সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা নিয়ে সারা দেশেই ভোগান্তির কথা প্রায়ই উঠে আসছে। দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকার পর স্কুল ব্যাগ ও পোশাকের জন্য কিডস অ্যালাউন্স (উপবৃত্তি) দিচ্ছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে বেশ কিছু জেলায় উপবৃত্তির টাকা উত্তোলনে বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন অভিভাবকরা।
বগুড়া জেলা সদরের ঠনঠনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর অভিভাবকের দাবি— তারা মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস নগদের মাধ্যমে উপবৃত্তির টাকা উঠাতে পারছেন না। অভিভাবকদের অভিযোগ, টাকা উত্তোলনের জন্য গোপন পিন দিলে ‘ডিড নট ম্যাচ’ লেখা আসছে। আগে ব্যবহূত গোপন পিন অটোতেই পরিবর্তন হয়ে গেছে।
নতুন গোপন পিন সেট করতে চাইলে তাতেও কাজ হচ্ছে না। বেশির ভাগ মায়েরা পড়েছেন বিড়ম্বনায়। তারা বলছেন, এক হাজার টাকার জন্য আবার পোস্ট অফিসে গিয়ে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর, সেখান থেকে বলা হচ্ছে— এক কপি ছবি ও এনআইডির ফটোকপি রেখে যেতে বলছে। তিন-চারদিন পর আবার যোগাযোগ করতে বলেছেন। মায়েরা অভিযোগ করে বলছেন, নগদের কারিগরি ত্রুটির জন্য আমাদের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।’
একই সমস্যায় পড়েছেন মাগুরা জেলার বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা। নগদের মাধ্যমে এই উপবৃত্তি দেয়া হলেও জেলার অনেক অভিভাবকের অভিযোগ, তারা টাকা পাননি। অ্যাকাউন্ট খোলা হলেও বেশির ভাগ অভিভাবক পিন নম্বর জানেন না বলে মাগুরার প্রধান ডাকঘরে অবস্থিত মোবাইল ব্যাংকিংয়ের আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানটির কাস্টমার কেয়ারে ভিড় করেছেন।
মাগুরা প্রধান ডাকঘরের অস্থায়ী কার্যালয়ে শতাধিক অভিভাবকের ভিড় দেখা গেছে। ডাকঘরে আসা ভুক্তভোগী এক অভিভাবক বলেন, আমাদের কেউ টাকা মোবাইলে পায়নি। সবারই একই সমস্যা। আমি এত দূর থেকে এসেছি, কোলের শিশুকে নিয়ে খুব ঝামেলায় আছি। তবু শুনছি আজও হবে না সমাধান।’
কয়েকজন অভিভাবক অভিযোগ করে বলেন, বিদ্যালয় থেকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে অ্যাকাউন্ট খুলে দিলেও কোনো পিন নম্বর দেয়া হয়নি। এটি ছয় মাস আগের ঘটনা। তাদের সন্তানদের নামে উপবৃত্তিসহ সরকারি ভাতাসমূহ এই অ্যাকাউন্টে আসার কথা। জানুয়ারি মাসে এই ‘কিডস অ্যালাউন্স’ পাওয়ার কথা থাকলেও সেই টাকা নাকি এই মাসে ঢুকেছে। কিন্তু টাকা তো পিন নম্বর ছাড়া তোলা যায় না। বিদ্যালয় থেকে ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানটির অফিসে দেখা করতে বলেছে।
এখানে শুনছেন, এখানে পিন নম্বর দেয়া হচ্ছে না। বলছেন মঙ্গলবার টাকা চলে যাবে। পিন নম্বর নাকি সেখানে থাকবে। জানা গেছে, মাগুরার মহম্মদপুর ও শ্রীপুর উপজেলার বেশ কিছু অভিভাবক এই টাকা তুলতে বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন। অভিভাবকরা জেলা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার দূর থেকে টাকা কেন পাচ্ছেন না এমন অভিযোগ নিয়ে আসেন।
এদিকে ডাকঘরে নিয়োজিত মোবাইল ব্যাংকিংয়ের আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহকসেবা প্রতিনিধি বলেন, সার্ভারের সমস্যার কারণে এটা হয়েছে। এ ছাড়াও চট্টগ্রামের মিরসারইয়ে উপবৃত্তির টাকা উঠানো নিয়েও হয়রানিতে পড়েছেন হাজারো অভিভাবক।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার প্রায় ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী সরকারি উপবৃত্তির টাকা পান। যার ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী টাকা তুলতে গিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তারা অভিযোগ করে বলছেন, আমাদের উপজেলায় নগদের কোনো গ্রাহকসেবা না থাকায় বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। টাকা উত্তোলনের জন্য গোপন পিন দিলে ‘ডিড নট ম্যাচ’ লেখা আসছে। আবার নতুন গোপন পিন সেট করতে চাইলে তাও কাজ হচ্ছে না। জাতীয় পরিচয়পত্র ও অন্যান্য তথ্য নিয়ে নগদের (কাস্টমার কেয়ার) গ্রাহকসেবা ১৬১৬৭ নম্বরে কল দিয়েও সংযোগ পাওয়া যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিদ্যালয়) মো. মুহিবুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের স্কুলব্যাগ ও পোশাকের জন্য কিডস অ্যালাউন্স দেশব্যাপী দেয়া হচ্ছে। তবে কিছু জায়গায় মোবইল ব্যাংকিং অপারেটর নগদের মাধ্যমে টাকা উত্তোলনে সমস্যায় পড়েছে।
