আইনে কড়াকড়ি থাকলেও দিন দিন আশঙ্কাজনকহারে বেড়েই চলেছে সাইবার অপরাধ। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন-বিটিআরসি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি-আইসিটি বিভাগের সাইবার হেল্প ডেস্ক ও ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার-এনটিএমসিতে সাইবার অপরাধ নিয়ে প্রতিদিনই জমা পড়ছে অভিযোগ।
কিশোর-তরুণরাই সবচেয়ে বেশি জড়াচ্ছে সাইবার অপরাধে আর এসব অপরাধে সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছেন নারীরা। অ্যাপস বন্ধ করেও সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় বলে বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
এমন পরিস্থিতিতে প্রযুক্তির অপব্যবহার ঠেকাতে অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রীয়ভাবে কঠোর নজরদারির প্রয়োজন —বলছেন প্রযুক্তিবিদরা। একই সাথে পুলিশের সক্ষমতাও আরো বাড়ানো জরুরি। সাইবার অপরাধ থেকে রক্ষা পেতে অপরিচিত কাউকে বন্ধু না বানানো, অপরিচিত বা সন্দেহজনক লিংকে প্রবেশ না করা, কারও সঙ্গে পাসওয়ার্ড শেয়ার না করা এবং সচেতনতার বিকল্প নেই। তারপরও কেউ অপরাধের শিকার হলে দ্রুত থানা ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে প্রমাণসহ জানাতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তিবিদ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকেও দেয়া হচ্ছে এমন পরামর্শ।
সম্প্রতি সাবিনা আক্তার (ছদ্মনাম) নামে ভোলার চরফ্যাসন এলাকার এক নারী আমার সংবাদকে জানান, তিনিও ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হতে যাচ্ছেন বলে ধারণা করছেন। তার সাথে এখনো গুরুতর কিছু না ঘটলেও আতঙ্কে রয়েছেন তিনি।
তিনি জানান, বেশ কিছুদিন ধরে অপরিচিত একব্যক্তি তার হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করছেন। বলছেন কিছু অন্তরঙ্গ ছবি রয়েছে তার কাছে। ওই ছবিগুলোর কথা বলে তার সাথে দেখা করতে চায় ওই ব্যক্তি। ভোলা কলেজ এলাকায় যাওয়ার জন্যও বলা হচ্ছে।
কিন্তু ওই নারী বলছেন, অন্তরঙ্গ ছবির কথা বলা হলেও তিনি শতভাগ নিশ্চিত যে— এমন কোনো ছবিই তার নেই। ওই ব্যক্তির পরিচয় জানতে চাইলেও বলা হচ্ছে পরিচয় জেনে কী লাভ? আর এসবের উদ্দেশ্য জানতে চাইলেও বলা হচ্ছে ভোলা কলেজের সামনে এসে দেখা করলেই বলবেন।
ওই নারী বলেন, আমি কখনোই মোবাইল ফোনে ছবি তুলি না। এ অবস্থায় তিনি মানসিকভাবে কিছুটা চাপের মধ্য দিয়ে গেলেও নিস্তার পেতে স্বজনদের দিয়ে কথা বলছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোতে। থানায় অভিযোগ করবেন বলেও বলছেন তিনি। তবে ওই ব্যক্তি এতটাই ধুরন্ধর যে, মেসেজে দেখার পরই আবার ডিলেটও করে দিচ্ছে। যে কারণে একটি মাত্র মেসেজের স্ক্রিন শট ব্যতীত আর কোনো প্রমাণও তিনি রাখতে পারেননি।
গত ২২ জুলাই এমনই আরেক ব্ল্যাকমেইলারকে ফেনীর ছাগলনাইয়া এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। নারীদের ছবি ব্যবহার করে প্রোফাইল তৈরি করে অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তিদের ব্ল্যাকমেইল করত আজহার উদ্দিন সাগর।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, সাগর তার আইডিগুলোতে বিভিন্ন নারীর ছবি ব্যবহার করেছে। ধারণা করা হয়েছিল, কোনো একটি চক্র শিল্পপতি ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের টার্গেট করে ব্ল্যাকমেইল করছে। কিন্তু তদন্তে বের হয়ে আসে আইডিগুলো চালাচ্ছিল আজহারউদ্দিন নামের এক যুবক। সে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করলেও তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞান ভালো। এ পর্যন্ত ২০-২৫ জনকে ব্ল্যাকমেইল করেছে সে।
