সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাব: নতুন বিধিমালা আসছে কবে

বেলাল হোসেন প্রকাশিত: জুন ২৭, ২০২২, ০১:১৫ এএম

দেড় বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাব দেয়া নিয়ে তেমন কোনো সাড়া মেলেনি।

এর মধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে সম্পদের বিবরণী দুই দফা নির্দেশনার পরও ঝিমিয়ে চলছে কার্যক্রম। সম্প্রতি জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী জাতীয় সংসদে সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাব বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন। 

আর জনপ্রশাসন সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নতুন করে বিধিমালা তৈরি হচ্ছে। তবে এ বিষয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে নেই তেমন কোনো গুরুত্ব। 

গত সপ্তাহে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে বেশ কয়েকজন চাকরিজীবীর সাথে এ প্রতিবেদকের কথা হয় এ নিয়ে। 

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, আমি তো প্রতি বছরই আয়কর রিটার্ন দাখিল করি। এ সময়ে তো আমাদের ব্যক্তিগত সম্পদের বিভিন্ন তথ্য দিয়ে থাকি। 

তিনি বলেন, তাহলে আবার নতুন করে কেন দিতে হবে। এই তথ্যের সাথে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যেটা চাচ্ছে, তা যোগ করে নেয়া যেতে পারে। 

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মচারীর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাব বিষয়ে
তেমনটা জানেন না। বেশ কয়েক মাস আগে এ বিষয়ে তিনি শুনেছিলেন, তবে এখন এ নিয়ে ওইরকম কিছু ভাবছেন না। 

এরকম আরো বেশ কয়েকজনের সাথে কথা হলে তাদের বেশির ভাগই বিষয়টি নিয়ে ওইরকম উৎসাহ দেখাননি। আবার কয়েকজন বিষয়টি নিয়ে কথাও বলতে চাননি। তবে অনেকরেই প্রশ্ন— নতুন বিধিমালা হবে কবে?

‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯’ অনুযায়ী পাঁচ বছর পরপর সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদ বিবরণী দাখিল ও স্থাবর সম্পত্তি অর্জন বা বিক্রির অনুমতি নেয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু ৩১ বছরেও সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা এ নিয়ম না মানার প্রেক্ষাপটে বিধিমালাটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সম্পদ বিবরণী দাখিল ও স্থাবর সম্পত্তি অর্জন বা বিক্রির নিয়ম মানাতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সিনিয়র সচিব-সচিবদের কাছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে গত বছরের ২৪ জুন চিঠি পাঠানো হয়। 

চিঠিতে ‘সরকারি চাকরি আইন-২০১৮’-এর আওতাভুক্তদের তাদের নিয়ন্ত্রণকারী প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়-দপ্তর-অধীনস্থ সংস্থায় কর্মরত সব সরকারি কর্মকর্তার সম্পদ বিবরণী জমা, ওই সম্পদ বিবরণীর ডাটাবেজ তৈরি ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে স্থাবর সম্পত্তি অর্জন, বিক্রয়ের অনুমতি নেয়ার বিষয়ে ‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা-১৯৭৯’ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রতিপালনের মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে জানানোর নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হিসাব দাখিল না করায় গত ২৭ জানুয়ারি সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব দিতে নতুন নির্দেশনা দিয়ে ফের সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের কাছে চিঠি পাঠায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।  

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শৃঙ্খলা-২ অধিশাখার যুগ্মসচিব মোহাম্মদ মিজানুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, ‘নতুন বিধি তৈরির কাজ চলছে। নতুন বিধি হলে সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাব নিয়ে যে জটিলতা তা কেটে যাবে।’ 

তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর আয়কর রির্টান দাখিল করার সময় সম্পদের যে তথ্য দেয়া হয়। এর সাথে যুক্ত করার কাজ নিয়ে নতুন বিধিমালা তৈরি হচ্ছে। তবে কবে নাগাদ বিধিমালা আসতে পারে এ বিষয়ে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারেননি সরকারের এ কর্মকর্তা।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আগের যে বিধি করা আছে সেখানে নতুনভাবে বিধি করার দরকার নেই। এখন যে বিধিটা আছে তা প্রয়োগের দরকার।’ তিনি বলেন, ‘যারা বিধি অমান্য করছেন তাদের বিরুদ্ধে যেন ব্যবস্থা নেয়া হয়। এটি সাধারণ বিষয় নয়, এটি আমাদের জাতীয় শুদ্ধাচার। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

