্যাণকর যদি তোমরা তা উপলব্ধি করতে পার।”

আয়াতের হুকুম হলো সিয়াম একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ঐ নির্দিষ্ট সময়ে যদি কেউ অসুস্থ বা সফরে থাকে তাহলে সে অন্য সময় সে সংখ্যাটি পূরণ করবে আর যার পক্ষে সিয়াম পালন করা কষ্টকর সে যেন মিসকিন কে খাদ্য প্রদান করে আবার কেউ যদি সিয়াম পালন করে এবং মিসকিন কে খাদ্য প্রদান করার মত পুণ্যের কাজ করে সেটি অধিক কল্যাণকর তবে সিয়াম সাধনা করতে পারলে সেটি আরো কল্যাণকর যদি আমরা উপলব্ধি করতে পারি।

উক্ত আয়াত দ্বারা মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা সিয়ামের বিকল্প বা অধিক পুণ্যের কাজ হিসাবে মিসকিনকে খাদ্য প্রদানে উৎসাহিত করেছেন। যেটা নিঃসন্দেহে সমাজ থেকে ক্ষুধা, দারিদ্রতা, অভাব দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে গরীব-মিসকীনরা অভাবের কারণে যে ক্ষুদার কষ্ট পায় এই পবিত্র সিয়াম সাধনার মাধ্যমে ধনীরাও ক্ষুদার কষ্ট অনুভব করতে পারে ফলে সমাজের ধনীরা গরীব-মিসকীনদের বেশি বেশি দান করতে উৎসাহি হয় এবং সিয়াম সমাজ থেকে অভাব, দারিদ্রতা দূরিভীত করে সমাজের গরিব-মিসকিনদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতঃ সমাজে অর্থনৈতিকভাবে সমতা আনয়ন করে।

অন্যদিকে সমাজ থেকে ক্ষুদা-দারিদ্রতা দূরীকরণ এবং সমাজে অর্থনৈতিক সমতা নিরূপণের জন্য দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার পর এবং ঈদুল ফিতরের পূূর্বে মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ফিতরা প্রদানে উৎসাহী করেছেন। পবিত্র কোরানের সূরা আল-আ’লার ১৪ নং আয়াতের মধ্যে মহান আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন “সেই সফলকাম হয়েছে যে পরিশুদ্ধতা অর্জন করেছে।”

এখানে সিয়াম সাধনা শেষে গরিব-মিসকিনদের ফিতরা প্রদানকে ইঙ্গিত করেছেন। রমদানুল মুবারকের গুরুত্ব তুলে ধরে মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা পবিত্র কোরানের সূরা বাকারার ১৮৫ নং আয়াতে ঘোষণা করেন “রমজান হলো এমন একটি মাস যে মাসে নাজিল করা হয়েছে মহাগ্রন্থ আল্-কুরান যাতে রয়েছে মানুষের জীবন বিধান এবং মানুষের সৎপথে চলার জন্য সুস্পষ্ট নিদর্শন যেটি সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী। 

সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে এ মাসটি পাবে সে যেন অবশ্যই রোযা রাখে। এবং যে অসুস্থ বা সফরে থাকে সে যেন অন্য সময় এসংখ্যা পূরণ করে। মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা তোমাদের কাজকে সহজ করতে চান তিনি তোমাদের কষ্ট দিতে চাননা। আল্লাহ চান তোমরা যেন রোজা পূরণ করতে পার এবং তোমাদের সঠিক পথে পরিচালনা করার জন্য আল্লাহর মাহাত্ম্য ঘোষণা করতে পার। সম্ভবত তোমরা আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে।’’

এদিকে হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে যে “সিয়াম ঢাল স্বরূপ। সুতরাং অশ্লীলতা করবেনা এবং মূর্খের মত কাজ করবেনা। যদি কেউ তার সাথে ঝগড়া করতে চায় তবে সে যেন দুইবার বলে যে আমি সিয়াম পালন করছি। ঐ সত্ত¡ার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ, নিশ্চয় সিয়ামপালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিশকের সুগন্ধির থেকেও উৎকৃষ্ট সে আমার জন্য আহার, পান ও কামাচার পরিত্যাগ করে সিয়াম আমারই জন্য তাই এর প্রতিদান আমি নিজেই প্রদান করব। আর প্রত্যেক নেক কাজের বিনিময় দশগুণ।” (হাদীস নং-১৮৯৪)

