ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন সরদার বলেছেন, সর্বোচ্চ নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে শনিবার হাজী ইউনুস আলী স্কুলের কার্যক্রম চালু হবে। গতকাল শুক্রবার দুপুরে আশুলিয়ার চিত্রশাইল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক উৎপল হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শিক্ষার্থীদের সাথে মতবিনিময়ে তিনি এ কথা বলেন।
মারুফ হোসেন সরদার বলেন, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা মনে করছেন তাদের সাথেও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে পারে। আসলে এ ধরনের ঘটনা ঘটার কোনো সুযোগ নেই। আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে চাই, সব শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। আমরা সর্বাত্মক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করব।
মারুফ হোসেন সরদার আরও বলেন, এ ক্ষেত্রে আমাদের বিষয়টি দ্রুত জানাতে হবে। দ্রুত জানানোর জন্য-৯৯৯ এর পাশাপাশি পুলিশ সুপার তার নিজের ফোন নম্বর সাবাই দিয়ে দেন।
তিনি বলেন, আমরা স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ ঠিক রাখতে সর্বোচ্চ কাজ করে থাকি। একটি টহল টিম স্কুলের নিরাপত্তা নিশ্চিতে নিয়োজিত থাকবে।
যদি ইফটিজার থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নেয়া হবে উল্লেখ করে পুলিশ সুপার বলেন, শুধু গলাকাটা মোড় নয়, যেকোনো জায়গায় এ রকম কোনো কিছু থাকলে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তবে পুলিশকে দ্রুত জানাতে হবে। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমি শিক্ষার্থীদের নিশ্চিত করতে চাই, এ ঘটনার ন্যায্য বিচার হবে। প্রভাবশালীদের চাপে এখানে ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রভাবের কোনো সুযোগ নেই। এ সুযোগ অতিতেও ছিল না। আসামি জিতুর বয়স আমরা বার্থ সার্টিফিকেট অনুযায়ী তদন্ত জমা দেবো। এখানে কোনো সন্দেহ নেই।
এসময় হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক শফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা লক্ষ করেছি অভিভাবকরাও শিক্ষকদের সাথে খারাপ আচরণ করেন। আমারা এসব ব্যবহারে ব্যথিত হই। আমরা চাই শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের ত্রিমুখী সম্পর্কের মাধ্যমে শিক্ষার পরিবেশ সুন্দর হোক।
অপর শিক্ষক তানিয়া বলেন, এই এলাকায় ইভটিজিংয়ের প্রভাব আছে। আমরা সবসময় আতঙ্কে থাকি। আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে বাসায় ফিরতে পারব কি-না এ সংশয় থাকি। যে পরিমাণে ইভটিজিংয়ের প্রভাব বিস্তার করেছে এর প্রতি পুলিশের নজর দেয়ার জন্য অনুরোধ জানাই। ইংরেজি বিভাগের ইলিয়াস শাহী বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীর মাঝে যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে, তার সমাধানের জন্য পুলিশ প্রশাসন এখানে এসেছেন।
তারা নিশ্চিত করেছেন প্রতিদিন একবার হলেও পুলিশের টহল টিম এখানে আসবে। আতঙ্ক ত্যাগ করে ভবিষ্যৎ গড়তে কাজ করতে হবে। কিশোর গ্যাং থাকলে তালিকা করবেন। আমাদের শিক্ষার্থীরা যদি জড়িত থাকে তাদের ব্যাপারেও আমাদের জানাবেন। আমরা থানায় অভিহিত করব। অধ্যক্ষ সাইফুল ইসলাম বলেন, শিক্ষক উৎপল হত্যা ছিল মধ্যযুগীয় সব চেয়ে আলোচিত বর্বরতা।
কারণ যিনি শিক্ষা দান করেছেন তাকেই হত্যা করা হয়েছে। এ রকম হলে গোটা পৃথিবীতে অন্ধকার নেমে আসবে। তাকে এমনভাবে পেটানো হয়েছে, কলিজা টুকরো টুকরো হয়েছে। কিডনি অচল হয়েছিল। স্ক্রিনে দেখেছি তিনি মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ছেন। এটি অত্যন্ত বেদনাদার। একজন মানুষ মারা যেতেই পারে। কিন্তু এভাবে মৃত্য কাম্য নয়। সামান্য স্বার্থের জন্য ছাত্ররা তাকে হত্যা করবে কেন? গত বছরও তাকে পাথর মেরেছিল। পরে তিনি আমাকে বলে ছাত্রদের ক্ষমা করে দেন। গত কয়েকদিন আগে তাকে, উৎপল আসছেন বলে ছাত্ররা বলে।