 যেহেতু সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে এর স্বিকৃতি আছে, এর চর্চা করার সকলে দায়িত্ব নিতে হবে। মূল কথা হলো— যারা সরকারি নির্দেশনা অমান্য করেন। তাদের  ভেতরে কোনো কোনো কাজ জবাবদিহিতার মধ্যে আনা হয় না। এ সব দিকে দৃষ্টি দেয়া উচিত যাতে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায়।

‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা-১৯৭৯’-এর ‘মূল্যবান স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয়’ উপ-শিরোনামের ১১ বিধিতে বলা হয়েছে, ‘প্রকৃত ব্যবসায়ীর সহিত সরল বিশ্বাসে লেনদেনের ক্ষেত্র ব্যতিরেকে একজন সরকারি কর্মচারী তাহার কর্মস্থল, জেলা বা যে স্থানীয় এলাকার জন্য তিনি নিয়োজিত, ওই এলাকায় বসবাসকারী, স্থাবর সম্পত্তির অধিকারী অথবা ব্যবসা বাণিজ্যরত কোনো ব্যক্তির নিকট ১৫ হাজার টাকার অধিক মূল্যের কোনো স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয় বা অন্য কোনো পন্থায় হস্তান্তর করিতে চাহিলে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে, বিভাগীয় প্রধান বা সরকারের সচিবের নিকট নিজের এ অভিপ্রায় ব্যক্ত করিবেন। 

সংশ্লিষ্ট কর্মচারী নিজেই বিভাগীয় প্রধান হইলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবের মাধ্যমে ও সরকারের সচিব হইলে সংস্থাপন (জনপ্রশাসন) মন্ত্রণালয়ের সচিবের মাধ্যমে সরকারের নিকট অভিপ্রায় জানাইবেন। 

ওই অভিপ্রায়ের বক্তব্যে লেনদেনের কারণ ও স্থিরকৃত মূল্যসহ লেনদেনের সম্পূর্ণ বিবরণ ও ক্রয়-বিক্রয় ব্যতীত অন্য কোনো পদ্ধতিতে হস্তান্তর করা হইলে, ওই হস্তান্তরের পদ্ধতি উল্লেখসহ লেনদেনের সম্পূর্ণ বিবরণ থাকিবে। অতঃপর সরকার কর্তৃক প্রদত্ত আদেশ অনুসারে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী কাজ করিবেন।’ 

তবে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী তার অধঃস্তন কর্মচারীর সাথে সব প্রকার লেনদেনের ক্ষেত্রে পরবর্তী ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবেন। ‘ইমারত নির্মাণ, ইত্যাদি’ উপ-শিরোনামের ১২(১) বিধিতে বলা হয়েছে, ‘কোনো সরকারি কর্মচারী নির্মাণ ব্যয়ের প্রয়োজনীয় অর্থের উৎসের উল্লেখপূর্বক আবেদনের মাধ্যমে সরকারের পূর্বানুমোদন গ্রহণ না করিয়া ব্যবসায়িক বা আবাসিক উদ্দেশ্যে কোনো ইমারত নির্মাণ করিতে পারবেন না।’ 

জাতীয় সংসদ অধিবেশনে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, সরকারি চাকরি আইন-২০১৮ এর আলোকে প্রস্তাবিত খসড়া সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ২০২২’ প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটিতে উপস্থাপনের লক্ষ্যে গত ১ মার্চ সারসংক্ষেপ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। 

সম্পদের হিসাব বিবরণী দাখিল এবং নাগরিকত্ব গ্রহণ সংক্রান্ত বিষয়টি ওই আচরণ বিধিমালায় আগে থেকেই সংযোজিত রয়েছে। প্রস্তাবিত খসড়া আচরণ বিধিমালায় তা যুগোপযোগীকরণের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিধি অমান্যকরণে বিধিমালায় শাস্তির ব্যবস্থা উল্লেখ করা হয়েছে।