চাকরিচ্যুত ব্যাংকাররা দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন

রেদওয়ানুল হক প্রকাশিত: জুন ২৭, ২০২২, ০১:২৯ এএম

হুমকির মুখে প্রধান কার্যালয়ের তৈরিকৃত পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর নিয়ে চাকরিচ্যুতির অভিযোগ এনে বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ করেছেন বেসরকারি সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের একজন সিনিয়র অফিসার। শাখা পর্যায়ে দুর্নীতি সমর্থন না করায় চাকরিচ্যুত করার দাবি করেছেন ওই ভুক্তভোগী কর্মকর্তা। 

তার অভিযোগ, করোনাকালে ব্যাংকগুলোতে হাজার হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের যে হিড়িক চলছিল তারই সুযোগ নিয়ে তাকে ছাঁটাই করা হয়েছে। তবে এসআইবিএল কর্মকর্তারা বলছেন, করোনাকালে তাদের কোনো কর্মীকে ছাঁটাই করা হয়নি বা কেউ পদত্যাগ করেনি।

ভুক্তভোগী কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে জানতে চাইলে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জাফর আলম আমার সংবাদকে বলেন, ‘এটি একটি ভিন্ন ঘটনা। তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়নি বরং তিনি নিজেই পদত্যাগ করেছেন। তবে চাকরি ফেরত পাওয়ার বিষয়ে তিনি একবার আমার সাথে যোগাযোগ করেছেন। আমি বলেছি আপনি বেনিফিট যেটা পাবেন সেটা নিয়ে যান। 

তারপর বাকিটা আমি দেখব। কাউকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি তখন ছিলাম না। চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আমি দায়িত্বে আছি। আমি খোঁজ নেবো, যদি এমন হয়ে থাকে তাহলে ব্যবস্থা নেবো।’ 

অপরদিকে করোনাকালে কয়েকটি ব্যাংকে বেনিফিট না দিয়ে চাকরি থেকে বের করে দেয়া হবে, এমন হুমকির মাধ্যমে পদত্যাগে বাধ্য করার অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই প্রেক্ষিতে চাকরিচ্যুত কর্মীদের চাকরি ফিরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়ে সার্কুলার জারি করা হয়। কিন্তু সার্কুলারের যথাযথ বাস্তবায়ন করেনি ব্যাংকগুলো। নামমাত্র কয়েকজনের চাকরি ফেরত দিয়ে দায় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। 

আর চাকরির ফেরত পাওয়ার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন চাকরিচ্যুত ব্যাংকাররা। নিজ ব্যাংকে আবেদন ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংক ও গভর্নরের কাছে ধর্ণা দিয়েও কাজ না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চিঠি দিয়ে প্রতিকার চেয়েছেন তারা। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে মানববন্ধনও করেছেন।

গত ১৫ জুন মানববন্ধনে অংশ নিয়ে গণমাধ্যমের কাছে নিজেদের অভিযোগ ও দাবি তুলে ধরেন চাকরিচ্যুতরা। সেখানে তারা বলেন, ‘প্রথমে মৌখিকভাবে পদত্যাগ করতে বলা হয়েছে। এরপর ফোন করে চাপ দেয়া হয়। ডেকে নিয়ে ভয়ভীতি দেখানো হয়। 

তার পরও পদত্যাগ করতে রাজি না হওয়ায় দরজা বন্ধ করে মোবাইলফোন কেড়ে নিয়ে মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। অবশেষে নিজেদের তৈরি পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর নিয়ে চাকরি থেকে বের করে দেয়া হয়।’ তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার মেনে দ্রুততম সময়ে চাকরিতে পুনর্বহালের দাবি জানান তারা। 

আন্দোলনকারীরা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গার্মেন্টসসহ সব প্রতিষ্ঠান করোনাকালে ছাঁটাই বন্ধ রাখে। কিন্তু ব্যাংকের মতো একটি খাত এ নির্দেশনা মানেনি। ফলে চাকরি হারিয়ে অনেকে মানবেতর জীবনযাপন করছে। সামাজিকভাবে অসম্মানজনক অবস্থায় আছে। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে অনেকে শেষ সম্বল বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। 

