কিশোর গ্যাং কালচার। ঢাকা থেকে এ কালচারের শুরু হলেও এখন ডালপালা গজিয়েছে গোটা দেশজুড়ে। দিনে দিনে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহূত হচ্ছে কিশোররা। সময়ের সাথে সাথে তাদের অপরাধের ধরনও পাল্টে যাচ্ছে।
এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, চুরি-ছিনতাই থেকে শুরু করে খুনাখুনিসহ নানা অপরাধে কিশোর-তরুণরা জড়িয়ে পড়ছে। মাদক ব্যবসা ও দখলবাজিতেও তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে আশ্চর্য হওয়ার মতো তথ্য হচ্ছে— ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠলেও ঢাকার কিশোর অপরাধীদের তথ্য নেই ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছে।
কর্মকর্তারা বরছেন, আলাদা করে কিশোর অপরাধীদের জন্য ডিএমপিতে কোনো রকমের ডাটাবেজ নেই। কোনো একটি ঘটনা ঘটলেই পুলিশ কিংবা র্যাবের অভিযানের মধ্যেও নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোররা। ক্রমেই হয়ে উঠছে অপ্রতিরোধ্যও।
এদিকে অধিকাংশ এসব কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠার নেপথ্যে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা মদদ দিচ্ছেন বলে জানা যাচ্ছে। এ ছাড়া ‘হিরোইজম’ প্রকাশ করতেও পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে। আধিপত্য বিস্তার, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, প্রেমে বিরোধ, মাদকসহ নানা অপরাধে কিশোররা খুনাখুনিতেও জড়িয়ে পড়ছে।
কিশোর গ্যাংয়ের মাধ্যমে সংঘঠিত একাধিক ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় ‘বড় ভাই’রা। ঢাকায় আন্ডারওয়ার্ল্ডের খুনাখুনিতেও কিশোর ও তরুণদের ব্যবহার করার ঘটনা ঘটেছে।
সূত্র বলছে, কেবল রাজধানীতেই সক্রিয় রয়েছে ৭৮টি কিশোর গ্যাং। এর সবকটি গ্যাংয়ের সদস্য রয়েছে অন্তত দুই হাজার। এদের কাছে রয়েছে দেশি-বিদেশি নানা অস্ত্র। কেউ কেউ কাজ করছে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনুচর হিসেবেও। ঢাকার মিরপুর ও উত্তরা এলাকায় সবচেয়ে বেশি কিশোর গ্যাং সক্রিয়।
এ দুই এলাকাতেই প্রায় অর্ধশত কিশোর গ্যাং সক্রিয়। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা খুনাখুনি, মাদক, চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ের মতো অপরাধের সাথেও জড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে মিরপুর এলাকার কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় ভয়ঙ্কর সব অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় কিশোর গ্যাং কালচার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সম্প্রতি ঢাকার মিরপুরে আওয়ামী লীগের শ্রম ও জনশক্তি-বিষয়ক উপকমিটির সদস্য আসিফকে কুপিয়েছে রক্তাক্ত করেছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।
জানা গেছে, ঢাকা-১৪ আসনের সংসদ সদস্য আঁগা খান মিন্টুর শাহ আলী মাজারের পাশের অফিসে যান আসিফ। কবির চৌধুরী মুকুল নামে একজনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য সিফাত, লেলিন, মারুফ, ফয়সাল, আকিব আওয়াল, আলমগীর হোসেন ও খোকন হঠাৎ করে তাকে এলোপাতাড়ি মারতে থাকে। একপর্যায়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার মাথায় আঘাত করা হয়। এরপর গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেয়া হলে তার মাথায় ১০টি সেলাই দেয়া হয়।
আসিফ আলী অভিযোগ, আগা খাঁন মিন্টুর ভাগ্নে কবির চৌধুরী মুকুলের কর্মী-সমর্থক ও তার নেতৃত্বেই এই হামলার ঘটনা হয়েছে। কারণ এমপির নাম ভাঙিয়ে মুকুল মিরপুর-১৪ আসন এলাকায় চাঁদাবাজি, জমি দখলসহ বিভিন্ন অবৈধ কাজ করেন। এর প্রতিবাদ করায় এই হামলা চালানো হয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, রায়েরবাগসহ বিভিন্ন এলাকায়ও রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে সক্রিয় রয়েছে বেশকটি কিশোর গ্যাং।
রাজধানীর রায়েরবাগের তুষারধারা এলাকায় সম্প্রতি কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ট স্থানীয়রা মসজিদের মাইকে কিশোরদের দমন করতে মাইকিং করেন। প্রশাসনের নজর না থাকায় ওই এলাকার বাসিন্দারা মাইকে অভিভাকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। রায়েরবাগে স্থানীয়দের এমন উদ্যোগ দেখা গেলেও রাজধানীর অন্যান্য এলাকায় এখনো এমনটা দেখা যায়নি। এর নেপথ্যেও কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। কিশোর গ্যাংয়ের ভয়ে কেউ মুখই খুলতে চাইছে না। অনেকটা ইচ্ছের বিরুদ্ধেই নীরবে কিশোর অপরাধীদের তাণ্ডব সহ্য করে যাচ্ছেন দিনের পর দিন।
