পাহাড়ে আলোর নগরী...

মো. সাইফুল ইসলাম প্রকাশিত: আগস্ট ৭, ২০২৩, ০২:৪৪ পিএম

২ আগস্ট ২০২৩। যেতে হবে বহুদূর। লামা শহর থেকে প্রায় ২৫ কি. মি পথ পাড়ি দিতে হবে সরই উচ্চ বিদ্যালয়ে যেতে। ব্যাগ গোছানো ছিল আগের রাতেই। সকাল ৮ টায় বেরিয়ে পড়লাম হোটেল রুম থেকে। লামার পাহাড়ী রাস্তায় সব ধরনের গণপরিবহণ চলাচল করে না। অবলম্বন সিএনজি বা মোটরবাইক। সিএনজি আবার ৫ জনের কম যাত্রী নিয়ে ছাড়বে না। বাধ্য হয়ে মোটরবাইকে রওনা হলাম। পাহাড়ী বাকা পথের যেন শেষ নেই। 

বৃষ্টি স্নাত সকালে অনেকটা ভেজা শরীরে ঠিক সকাল ১০ টায় পৌছানো গেল সরই উচ্চ বিদ্যালয়ে। অনেকটা পাহাড় কেটে নির্মাণ করা হয়েছে স্কুলটি। সেখানে একটি চারতলা ভবন নির্মাণাধীন। সরই স্কুলের কাজ শেষ। যেতে হবে আরেকটি স্কুলে। সরইয়ের প্রধান শিক্ষক একজন বাইকার ডেকে আমার গন্তব্য বুঝিয়ে দিলেন। 

ঝিমঝিম বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম। পাহাড়ের উপর দিয়ে চলছি। তিন-চার কিলোমিটার পর রাস্তার আশপাশে আর কোনো বাড়ির চিহ্ন নেই, নেই মানবের চলাচল। বাইকার জানালেন আরও খানিকটা পথ পাড়ি দিতে হবে স্কুলে যেতে। যতই সময় যাচ্ছে চারদিকের নিরবতা যেন উৎসুক মনকে জাগ্রত করছে।

বাইকারকে বললাম, ভাই এই জনমানবহীন পাহাড়ী স্কুলে কি ছাত্র আছে? বাইকার হ্যা বললে আবার জিজ্ঞাসা করলাম, এই ১০-১২ কিলোমিটারে তো কোনো বাড়ি দেখলাম না। তাহলে এই স্কুলের শিক্ষার্থীরা আসে কোথায় থেকে? এবার বাইক থামিয়ে বাইকারের জিজ্ঞাসা আপনি কি এখানে প্রথমবার আসলেন? 

হ্যা, প্রথমবার। বাইকার, তাহলে সেখানে গেলেই বুঝতে পারবেন। ওই স্কুলের ছাত্ররা বাহির থেকে স্কুলে যাতায়াত করে না। ওরা ওখানেই থাকে। বুঝলাম কিছু মানুষ হয়তো সেখানে বসতি গড়েছে, তাদের সন্তানরাই হয়তো সেই স্কুলে পড়ে। বললাম, ওখানে শিক্ষার্থী সংখ্যা কত এক-দুইশ হবে? বাইকার জবাবে অবাক হলাম। 

স্কুলটিতে নাকি পড়াশুনা করে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী। কথা বলতে বলতেই একটি চেকপোস্ট পড়ল। পরিচয় দিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়ার অনুমতি পেলাম। কিছুদূর গিয়ে আরেকটি চেকপোস্ট। এবার থামিয়ে দিলো। বিস্তারিত পরিচয় জানতে চাইলো। বললাম স্কুলে যাব। ততক্ষণে আমার জন্য অপেক্ষারত স্কুলের একজন শিক্ষক এগিয়ে এসে আমাদের নিয়ে গেলেন।

আমাকে বসানো হলো পাহারের উপরে নির্মিত একটি আধাপাকা (টিনসেড) ভবনে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের রুমে। চারদিকে খোলামেলা একটি বড় রুম। কোনো আভিজাত্যের ছোয়া নেই। প্রধান শিক্ষক শান্ত স্বভাবের ভদ্র মানুষ। কোমল স্বরে কথা বলেন। খুলনার মানুষ। কুশল বিনিময়ের পর পূর্ব নির্ধারিত দাওয়াত গ্রহণের অনুরোধ করলেন। 

