লাগামহীন অনলাইন বেটিং সাইট, টার্গেট যুবসমাজ

শাহরিয়ার রহমান প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২২, ০৪:১২ পিএম

একসময়ে দেশে জুয়া খেলা মানেই সকলের মনে হতো গোপনে কিছু মানুষ আসরে বসে জুয়া খেলছে। সাথে টাকার বাজী। জুয়ার ফলে যেমন যুবসমাজ ধ্বংস হয়ে যায়, ঠিক তেমন চলে যায় মাদকের এক ভয়ংকর প্রকোপে। সবমিলিয়ে যুবসমাজ ধ্বংসকারী এক মারনঘাতী হাতিয়ার জুয়া। জুয়ার প্রকোপ থেকে যুবসমাজ বাঁচাতে দেশের সরকার পদক্ষেপ নেয় জুয়া বন্ধের। আইনশৃংখলা বাহিনীর নিরলস প্রচেষ্টায় প্রায় বন্ধও হয়ে যায় জুয়া।

কিন্তু প্রযুক্তির ব্যাবহারে যেভাবে মানুষের নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সহজলভ্য হয়েছে তেমনই সহজলভ্য হয়েছে জুয়া। এখন আর জুয়া খেলতে আভিজাত্য কোন ক্যাসিনো তে যেতে হয় না। ক্যাসিনো এখন হয়ে গেছে অনলাইন ভিত্তিক। শুধু ক্যাসিনো নয়, অনলাইন ভিত্তিক এইসব জুয়া খেলার সাইটে যোগ হয়েছে স্পোর্টস বেটিং ও যেখানে যে কেউ যে কোন খেলার উপর বাজি ধরতে পারে। মাঠে খেলোয়াররা খেলতে নামে নিজের জন্য, নিজের দেশের জন্য। আর তার আড়ালে চলে কোটি কোটি টাকার খেলা। যার ফলে ঘটে ম্যাচ ফিক্সিং এর মতন জঘন্যতম ঘটনা।

দেশের আভ্যন্তরীন জুয়ার আড্ডা, ক্যাসিনো এসব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেও এসব অনলাইনভিত্তিক ক্যাসিনো বিদেশ কেন্দ্রিক হবার কারণে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে এগুলো নিয়ন্ত্রন করা খুব কঠিন। তারপর ও তারা তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেই যাচ্ছেন। কিন্তু যুবসমাজে এসব অনলাইন গ্যাম্বলিং সাইট এতোটাই ভয়াবহ ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে তা আর সম্পুর্ণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছেই না। এই সাইটগুলোর মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য সাইটগুলো হচ্ছেঃ 1xbet, Mostbet, Melbet, Bet365। এগুলোর সবকটিই  বিদেশি সাইট।

এসব সাইটের মাধ্যমেই দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে। এই সাইট গুলোর প্রধান টার্গেট হচ্ছে দেশের যুবসমাজ, আর অশিক্ষিত মানুষজন। এসবের ভয়াবহতা থেকে দেশের যুবসমাজ কে বাঁচাতে সরকার এসব সাইট দেশ থেকে বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় এবং ২০১৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) এসব  বেটিং সাইট, পর্নোগ্রাফি সাইট মিলিয়ে সর্বমোট ৪৫০০ এর বেশি সাইট বাংলাদেশ থেকে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়। কিন্তু তাতেই কি এসব নিয়ন্ত্রনে এসেছে? না। বরং আরো বেড়েছে এসব সাইটের ইউজার।

বিটিআরসি এসব সাইট বন্ধের পরের দিনই এইসব সাইট ফিরে আসে হাজার হাজার মিরর সাইট নিয়ে। ফলে আরো ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায় এসব অনলাইন জুয়ার সাইটগুলো। এইসব সাইট খুব সহজেই এক্সেস করা টাকা জমা ও উত্তোলণ করা যায় বলে সহজেই এই দিকে ভিড়ছে যুবসমাজ। তথ্য বলছে, এইসব সাইটের বেশিরভাগ ব্যাবহারকারী ই অল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত। অনেকের নেই খেলাধুলা সম্পর্কে নুন্যতম জ্ঞান। শুধুমাত্র লোভনীয় প্রচার আর টাকা আয়ের উদ্দেশ্যে একাউন্ট খুলেছেন এসব সাইটে। তবে বেশিরভাগই সর্বস্বান্ত হন এসব সাইটের জন্য।

এইসব সাইটে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল অর্গানাইজেশন বিকাশ, রকেট, নগদ বা কার্ড দিইয়ে সহজেই টাকা জমা করা যায়। ফলে অনেকেই নেহায়েত কৌতুহলবশেই টাকা জমা দেন নিজেদের একাউন্টে। এখান থেকেই খেলা শুরু। এই সাইটগুলোর নিয়ম অনুযায়ী টাকা জমা দেওয়ার পর জমা দেওয়া টাকার ১২ গুণ খেলতে হবে। নাহলে টাকা উত্তোলণ করা যাবে না। এই ১২ গুণ খেলতে গিয়েই ঘটে বিপত্তি। যারা জেতেন তারা আরো বেশি পাবার আশায় আরো বেশি খেলতে থাকেন আর অবশেষে আসক্ত হয়ে পড়েন।