শুধু ঢাকায় নয়, ঢাকার বাইরেও কতটা সক্রিয় কিশোর গ্যাংয়ের বাস্তব রূপ দেখা যায় পটুয়াখালীতে। গত ২ জুন পটুয়াখালীতে মার্কেটের সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় সাইড দেয়া নিয়ে কথা কাটাকাটির জেরে কিশোর গ্যাংয়ের হামলার শিকার হন দুই পুলিশ সদস্যও। পরবর্তীতে থানা থেকে পুলিশ গিয়ে তাদের উদ্ধার করে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বাদল ওরফে নাতি বাদল নামে এক যুবকের নেতৃতে ওই কিশোর গ্যাং পরিচালিত হয়। তারা দীর্ঘ রাত পর্যন্ত মার্কেট প্রবশপথে বসে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে আসছে। প্রভাবশালীদের ছত্রছায়া থাকার কারণে তাদের ভয়ে ব্যবসায়ী ও স্থানীয়রা কোনো প্রতিবাদ করতে পারেন না।চট্টগামেও একই অবস্থা। গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাং লিডার আহমেদ বাবু ওরফে পিস্তল বাবুর ছুরিকাঘাতে নিহত হন ব্যবসায়ী মো. মহিউদ্দিন। পলোগ্রাউন্ড চেম্বারের বাণিজ্যমেলায় স্টল বসানোকে কেন্দ্র করে এ ব্যবসায়ীর ওপর হামলা করা হয়। এসময় মোবারক নামে আরও একজনকে ছুরিকাঘাত করে বাবু।
পরবর্তীতে গত শনিবার ভারতে পালিয়ে যাওয়া সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সীমান্ত এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। নারায়ণগঞ্জের অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ। গত ১৩ মে রাতে নারায়ণগঞ্জের গলাচিপা বোয়ালিয়া খাল এলাকায় কিশোর গ্যাং সন্ত্রাসীদের হামলায় গুরুতর আহত হন নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রকাশিত দৈনিক অগ্রবাণী পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক রশিদ চৌধুরী ও পথচারী জসিম।
এর আগে ওই এলাকায় কিশোর গ্যাং সন্ত্রাসীদের ধারালো অস্ত্র হাতে মহড়া ও দুই যুবককে কোপানো একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ভাইরাল হয়। ভিডিওর সূত্র ধরে পত্রিকায় খবর প্রকাশ করলে, এর জের ধরে এই সম্পাদকের ওপর হামলা করে কিশোর গ্যাং সদস্যরা।
এর একদিন পরই ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ ও বন্দর থানা এলাকায় পৃথক পৃথক কিশোর গ্যাং সদস্যদের আরও তিনটি হামলার ঘটনা ঘটে। এসব হামলায় দুই শিক্ষার্থীসহ তিনজন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ফতুল্লার দেওভোগ পানির ট্যাঙ্ক এলাকায় মিরাজুল ইসলাম দিপু, সিদ্ধিরগঞ্জে কলেজ শিক্ষার্থী আরাফাত হোসেন রিয়াদ ও বন্দরে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাকিবুল ইসলাম রিফাত ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হন।
এসব এলাকাগুলোতে কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বও ভিন্ন ভিন্ন। ফতুল্লার জামতলা-ঈদগাহ এলাকায় আবদুর রহমান বল্টু, বোয়ালিয়া খাল ও দেওভোগ পানির ট্যাঙ্ক এলাকায় বুইট্টা মাসুদ ও শান্ত, সিদ্ধিরগঞ্জে সাকিব ও বন্দরে খান মাসুদের নেতৃত্বে এ গ্যাংগুলো পরিচালিত হয় বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, ‘কিশোর গ্যাং কালচারের সাথে জড়িতরা পর্যায়ক্রমে আলাদা আলাদা গ্রুপ তৈরি করে। তাদের ড্রেস কোড থাকে, আলাদা হেয়ার স্টাইল থাকে, তাদের চালচলনও ভিন্ন। তারা এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। তারা নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। নানাভাবে তারা অর্থ সংস্থানের চেষ্টা করে। এলাকার কোনো ‘বড় ভাই’-এর সহযোগী শক্তি হিসেবেও তারা কাজ করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কিশোরদের একত্রিত করে কতিপয় ব্যক্তি বিভিন্ন ধরনের অপরাধে সম্পৃক্ত করছেন। তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচয়ও আছে। সহজ ও অল্প খরচে কিশোরদের দিয়ে তারা অপরাধ করানোর সুযোগ নিচ্ছেন। অস্ত্রবাজি, মাদক ও হত্যাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে তারা কিশোরদের ব্যবহার করেন।
এছাড়া কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে কিশোর গ্যাং তৈরি করছেন। এটি হলো কিশোর গ্যাং তৈরির একটি দিক। অন্য আরেকটি দিক হলো— আমাদের দেশে শিশুদের লালনপালন করার ক্ষেত্রে পরিবারগুলো শিক্ষা, চিকিৎসা এবং অন্যান্য বিষয়ে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা অপরাধে জড়ায় এমন একটি কথা সমাজে প্রচলিত আছে। এ ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
এখন উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও অপরাধে জড়াচ্ছে। সঠিক ও সুষ্ঠু সামাজিকীকরণের বিষয়টি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না বলে কিশোরদের মধ্যে ক্ষোভ-হতাশা তৈরি হচ্ছে। এগুলো প্রশমিত না হওয়ায় তারা নানা ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছে। এসব কারণ বিশ্লেষণ করে সমাধানের কার্যকর উদ্যোগ না নিলে কিশোর অপরাধ কমানো সম্ভব নয়।’
ঢাকায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের ছত্রছায়ায় কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে জানিয়ে পৃষ্ঠপোশক ও কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা তৎপরতার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার আমার সংবাদকে বলেন, ‘অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এরপরও যদি নতুন করে কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাই, তাহলে দ্রুতই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।