সার্বিক বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, দেশে এখনো পরিকল্পিত সাইবার অপরাধের মামলা অনেক কম। গত সাত বছরে ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য আসা মামলার মাত্র ৪ দশমিক ২৩ শতাংশ হ্যাকিং, কম্পিউটারের সোর্স কোড পরিবর্তনের মতো গুরুতর অভিযোগ ছিল। তার মধ্যে হ্যাকিংয়ের মামলাগুলোর বড় অংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক হ্যাকিংয়ের অভিযোগে করা হয়।
তাছাড়া বিকাশ, নগদ, রকেটের মতো আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের ঘটনায়ও মামলা হয়েছে। তার বাইরে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট হ্যাকিংয়ের অভিযোগের মামলাও ট্রাইব্যুনালে এসেছে। মূলত অনলাইনে মানহানি, মিথ্যা তথ্য, অশ্লীল ছবি ও তথ্য প্রকাশের অভিযোগে সাইবার
অপরাধের মামলাই বেশি হচ্ছে।
ওই তুলনায় হ্যাকিংসহ অন্য গুরুতর অপরাধের মামলা কম, সাজাও নগণ্য। সে জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা হয়রানি ও সম্মানের কথা ভেবে সাইবার অপরাধ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কাছে অভিযোগ করে না।
তাছাড়া স্বচ্ছ ধারণা না থাকা ও প্রতিকার পেতে সময়ক্ষেপণ হওয়ায় আইনের আশ্রয় নিতে বেশি অনীহা। গত দু-তিন মাস আগে ভারতের তথ্য দিয়ে খোলা সোনিয়া শর্মা নামের একটি ফেসবুক আইডি থেকে মেসেজ করা হয় রাজধানীর মতিঝিলের একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বাকি বিল্লাকে (ছদ্মনাম)। কিছু সময় চ্যাটিং করার এক পর্যায়ে লাইভে ফোন সেক্সে আগ্রহী কি-না জানতে চাওয়া হয় ওই আইডি থেকে। সহকর্মীদের পরামর্শে নিজের প্রাইভেসি রক্ষা করে ভিডিও চ্যাট করতে রাজি হয় বাকি বিল্লাহ।
ওই আইডি থেকে এক তরুণীর আগেই করে রাখা একটি ভিডিও প্লে করা হয়। কিন্তু বাকি বিল্লাহর খোলামেলা দৃশ্য না দেখায় হিন্দিতে গালাগাল করে লাইন কেটে দেয়া হয়। কণ্ঠস্বর শুনে তখন বোঝা যায় সোনিয়া শর্মা নামের আইডিটি একটি পুরুষ দ্বারা পরিচালিত হয়। চালাকি করে বাকি বিল্লাহ এ যাত্রায় বেঁচে গেলেও ফেঁসে যাচ্ছেন অনেকেই। এমন অনেক ঘটনায় ভুক্তোভোগীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে গ্রেপ্তারও হচ্ছে অপরাধীরা। তবুও থেমে নেই বরং দিনে দিনে বাড়ছে এসব অপরাধ।
সূত্র জানায়, কিশোর-তরুণরাই সাইবার অপরাধে বেশি জড়াচ্ছে। ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি, ইমো হ্যাকের পর ব্ল্যাকমেল করে অর্থ আদায়, ধর্ষণ এবং এর ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার মতো সাইবার অপরাধও দিন দিন বাড়ছে।
তা ছাড়া শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইটের তথ্য জালিয়াতি করে জাল সনদ তৈরি, গুরুত্বপূর্ণ ও ভিআইপি ব্যক্তিদের নামে ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের প্রতারণার ঘটনাও ঘটছে।
ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, ইনস্টাগ্রাম, স্কাইপে ভুয়া আইডি খুলে জালিয়াতি ও প্রতারণা, বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে মিথ্যা ও মানহানিকর তথ্য প্রচার, আইডি হ্যাক, ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি, অনলাইনে প্রশ্নপত্র ফাঁস, অনলাইনে জুয়া খেলাসহ অন্তত ১৩ ধরনের সাইবার অপরাধ ঘটছে। আইনে কড়াকড়ি আরোপ করাসহ নানা পদক্ষেপ নেয়া সত্ত্বেও এসব অপরাধ কমছে না।
শুধু আইডি হ্যাক করে কিংবা ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি করেই নয়; ভিআইপি ব্যক্তিদের নামে তথা পুলিশের আইজি পরিচয়ে, মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) পরিচয়ে প্রতারণা, নারী পুলিশের আপত্তিকর ছবি ছড়ানো, পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণা, গৃহবধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার অপরাধের ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়েছে অপরাধীরা।
