কোমায় ট্রমা সেন্টার!

মাহমুদুল হাসান প্রকাশিত: জুলাই ২৪, ২০২২, ১২:৩০ এএম

কোরবানির ছুটিতে বাইকে চড়ে ধামরাইয়ের মামাবাড়ি বেড়াতে যাচ্ছিলেন মো. আব্দুল্লাহ (২৪)। মানিকগঞ্জের বানিয়াজুরীতে ট্রাকের ধাক্কায় গুরুতর আহত হন। মস্তিষ্ক ও হাত-পায়ের হাড়ে আঘাতপ্রাপ্ত আব্দুল্লাহকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

সম্প্রতি পদ্মা সেতুতে এলপি গ্যাস সিলিন্ডারবাহী একটি ট্রাক উল্টে আহতদের উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজধানীতে নিয়ে আসার পথে দুইজনের মৃত্যু হয়। সড়ক-মহাসড়ক যত উন্নত হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল যেন তত পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। 

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, গেলো কোরবানির ঈদের আগে-পরের ১৫ দিনের দেশের সড়ক-মহাসড়কে ৩১৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৯৮ জন নিহত ৭৭৪ জন আহত হয়েছেন। যার  বেশির ভাগ চিকিৎসার আশায় দূরের হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই মৃত্যু হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি আরও জানিয়েছে, ২০২১ সালে দেশে পাঁচ হাজার ৬২৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন সাত হাজার ৮০৯ জন। আহত হয়েছেন ৯ হাজার ৩৯ জন। সড়ক, রেল ও নৌপথে মোট দুর্ঘটনার ৯১ শতাংশই সড়কে ঘটছে। 

এদিকে গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্ব ব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় যারা প্রাণ হারান, তাদের মধ্যে ৬৭ শতাংশই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্ষম (১৫-৬৪ বছর বয়সি)। আর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) হিসাবে, দেশে সড়ক দুর্ঘটনা এবং এর প্রভাবে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ বছরে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। যা পিডিপির ২ শতাংশ। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ঘটছে ছোট-বড় আকারের সড়ক দুর্ঘটনা। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারাচ্ছেন অনেক যাত্রী। কেউ বরণ করে নিচ্ছেন চিরস্থায়ী পঙ্গুত্ব। দুর্ঘটনাপরবর্তী চিকিৎসাসেবার অপ্রতুলতার জন্য আহতদের অনেকেই প্রাণ হারাচ্ছেন পরে। 

এমন পরিপ্রেক্ষিতে দেশের মহাসড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় প্রায় শতকোটি টাকা ব্যয়ে উন্নত ও আধুনিক ট্রমা সেন্টার নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। প্রায় দুই যুগ আগের ওই প্রকল্পে আনুমানিক শত কোটি টাকা ব্যয় হলেও এখনো সেবার দরজা খুলেনি। পঙ্গুদের চিকিৎসার পরিবর্তে বছরের পর বছর ধরে নিজেরাই পঙ্গু হয়ে পড়ে রয়েছে। চিকিৎসক, কর্মচারী, ওষুধ ও যন্ত্রপাতি সবই আছে কিন্তু সেবা কার্যক্রম নেই। ফলে যে মহৎ উদ্দেশ্যে এসব সেন্টার নির্মাণ করা হয়েছে তা ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি মারাত্মকভাবে আহতরা বঞ্চিত হচ্ছেন উপযুক্ত চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তি থেকে। দুর্ঘটনায় আহত মৃত্যু ভাঙছে অতীতের সব রেকর্ড। 

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ট্রমা সেন্টার বিষয়ের পরিকল্পনা থেকে জানা যায়, দুর্ঘটনাপ্রবণ মহাসড়কের পাশে ট্রমা সেন্টার নির্মাণ করে প্রাণ ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০০৪ সালে ফেনীর মহিপাল, ফরিদপুরের ভাঙা, মুন্সীগঞ্জের মাওয়া, সাভারের ধামরাই, টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা, চট্টগ্রামের লোহাগাড়া, কুমিল্লার পদুয়া, হবিগঞ্জের বাহুবল, ময়মনসিংহের ভালুকা ও ঝিনাইদহে ১০টি কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয় তৎকালীন সরকার। 