একজন শিক্ষক আমাকে পাহাড় থেকে কিছুটা নিচু জায়গায় নিয়ে যেতে লাগলেন। সেখানে গিয়ে চোখ কপালে উঠার উপক্রম। বিশাল ডাইনিংয়ে তখন আহার করছিল নীল শার্ট পরা পাহাড়ী-বাঙালি ৮/৯ শত ছেলে! আরও অবাক হলাম এত বড় ডাইনিংয়ে এতগুলো কিশোর একসঙ্গে আহার করছে অথচ কোথাও কোনো শব্দ নেই। খাওয়া শেষে নিঃশব্দে সবাই পাহাড়ী রাস্তা বেয়ে সেদিকে যাচ্ছে আমি যেদিক থেকে মাত্রই আসলাম। 

যে শিক্ষক আমাকে ডাইনিং স্পেসে নিয়ে গেলেন তিনি উত্তরের মানুষ, হাসিমুখ তার। অল্পতেই ভাব হলো। আগেই টেবিল প্রস্তুত ছিল। দুজনে একসঙ্গে দুপুরের খাবারটা গ্রহণ করলাম। এরইমধ্যে অনেক কথা হলো, এগিয়ে এসে কথা বললেন আর ৪/৫ জন শিক্ষক। 

আসতে আসতে ওই শিক্ষককে বললাম আমি আপনাদের স্কুল সমন্ধে কিছুই জানিনা। অন্য দশটি স্কুলের মত আপনাদের স্কুলটা ভেবে চলে এসেছি। আমি জানতে চাই।

প্রতিষ্ঠানটি নন এমপিও। এর দুটি ক্যাম্পাস। একটি ছেলেদের, একটি মেয়েদের। এখানে প্রাথমিক থেকে শুরু করে দ্বাদশ পর্যন্ত পড়ালেখার সুযোগ পায় শিক্ষার্থীরা। তবে, স্তর ও লিঙ্গ ভেদে ক্যাম্পাস আলাদা। দুই ক্যাম্পাসে মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্রছাত্রী আছে দুই হাজারের বেশি। এখানকার ছাত্ররা মূলত দেশের পিছিয়ে পড়া অস্বচ্ছল পরিবার থেকে এসেছে। 

বলা যায় দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে তাদেরকে ধরে ধরে আনা হয়েছে। তারা এখানেই পড়ে, এখানেই খায়, এখানেই তাদের আবাসন। পড়ালেখা, খাওয়া ও থাকার জন্য তাদের কোনো ফি দিতে হয় না। ধর্ম-বর্ণ-আঞ্চলিকতা নির্বিশিষে এই দুই ক্যাম্পাসে পড়াশুনা করছে দেশের ৬৪ জেলা থেকে আসা কিশোর-কিশোরীরা। তাদের কোনো দ্বন্দ্ব নেই, নেই অতিরিক্ত কোলাহল।

এই শিক্ষার্থীরা মুঠোফোন বা অন্য কোনো ডিভাইস ব্যবহারের সুযোগ পায় না। ক্যাম্পাসের বাইরে তারা যায় না বিশেষ দিবস বা বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া। যার যার ধর্মীয় উৎসবে তা বাড়ি যেতে পারে কয়েকদিনের ছুটিতে। সপ্তাহে একদিন ফোনে (স্কুল নিয়ন্ত্রিত) কথা বলতে পারে পরিবারের সঙ্গে। তিনমাস অন্তর অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের দেখে যান। তখন হয় অভিভাবক সভা।

শিক্ষার্থীরা সকালে নাস্তা করে ক্লাসে যায়। দুপুর এক টা পর্যন্ত ক্লাসের পর লাঞ্চ ব্রেক। নিঃশব্দে লাঞ্চ শেষে সবাই ফেরে ক্লাসে। তিনটায় শেষ হয় নিয়মিত ক্লাস। এরপর নিজ নিজ রুমে চলে যায় তারা। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বিকেল  ৫টায় সবাই ফেরে ক্লাসরুমে। সারাদিন স্যাররা যা পড়িয়েছেন সেগুলো রিভিউ করে, হোমওয়ার্ক করে বিকেলে ক্লাসে বসেই। 