এ হাদীস দ্ধারা রাসুল সা. সিয়াম পালনকারীকে অশ্লীলতা, মূর্খতা, গালিগালাজ, ঝগড়া বিবাদ ইত্যাদি করতে নিষেধ করেছেন যেটি সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টির মুখ্য ভূমিকা পালন করে। আবার অন্য কেউ যদি সিয়াম পালনকারীর সাথে বিবাদ করতে চায় ঐ সিয়াম পালনকারী যেন নিজেকে দুইবার সিয়াম পালনকারী হিসাবে পরিচয় দেয়। সুতরাং সিয়াম সমাজ থেকে বিশৃঙ্খলা দূরীকরণেও অনন্য ভূমিকা পালন করে।

হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত ১৮৯৮ নং হাদীসে রাসুল সা. বলেছেন “যখন রমজান মাস আসে তখন জান্নাতের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়” আর উক্ত সাহাবী কর্তৃক বর্ণিত ১৮৯৯ নং হাদীসে রাসুল সা. বলেন “রমজান মাস আসলে আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমুহ বন্ধ করে দেওয়া হয় আর শয়তানগুলোকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়।”

এ হাদীস দুটি দ্ধারাও রমদানুল মুবারকের যে সামাজিক গুরুত্ব অপরিসীম তা ফুটে ওঠে। এদিকে মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা পবিত্র কুরানের সূরা কদরে ঘোষণা করেছেন “১. নিশ্চয় আমি কুরানকে নাজীল করেছি মহিমান্বিত রজনীতে। ২. আপনি কি জানেন মহিমান্বিত রজনি কি? ৩. মহিমান্বিত রজনি হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। ৪. সেই রাতে ফিরিস্তাকুল এবং জীব্রাঈল আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে প্রত্যেকটি কাজের জন্য অবতীর্ণ হন। ৫. ঊষার আবির্ভাব পর্যন্ত সেই রজনি শান্তিময় থাকে।” 

রমজান মাসে হাজার মাসের শ্রেষ্ঠ লাইলাতুল কদর এবং মানবজাতীর জীবন বিধান আল্-কুরান নাজিল করে রমদানুল মুবারকের আধ্যাত্যিক মর্যাদার সাথে সামাজিক মর্যাদা বহুগুণে বৃদ্ধি করেছেন মহান আল্লাহ তায়ালা।

অন্যদিকে মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা দাম্পত্য থেকে পারিবারিক তথা সামাজিক সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা হিসাবে সিয়াম পালনের কথা বলেছেন। যেমন যিহার একটি দাম্পত্য বিষয়ক সমস্যা হলেও সেটি পারিবারিক থেকে সামাজিক সমস্যা পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। তাই এ বিষয়ে সূরা মুুজাদালাহ্ এর ৩ এবং ৪ নং আয়াতের ঘোষণা “৩. যারা তাদের স্ত্রীদের সাথে যিহার করে অতঃপর তারা তাদের কথা ফিরিয়ে নেয় তারা যেন একে অপরকে স্পর্শ করার পূর্বে একটি দাস মুক্তি দেয় এ আদেশ তোমাদের জন্য তোমরা যা কর আল্লাহ তার খবর রাখেন। ৪. কিন্তু যার এ সমর্থ নেই সে যেন একাধারে দুমাস রোযা রাখে একে অপরকে স্পর্শ করার পূর্বে প্রায়শ্চিত্তরূপে যে সেটিও পারবেনা সে যেন ৬০ জন মিসকিন খাওয়ায় এটি এইজন্য তোমরা যেন আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সা. এর উপর বিশ্বাস স্থাপন কর। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত শাস্তি এবং কাফিরদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।’’

এদিকে রমজান মাসে শ্রমিকদের কাজ সহজ করার বিষয়ে রাসুল সা. ঘোষণা করেছেন “যে ব্যক্তি রমজান মাসে তার শ্রমিকদের কাজ সহজ করে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার হিসাব কে সহজ করে দিবেন”। (বুখারী শরীফ)

শতকরা ৯৫ ভাগ মুসলিমদের দেশে রমজান মাসে এদেশের অসাধু লোকজন যে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় সেটি কোন ভাবেই কাম্য নয় যদিও এটি ইসলামী রাষ্ট্র নয়।

রমদানুল মুবারকের সামাজিক শিক্ষাসহ অন্যান্য যে শিক্ষা আছে তা আমাদের ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় সহ সকল ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বাস্তবায়ন করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

এমফিল গবেষক(এবিডি)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
+৮৮০ ১৯১১ ৯৮১১৪৪

alhelaljudu@gmail.com