মেহেদি হাসান। বরিশাল নগরের ঈদগাহ লেনের বাসিন্দা। ১৫ বোতল ফেন্সিডিল বহন করায় ২০২১ সালে তাকে আটক করে পুলিশ। মাদক আইনে মামলা হয়। বিচারপ্রক্রিয়া শেষে ছয় বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। মুক্তি পেতে আদালতে জামিন করেন মেহেদি। শুনানি শেষে বিচারক প্রবেশন আইনে জামিন মঞ্জুর করেন। শর্ত, পুনরায় এমন অপরাধ করা যাবে না, সেবা করতে হবে অসুস্থ মায়ের, লাগাতে হবে একশ ফলের গাছ।
তবে শর্ত ভঙ্গে আবারো জেলে যেতে হবে। শুধু মেহেদিই নয়, প্রতি বছর শত শত লঘু অপরাধীকে সংশোধনমূলক সাজা দিচ্ছে আদালত। অনেকে প্রবেশন সুবিধা নিয়ে স্বাভাবিক জীবনেও ফিরেছেন। দেশের কারাগারগুলোতে বন্দি ধারণ ক্ষমতা ৪০ হাজার ৯৪৪ জন। তবে বর্তমানে কারাবন্দির সংখ্যা ৮৮ হাজার ৮৪ জন ছাড়িয়েছে। হাতাহাতি, মারামারি ও অনেক তুচ্ছ ঘটনায় মামলা হচ্ছে।
বিচার প্রক্রিয়া চলছে দীর্ঘকাল। বিচারিক আদালত শেষে করে মামলার কার্যক্রম গড়াচ্ছে আপিল বিভাগ পর্যন্ত। ফলে সৃষ্টি হয় মামলাজট। বাড়ছে বিচার দীর্ঘসূত্রতা। কারাগারে বন্দি কমাতে পুরনো প্রবশেন আইন সচল করতে নির্দেশনা দিলেও সুফল মিলছে না। লঘু অপরাধের দণ্ড মওকুফে প্রবশেন নামে আইন থাকলেও খুব বেশি প্রয়োগ নেই।
এদিকে জানাশোনা না থাকায় আইনটি বিস্তরভাবে প্রয়োগ করাও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ১৯৬০ সালের আইনটি প্রায় অচল হয়ে আছে। এমনকি আইন প্রয়োগে সুপ্রিম কোর্ট নির্দিষ্টভাবে পরিপত্র জারি করলেও এখনো প্রয়োগ বাড়েনি।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, আইনজীবী, বিচারকসহ সংশ্লিষ্ট সবাই প্রবেশন আইন সম্পর্কে অসচেতন। জানার সদিচ্ছার অভাবের পাশাপাশি রয়েছে অজ্ঞতাও। অধিকাংশ আইনজীবী ও বিচারক জানেনই না অপরাধীদের জেলের বাইরে রেখেও সংশোধনের সুযোগ দেয়া যায় এমন একটি সুন্দর আইনি ব্যবস্থা রয়েছে।
এদিকে আইন প্রয়োগের প্রধান বাধা প্রবেশন কর্মকর্তার অভাব। নামমাত্র কর্মকর্তা দিয়ে চলছে প্রবেশন সুবিধা। সারা দেশে বর্তমানে মাত্র ৪৪ জন প্রবেশন কর্মকর্তার পদ রয়েছে, যারা সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে কর্মরত। কিছু জেলায় প্রবেশন কর্মকর্তাই নেই। যারা আছেন তারাও অনেকটা কর্মহীন। দক্ষতা বৃদ্ধিতে নেই কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও।
তবে অতি সম্প্রতি কারাগারে বন্দি চাপ ও মামলাজট কমাতে প্রবেশন আইনের প্রয়োগ কিছুটা বেড়েছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশে বিচারিক আদালতের বিচারকরা লঘু অপারাধীদের প্রবেশন সুবিধা দিচ্ছে। ‘শাস্তি’ হিসেবে বই পড়া, নামাজ পড়া, রোজা রাখা, সিনেমা দেখা, গাছ লাগানো, বাবা-মায়ের সেবা কার, শিশুদের পড়ানোসহ নানা অভিনব সাজা দিচ্ছে আদালত। তবে সবচেয়ে বেশি প্রবেশন পাচ্ছে মাদক ও যৌতুকের মামলার আসামিরা। দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে জেলে না পাঠিয়ে একজন প্রবেশন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে পরিবারের সাথে থাকতে দেয়ার ব্যবস্থাপনাই প্রবেশন।
আইনজ্ঞরা বলছেন, প্রবেশন সুবিধা বিচারব্যবস্থার জট কমানোর কার্যকরী পদক্ষেপ হতে পারে। তবে এর প্রয়োগ ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে। এর জন্য মনিটরিং ও তদারকি করতে হবে। যে বিচারকরা ‘স্বেচ্ছাধীন’ এখতিয়ার প্রয়োগে দোটানায় থাকেন, তারাও অনুপ্রাণিত হতে পারেন।
প্রবেশন দেয়ার বিষয়টি বিচারকের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও আমাদের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় প্রবেশন কথাটি অনালোচিত বা অপরিচিতই থাকা— এটি দুর্ভাগ্যজনক। আইনে যা আছে— ‘দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স-১৯৬০’ আইনের ৪ ধারার বিধান অনুযায়ী, ‘পূর্বে দণ্ডিত হয়নি এমন কারও অনধিক দুই বছরের সাজা হলে আদালত অপরাধীর বয়স, স্বভাব-চরিত্র, শারীরিক বা মানসিক অবস্থা এবং অপরাধের ধরন দেখে তাকে অব্যাহতি দিতে পারেন।
অথবা উপযুক্ত মনে করলে আদেশের সময় থেকে অনধিক এক বছর কোনো অপরাধ করবে না এমন শর্তে জামিনদারসহ বা জামিনদার ছাড়া মুচলেকা দিয়ে বিমুক্ত হওয়ার আদেশ দিতে পারেন।