এরপর শুরু রুমে ফিরে হাতে তুলো নেয় বই। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, জীবনি কিংবা ধর্মীয় বই যার যা ইচ্ছা। বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক তাদের নিবির। পরিবারহীন, ইন্টারেনেটহীন, মুঠোফোনহীন ক্যাম্পাসে বই তাদের প্রিয় সঙ্গী। ক্লাসের সময়ও তারা ৪৫ মিনিট করে সুযোগ পায় লাইব্রেরিতে বসার। কেউ মিস করতে চায় না সে সুযোগ। 

ক্লাসে গিয়ে ছাত্রদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম নিয়মিত পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি কী কী বই পড়? এক নিঃশ্বাসেই একেকজন বলছিল ২০-৩০টি বইয়ের নাম। এই বয়সে তারা যোগাযোগ তৈরি করেছে বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে। কোয়ান্টামের ছেলেদের সুসজ্জ্বিত ক্যাম্পাসের লাইব্রেরিতে রয়েছে ৬ হাজারের অধিক বই।

ওই শিক্ষককে জিজ্ঞাসা করলাম, এসএসসির ফলাফল কেমন। তিনি কিছুটা ব্যাখ্যা দিলেন: প্রথমত, আমরা পিছিয়ে পড়া পরিবারের কিশোর-কিশোরীদের স্কুলে ভর্তি করাই। ফলে মেধার বিষয়টি এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমরা চাই তারা পড়ালেখা করুক। 

পড়ে জানা গেল এবছর এসএসসি পরীক্ষার প্রকাশিত ফলাফলে বান্দরবানের লামা উপজেলায় প্রথম হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটি। এবছর যখন এসএসসির রেজাল্ট নিয়ে অনেককে হতাশা প্রকাশ করতে দেখছি, তখন জানতে পারলাম এ স্কুলের প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থী পাশ করেছে। 

পাহাড়ের উচু নিচু মাটিতে স্থাপিত স্কুলের একেকটি ক্যাম্পাসের পরিসর সম্ভবত কয়েকশত একর জুড়ে। কতগুলো ভবন আছে হিসেব করতে পারিনি। তবে সেখানে বহুতল কোনো ভবন নেই। এখানে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষক-কর্মচারীরাও শতভাগ আবাসিক সুবিধা পেয়ে থাকেন। 

কেউই জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ক্যাম্পাসের বাইরে আসেন না, বা ক্যাম্পাসের বাইরে আসার প্রয়োজন হয় না কারও। চিকিৎসা কিংবা কেনেকাটা ক্যাম্পাসেই সবকিছুর ব্যবস্থা। সাধারণ মানুষের প্রবেশে কড়াকড়ি। একেবারেই নিরাপদ একটি নগরী যেন। 

বলছিলাম লামার পাহার বেষ্টিত কোয়ান্টাম কসমো স্কুলের কথা। দেড় ঘণ্টার জন্য স্কুলে গিয়ে ছিলাম প্রায় ৪ ঘন্টা। ফেরার তাগিদ না থাকলে হয়তো থেকে যেতাম আরও কিছু সময়। জানা হতো অজানা আরও অনেক কথা। অল্প কিছুদিন আগে গড়ে ওঠা স্কুলটির দেড় শতাধিক ছাত্রছাত্রী এখন পড়াশুনা করছে দেশের বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। 

বাংলাদেশের শিক্ষানুরাগীদের অনেকেই পরিদর্শন করেছেন কোয়ন্টাম কসমো স্কুল। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী এ বছরের গোড়ার দিকে একাধিক দিন অবস্থান করেছেন কোয়ান্টামের কিশোর-কিশোরিদের মাঝে। যদি লেখক হতাম, তাহলে কোয়ান্টামের অভিজ্ঞতায় হয়তো একটি বই রচিত হতো।

লেখক: সাংবাদিক, সাবেক সভাপতি বেরোবিসাস।

এইচআর