তথ্য মতে, সাইবার অপরাধে নারীরাই বেশি শিকার হচ্ছে। নারীদের সেবা প্রদানের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয় পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ওই সেলে গত এক বছরে ১২ হাজার ৬৪১ জন নারী ভুক্তভোগী সাইবার স্পেসে হয়রানি সংক্রান্ত যোগাযোগ করেছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সাইবার স্পেসে হয়রানির শিকার ১২ হাজার ৬৪১ জন ভুক্তভোগীর মধ্যে মাত্র ১২ শতাংশ জিডি বা মামলা করেছে। তার মধ্যে মাত্র ১৩ শতাংশ ভুক্তভোগী অভিযুক্তের পরিচয় ও অবস্থান শনাক্তে পর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
সেলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৭ হাজার ২৮০ জন সেবাপ্রত্যাশী যোগাযোগ করেছে। তার মধ্যে হয়রানি সংক্রান্ত ১২ হাজার ৬৪১ অভিযোগের মধ্যে আট হাজার ২২১ জনকে প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রযুক্তিগত ও আইনগত পরামর্শ ও সহায়তা দেয়া হয়েছে। সাইবার অপরাধে ভুয়া আইডি ব্যবহার করে হয়রানি করার অভিযোগই সবচেয়ে বেশি। অভিযোগকারীর শতকরা ১৬ ভাগ ভুক্তভোগী ১৮ বছরের কম বয়সি।
শতকরা ৫৮ ভাগ ভুক্তভোগীর বয়স ১৮ থেকে ২৪ বছর। ২৫-৩০ এর মধ্যে ভুক্তভোগী ২০ ভাগ এবং ৬ ভাগ ভুক্তভোগীর বয়স ৪০ বছরের বেশি। তাছাড়া সিআইডি, ডিএমপির সাইবার সেন্টারে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ দিন দিন বাড়ছে। ১৮ বছর বয়সি ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ৭ শতাংশ, ১৯ থেকে ২৫ বছর বয়সি ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ৩৪ শতাংশ, ২৬ থেকে ৩৫ বছর বয়সি ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ৩৬ শতাংশ, ৩৬ থেকে ৫৫ বছর বয়সি নারী-পুরুষের মধ্যে ২০ শতাংশ এবং ৫৫ থেকে বেশি বয়সি নারী-পুরুষের মধ্যে ৩ শতাংশ তথ্য-প্রযুক্তির অপব্যবহার করে অপরাধে জড়াচ্ছে। সিটিটিসি সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০-৪০টি মৌখিক ও লিখিত সাইবার সম্পর্কিত অভিযোগ আসছে। তার মধ্যে ব্ল্যাকমেলিং, মোবাইল ব্যাকিং ও পর্নোগ্রাফির অভিযোগই বেশি।
এদিকে তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের মতে, অপরাধ ঠেকাতে অ্যাপস বন্ধ করা যেমন কঠিন, তেমনি সেগুলো নিষিদ্ধ করেও লাভ নেই। নিষিদ্ধ করে ব্যবহার ঠেকানো যায় না। বরং সে জন্য দুটি বিষয়ে জোর দেয়া প্রয়োজন। সাইবার অপরাধ দমনে পুলিশের সক্ষমতা আরো বাড়ানো এবং দরকার প্যারেন্টাল গাইডেন্স। সন্তান যে গ্যাজেটটি ব্যবহার করছে তার প্যারেন্টাল কন্ট্রোল অন করে দিতে হবে। ফলে সন্তান যদি কোনো নিষিদ্ধ অ্যাপ ব্যবহার করে, সাইটে ঢোকে বা গ্রুপে তৎপর হয় তাৎক্ষণিকভাবে তিনি তার নোটিফিকেশন পাওয়া যাবে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইমের ডিসি মোহাম্মদ তারেক বিন রশিদ আমার সংবাদকে বলেন, ‘সক্ষমতার ঘাটতি আছে ওভাবে বলা যাবে না। কিন্তু ভালোর তো আসলে শেষ নেই। দিন দিন নতুন নতুন টেকনোলজি বের হচ্ছে। নতুন নতুন যন্ত্রপাতি বের হচ্ছে। যত আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা যাবে, তত অপরাধী শনাক্ত বা এ নিয়ে কাজ করা সহজ হবে।’
অন্যদিকে বিটিআরসি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিটিআরসি শুধু ইউটিউব, ফেসবুকের কোনো কনটেন্ট সরানোর অনুরোধ করতে পারে। কনটেন্ট বিটিআরসির কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড পরিপন্থি হলে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ তা অপসারণ করে, নয়তো করে না। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী বা সরকারের পক্ষে ইন্টারনেট জগতে কোনো কিছুই পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।