তিনি বলেছিলেন, আমার পক্ষে এই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা সম্ভব হবে না। এখানে বখাটে কিছু ছেলে আছে যারা বাইরে থেকে এসে উসকানি দেয়। শিক্ষার্থীরা এসব থেকে বিরত থাকবে। তিনি আরও বলেন, ৯০ ভাগ শিক্ষক এই এলাকার বাইরের, শিক্ষার্থীরাও বাইরের। আমি ব্যর্থতার সাথে স্বীকার করছি, আমরা নিরাপত্তাহীতায় ভুগছি। কলেজের পক্ষ থেকে উৎপলের মার জন্য এফডিআরের ব্যবস্থা করা হবে।
তার মার মাসে চার হাজার টাকার ওষুধ কিনতে হয়। উৎপলের মায়ের মুখের বিলাপ আর দেখতে চাই না। তিনি যেন মনে করেন, আমার সন্তান মরে গেলেও ওই কলেজে আরও সন্তান রয়েছে। সর্বশেষে তিনি সাংবাদিক ও পুলিশকে ধন্যবাদ জানান। শনিবার থেকে আমরা শিক্ষাকার্যক্রম চালাব। এতে পূর্ণ নিরাপত্তার দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার।
এসময় উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মো. হুমায়ন কবির, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাভার সার্কেল শাহিদুল ইসলাম, আশুলিয়া থানার ওসি কামরুজ্জামান, থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) জিয়াউল ইসলামসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
প্রসঙ্গত, গত ২৫ জুন দুপুরে আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকায় হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাঠে শিক্ষক উৎপলকে স্টাম্প দিয়ে আঘাত করেন তারই এক ছাত্র। পরে শিক্ষককে উদ্ধার করে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে ২৭ জুন চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। এ ঘটনায় রোববার আশুলিয়া থানায় নিহত শিক্ষকের ভাই বাদী হয়ে মামলা করেন। এরপর থেকেই বিক্ষোভে ফেটে পড়ে শিক্ষার্থীরা। সব শেষ গত ২৮ জুন রাতে জিতুর বাবা ও ৩০ জুন জিতুকে গ্রেপ্তার করে র্যাব ও পুলিশ। জিতু ও জিতুর বাবা উজ্জ্বল হাজীর পাঁচদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। একই সাথে ওই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি বাতিল করা হয়েছে।
বখাটে জিতুকে স্কুল থেকে আজীবন বহিষ্কার : আশুলিয়ায় শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে হত্যার মামলায় গ্রেপ্তার আশরাফুল ইসলাম জিতুকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ সাইফুল ইসলাম এ তথ্য জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘জিতুকে স্কুল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। তার সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি, যাতে কখনো কোনো শিক্ষকের ওপর এই ধরনের হামলা করার সাহস কেউ না পায়।’ এর আগে গ্রেপ্তারের পর বৃহস্পতিবার পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। তার বাবা উজ্জলও এখন রিমান্ডে রয়েছেন।
গত ২৫ জুন দুপুরে হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজে ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প দিয়ে শিক্ষক উৎপলকে এলোপাতাড়ি আঘাত করে পালিয়ে যায় দশম শ্রেণির ছাত্র জিতু। পরে আহত শিক্ষককে দ্রুত উদ্ধার করে গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে এনাম মেডিকেলে আইসিইউতে রাখা হয় তাকে।
সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার ভোরে তার মৃত্যু হয়। ঘটনার পরপরই নিহত শিক্ষকের ভাই অসীম কুমার বাদী হয়ে আশুলিয়া থানায় স্কুলছাত্রকে প্রধান আসামি ও আরও তিন-চার জনকে অজ্ঞাত করে একটি মামলা করেন।