তিনি বলেন, যাদের নগদ অ্যাকাউন্টগুলো বেশ পুরনো। অনেক দিন ব্যবহার করা হয়নি মূলত তারাই সমস্যায় পড়েছেন। মুহিবুর রহমান বলেন, এক বছরের বেশি সময় অ্যাকাউন্ট ব্যবহার না করার কারণে অনেকে সমস্যায় পড়েছেন। বর্তমানে এই সমস্যা সুরাহা করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, নতুন পিন নম্বর সেট করতে সার্ভারে একসাথে অতিরিক্ত চাপ পড়ায় সমস্যা দেখা দিয়েছে। এটি খুব দ্রুতই সমাধান হয়ে যাচ্ছে।’
বিষয়টি নিয়ে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস নগদের হেড অব পাবলিক কমিউনিকেশন্স মুহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, ‘নগদের সাথে সরকারের চুক্তি আছে। আমরা যখন নির্দেশনা পাই ঠিক তখনই এই টাকাগুলো ছাড় করি। গত বছরের জুনে একবার দেয়া হয়েছে। আবার ঠিক এক বছর পর কিডস অ্যালাউন্সের টাকা দেয়া শুরু হয়। ফলে অনেক অভিভাবকই দীর্ঘ দিন অ্যাকাউন্ট ব্যবহার না করায় তারা পিন নম্বর ভুলে গেছেন। এতে করে কেউ পরপর দুবার ভুল পিন নম্বর দেয়ার কারণে এটি সার্ভার থেকে অটো লক হয়ে যায়। তাহলে এর দায় কিভাবে আমরা নেই? বলে প্রশ্ন রাখেন তিনি।
জাহিদুল ইসলাম বলেন, পরবর্তীতে আমাদের সেবা সেন্টারে গেলে তা ঠিক করে দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়াও গ্রাহক নিজে *১৬৭# ডায়াল করে পিন রিসেট অপশনে গিয়ে কিছু তথ্য দিলে অটোমেটিক রিজিস্ট্রেশন করা যায়। অনেক ক্ষেত্রে এই উপবৃত্তি যারা পাচ্ছেন তারা কিন্তু এই তথ্য দেয়ার মতো টেকনিকেলি সক্ষমতা না থাকার কারণেও সমস্যা হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনেক সময় এক সাথে অনেকেই কাস্টমার কেয়ারে ফোন দেয়ার কারণে হয়তো আমাদের সেবা পাননি। আমাদের সারা দেশে প্রায় ৬০০ সেবাকেন্দ্র আছে। এর মাধ্যমে আমরা দ্রুতই সমস্যার সমাধান করে যাচ্ছি। বেশির ভাগ টাকা দেয়া হয়েছে। কিছু বাকি আছে, এগুলো দেয়া হয়ে যাবে।’
প্রসঙ্গত, প্রায় এক বছর বন্ধ থাকার পর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি ও শিক্ষা উপকরণ কেনার ভাতা গত জুন থেকে বিতরণ শুরু হয় মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস নগদের মাধ্যমে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি প্রদান প্রকল্প-তৃতীয় পর্যায়ের ২০২০-২১ অর্থবছরের উপবৃত্তি ও কিডস অ্যালাউন্স বাবদ ৮৬৪ কোটি ২০ লাখ তিন হাজার ৫০০ টাকা সুবিধাভোগীদের অ্যাকাউন্টে বিতরণ করা হয়নি চুক্তির মেয়াদ না থাকায়। ভাতা ও উপবৃত্তি বিতরণকারী সংস্থা হিসেবে ‘নগদ’-এর সাথে চুক্তির মেয়াদ ছিল গত বছরের ৩০ জুন।
চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে গত বছর ১৩ অক্টোবর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চুক্তির খসড়া অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। কিন্তু ওই সময় চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো বন্ধ রাখা হয় মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে। তবে নতুন সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর ব্যবস্থা নেন।
এর আগে সর্বশেষ গত ২৬ মে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে এ সংক্রান্ত বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় শিগগিরই শিক্ষার্থীদের মধ্যে উপবৃত্তির অর্থ ও কিডস অ্যালাউন্স বিতরণ করা হবে। এর আগে ২০২০ সালে প্রাথমিক পর্যায়ের প্রায় দেড় কোটি শিক্ষার্থীকে নগদের মাধ্যমে উপবৃত্তি ও ভাতা বিতরণের জন্যে দায়িত্ব দিয়ে একটি চুক্তি করে সরকার।