তুচ্ছ ঘটনার মামলা আপিল বিভাগে : ১৯৮৬ সালে গাজীপুরের জয়দেবপুরে কথা কাটাকাটির জেরে মারামারি ও জখমের ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনায় মামলা হয়। মামলাটি বিচারিক আদালত শেষ করে হাইকোর্টে আসে। সর্বশেষ এসে ঠেকেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে। অথচ এক বছর সাজার মামলায় বিচারিক প্রক্রিয়ায় কেটে গেছে ৩৫ বছর। লঘুদণ্ডের মামলা আপিলে আসায় বিস্মিত আপিল বিভাগও।
গত বছরের ২৮ জানুয়ারি মামলাটি নিষ্পত্তি করে সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, দণ্ডবিধির ৩২৩ এবং ৩২৫ ধারা আপসযোগ্য অপরাধ এবং দু’পক্ষ পরস্পর আত্মীয় কাজেই মামলাটি আপস মীমাংসা করা যুক্তিযুক্ত ছিল। রায়ে আপিল বিভাগ বলেন, আমরা দুঃখের সাথে লক্ষ করছি, বিচারিক আদালতের বিচারক সম্পূর্ণরূপে ভুলে গেছেন যে, দেশে ‘প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স-১৯৬০’ নামে একটি আইন আছে। মামলাটি সেই আইনের ৫ ধারা প্রয়োগযোগ্য। দুঃখের সাথে বলতে চাচ্ছি যে, এই মামলায় প্রবেশন আইন প্রয়োগ না করা শুধু দুঃখজনকই নয়, সেই সাথে প্রচলিত আইনের পরিপন্থি।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০-২১ সালে সারা দেশে প্রবেশন সুবিধা পেয়েছেন এক হাজার ২৭৫ জন আসামি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রবেশন সুবিধা পেয়েছিলেন ৪০৫ জন, ২০১৮-১৯ সালে পেয়েছেন ৫৪৩ জন, ২০১৯-২০ সালে সেটা দ্বিগুণ হয়ে এক হাজার ৮০ জন এবং ২০২০-২১ সালে পেয়েছেন এক হাজার ২৭৫ জন।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জামিউল হক ফয়সাল আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে অপরাধীকে শাস্তি আরোপ করা আইন সমর্থন করে না; কেননা, সাজা প্রদানের অন্যতম উদ্দেশ্য সংশোধনমূলক, প্রতিহিংসামূলক নয়। সাজা প্রদানের ওই আদর্শিক বিষয় বিবেচনায় রেখে অপরাধীদের বয়স, পূর্বাপর আচার-আচরণ, দৈহিক ও মানসিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে উপর্যুক্ত আইনের বিধানাবলির যথাযথ প্রয়োগ পরিস্থিতি উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। আপসযোগ্য মামলায় অপরাধী প্রবেশনে গিয়ে প্রবেশন অফিসার বা তৃতীয়পক্ষের মধ্যস্থতায় আপস মীমাংসা করে ফেলেছেন।
এর পরিধি বাড়ানো প্রয়োজন। ভিকটিম ও অপরাধী যেন পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে পারেন কিংবা ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করতে পারেন, সে জন্য প্রবেশন আইনে রেস্টোরেটিভ জাস্টিস পদ্ধতি প্রয়োগের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারকে প্রবেশন কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। অপরাধী সংশোধন ও পুনর্বাসন সমিতিকে পুনর্গঠন করতে হবে। জেলা ও দায়রা জজকে সভাপতি করে শিশু আদালতের বিচারক এবং একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে ওই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’
সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী ব্যারিষ্টার শিহাব উদ্দিন খান বলেন, আমাদের দেশের অধিকাংশ অপরাধী প্রথম অপরাধী এবং তারা পেশাদার অপরাধী নন। অনেকেই আর্থ-সামাজিক বৈষম্য এবং বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষাপটে অপরাধ করে বসেন। এই প্রেক্ষাপটে প্রবেশনসহ কারাদণ্ডের বিকল্প পদ্ধতিগুলোর পরিকল্পিত ব্যবহার তাদের অপরাধের অন্ধকার সড়ক থেকে সরিয়ে সুপ্রবৃত্তিকে ফিরিয়ে আনতে পারে।
আলোকিত জীবন ব্যবস্থার দিকে ধাবিত করতে পারে। তাই প্রবেশন সার্ভিসের সমস্যা চিহ্নিত করে একটি যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলে প্রবেশন ব্যবস্থার আমূল এবং বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হবে। এতে অপরাধী সংশোধনের পাশাপাশি কারাগারের সংখ্যাধিক্য রোধ করা সম্ভব হবে এবং কারা ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্রীয় ব্যয় সংকোচন করাও সম্ভব হবে।