অন্যদিকে যারা হেরে যান তারা হার পুনরুদ্ধারের আশায় আবার পা দেন এই ফাদে। অতএব কেউ হারুক বা জিতুক তার শেষ পরিণতি এসবে আসক্ত হয়ে পড়া। শুধু বিদেশি  নয়, সময়ের ব্যাবধানে দেশেও গড়ে উঠেছে এমন অনেক বেটিং সাইট। এসব সাইট পরিচালনা ও এজেন্টদের সাথে সহজে যোগাযোগের জন্য রয়েছে অহরহ ফেইসবুক গ্রুপ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের মূল লক্ষ্য প্রতারণা। এখন প্রশ্ন আসতে পারে দেশে নিষেধাজ্ঞা থাকার পরেও কিভাবে দেশের অর্থ সংস্থানের মাধ্যমে এতো অবাধে তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে? অনুসন্ধানে যানা যায়, এইসব সাইট ইতোমধ্যে নিজেদের এজেন্ট নেটওয়ার্ক তৈরি করে ফেলেছে যারা এগুলোকে দেখছে ব্যাবসা হিসেবে।

যারা টাকা জমা দিচ্ছেন তারা সরাসরি এই এজেন্ট কে টাকা দিয়ে নিজেদের একাউন্টে টাকা জমা করে নিচ্ছেন, অথবা সাইটে এই এজেন্ট দের নাম্বারে টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এজেন্ট রা নিজেদের নাম্বারে টাকা বুঝে পেয়ে দিচ্ছেন কনফার্মেশন। আর এজেন্টের কনফার্মেশন পেলেই একটা সংখ্যা যোগ হয়ে যাচ্ছে গ্রাহকদের একাউন্টে। এই এজেন্টরা আবার ক্রিপ্টো-কারেন্সির মাধ্যমে এই টাকা দিচ্ছেন ওই সাইটকে। সহজ ভাষায় পাচার করছেন। এইসব এজেন্টদের সংখ্যা কিন্তু নেহায়েত কম না। তাছাড়া শুধু পার্সোনাল নাম্বারেই যে লেনদেন হচ্ছে তা না।

এজেন্ট নাম্বার ও আছে অনেক। তবে এসব এজেন্ট ও থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু যেসব সাইট বাংলাদেশ থেকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া আছে সেসব সাইটের জন্য এজেন্ট নাম্বার বরাদ্ধ হয় কিভাবে? সবকিছু একদিকেই ইশারা দেয় আর তা হলো গাফিলতি। এসব গাফিলতি তে যে শুধু যুবসমাজ ধ্বংস করছে তা না, ধ্বংস করছে দেশের অর্থনীতিকেও। দেশের এমন করুণ পরিস্থিতিতেও থেমে নেই এসব বেটিং সাইট। এগুলো যদি এখনই দমন করা না যায় তবে অচিরেই আরো অর্থ পাচার হয়ে যাবে বিদেশে। বিধ্বস্ত হয়ে যাবে দেশের অর্থনীতি।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে দেশে অনলাইনে জুয়া খেলার প্রবণতা বাড়ছে জানিয়ে তা বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেছে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। গত ২৪ জুলাই জাতীয় সংসদে অনুষ্ঠিত কমিটির বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয় বলে সংসদ সচিবালয় থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়। এতে বলা হয়, বিভিন্ন ওয়েবসাইট ব্যবহার করে অনলাইনে জুয়া খেলা বন্ধ করতে তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বৈঠকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়।

ডিএমপির সিটি সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) আ ফ ম আল কিবরিয়া বলেন, আমাদের টিম সবসময় এটি মনিটরিং করছে। সাইটগুলো দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত হয়। ফলে এটি মোকাবিলায় প্রযুক্তিগত নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। দেখা গেল, এটি বন্ধে আমরা একটা প্রযুক্তি নিয়ে আসছি। চক্রটি আবার নতুন কোনো প্রযুক্তির মাধ্যমে সাইটগুলো সচল রাখছে। সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হলো টাকাগুলো দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।

এ বিষয়ে তথ্য প্রযুক্তিবিদ তানভীর হাসান জোহা বলেন, নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর উদাসীনতার ফলে ক্রমেই উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে অনলাইন জুয়ার আসক্তি। এতে একদিকে অর্থপাচারের কারণে রাষ্ট্রীয় ক্ষতি হচ্ছে, অন্যদিকে তরুণ প্রজন্ম বিপথে যাচ্ছে। তাই নিরাপত্তা সংশ্লিষ্টদের আরও সতর্ক হয়ে মনিটরিং করে এটি বন্ধ করা উচিত।

এবি