মানববন্ধনে মিউচুয়াল ট্যাস্ট ব্যাংক-এমটিবি থেকে পদত্যাগে বাধ্য হওয়া একজন কর্তকর্তা বলেন, ‘এইচআর থেকে ডেকে নিয়ে কোনো কারণ ছাড়াই আমাকে পদত্যাগ করতে বলা হয়েছে। কারণ জিজ্ঞেস করলে এইচআর বলেন, আপনার কোনো সমস্যা নেই। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ আপনাকে চাচ্ছে না। আপনি অন্য কোথাও চাকরি দেখেন। এরপরও আমি পদত্যাগ না করায় আমাকে ডেকে নিয়ে বলা হলো, পদত্যাগ না করলে কোনো সুযোগ-সুবিধা দেয়া হবে না। 

এমন হুমকিতে পদত্যাগে বাধ্য হই।’ করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায়, এমনকি হার্ট অপারেশন পরবর্তী হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায় উপর্যুপরি ফোন দিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে অনেককে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। অনেক ব্যাংকের এইচআরডির কর্মকর্তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে এসব অভিযোগের স্বীকারোক্তিও দিয়েছেন বলে মানববন্ধন থেকে দাবি করা হয়।

চাকরিচ্যুত ব্যাংকাররা বলেন, করোনার অজুহাতে ছাঁটাই ও পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে প্রায় চার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীকে। মহামারি সময় যখন কর্মীদের পাশে থাকার কথা তখন উল্টো অমানবিকভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। ব্যাংকগুলোর এমন আচরণের সমালোচনা করে চাকরিচ্যুত কর্মীদের চাকরি ফিরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু ৯ মাস অতিবাহিত হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা আমলে নেয়া হয়নি। দ্বারে দ্বারে ঘুরেও চাকরি ফেরত না পেয়ে অবশেষে আমরা আন্দোলনে নেমেছি। 

প্রসঙ্গত, ব্যাংকারদের অভিযোগের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছর বেসরকারি খাতের ছয়টি ব্যাংকে কর্মী ছাঁটাই বিষয়ে বিশেষ পরিদর্শনে নামে। পরিদর্শনে দেখা যায়, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এই ব্যাংকগুলোর মোট তিন হাজার ৩১৩ জন কর্মকর্তা ‘স্বেচ্ছায়’ চাকরি ছেড়েছেন। 

এরমধ্যে বয়স থাকার পরও স্বেচ্ছায় পদত্যাগ দেখানো হয়েছে তিন হাজার ৭০ জনকে। এছাড়া ২০১ জনকে অপসারণ, ৩০ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত ও ১২ কর্মকর্তাকে ছাঁটাই করা হয়েছে। স্বেচ্ছায় পদত্যাগ দেখানো বেশির ভাগই জানিয়েছেন, পদত্যাগের জন্য মৌখিকভাবে তাদের সময় দেয়া হয়েছিল। ওই তারিখের মধ্যে পদত্যাগ না করলে কোনো সুবিধা দেয়া হবে না— এ ভয় দেখানো হয়। এমন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বাধ্য হয়ে তারা পদত্যাগ করেন। 

এরপরই ব্যাংককর্মীদের ছাঁটাই বন্ধে গত ১৬ সেপ্টেম্বর নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই নির্দেশনায় বলা হয়, এখন থেকে সুনির্দিষ্ট ও প্রমাণিত অভিযোগ ছাড়া কর্মীদের চাকরিচ্যুত করা যাবে না। পাশাপাশি মহামারি কোভিডকালীন চাকরিচ্যুত বা পদত্যাগে বাধ্য হওয়া ব্যাংককর্মীদের চাকরিতে পুনর্বহালের নির্দেশ দেয়া হয়।