এরপর বর্তমান সরকার আরও প্রায় ১১টি ট্রমা সেন্টার নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। প্রতিটি ট্রমা সেন্টারে সাতজন সার্বক্ষণিক পরামর্শক চিকিৎসক, তিনজন অর্থো-সার্জন, দুজন অ্যানেসথেটিক, দুজন আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তাসহ ১৪ জন চিকিৎসক, সিনিয়র স্টাফ নার্সসহ ১০ জন নার্স, ফার্মাসিস্ট, রেডিওগ্রাফার, ল্যাব টেকনিশিয়ান, ড্রাইভার, অফিস সহকারী, ওয়ার্ড বয়, আয়া ও ল্যাব অ্যাটেনডেন্টের পদ সৃজনের প্রস্তাব করা হয়। 

এছাড়াও রয়েছে কুক-মশালচি, দারোয়ান, এমএলএসএস ও সুইপারসহ ৩৪ জন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর পদ পরিকল্পনায় উত্থাপন করা হয়। কিন্তু এখনো কোনো সেন্টারেই অনুমোদিত পদ অনুযায়ী নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয়নি। রয়েছে অন্যান্য সমস্যাও। ফলে কোনো সেন্টারই ট্রমা সেন্টার হিসেবে চালু করা সম্ভব হয়নি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে ফেনী মহিপাল ট্রমা সেন্টার নির্মাণ ব্যয় হয়েছে দুই কোটি ৭৬ লাখ টাকা। ২০ শয্যার ট্রমা সেন্টারে দুটি ভিআইপি কেবিন এবং ১৬টি সাধারণ শয্যাবিশিষ্ট। 

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সবচেয়ে দুর্ঘটনাকবলিত জোন কুমিল্লার দাউদকান্দিও ট্রমা সেন্টার নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ছয় কোটি টাকা। আউটডোর চালু হলেও এখনো পূর্ণাঙ্গ রূপে চালু হয়নি। ময়মনসিংহের ভালুকা ট্রমা সেন্টার নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় তিন কোটি টাকা। প্রায় দুই কোটি টাকা সমমূল্যের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হলেও সেগুলো বাক্সবন্দি হয়ে রয়েছে। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পাশে তিন কোটি ২২ লাখ ৫৬ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় টাঙ্গাইল ট্রমা সেন্টার। নেই লোকবল, যন্ত্রপাতি। 

চট্টগ্রামের লোহাগাড়া ট্রমা সেন্টারটি নির্মাণকাজে প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের মাঝামাঝি লোহাগাড়ায় ২০০৭ সালের জুন মাসে প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে এ ট্রমা সেন্টার নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০১৩ সালের ২৯ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের অন্যান্য প্রকল্পের সাথে উদ্বোধন করেন এ সেন্টার। এর বাইরে গাজীপুরে ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে বড় আকারের ট্রমা সেন্টার নির্মাণের কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেনি।

তথ্য অধিকার আইনে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, উপজেলা হেলথ কেয়ার (ইউএইচসি) অপারেশনাল প্ল্যানের কাছে শুধু ২১টি ট্রমা সেন্টারের সংখ্যা এবং হস্তান্তরের তথ্য রয়েছে। এর মধ্যে মাদারীপুরের শিবচর ট্রমা সেন্টার, চট্টগ্রামের হাটহাজারি ট্রমা সেন্টার, চট্টগ্রামের রাউজান ট্রমা সেন্টার, হবিগঞ্জের বাহুবল ট্রমা সেন্টার, সুনামগঞ্জের ছাতক ট্রমা সেন্টার ও সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা ট্রমা সেন্টার নির্মাণাধীন। 

তবে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর নির্মাণাধীন সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা ট্রমা সেন্টারটি জেলা সিভিল সার্জনের কাছে হস্তান্তর করেছে। হস্তান্তরের পরও লোকবল, যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্রের অভাবে এখনো চালু হয়নি শরীয়তপুরের জাজিরা ট্রমা সেন্টার, মানিকগঞ্জের শিবালয় ট্রমা সেন্টার, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া ট্রমা সেন্টার, পাবনার আটঘরিয়া ট্রমা সেন্টার, বগুড়ার শেরপুর ট্রমা সেন্টার, ফরিদপুরের মধুখালী ট্রমা সেন্টার, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ সংযুক্ত ট্রমা সেন্টার ব্যবহূত হচ্ছে অর্থপেডিক্স ওয়ার্ড। 

তবে কার্যক্রম নেই ট্রমা সেন্টারের। কিশোরগঞ্জের ভৈরব ট্রমা সেন্টার চালু হয়নি। করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির সময় ব্যবহূত হয়েছিল কোভিড হাসপাতাল হিসেবে। চট্টগ্রামের লোহাগাড়া ট্রমা সেন্টার প্রশাসনিক অনুমোদন হলেও লোকবল নেই। কোভিডকালে ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। 

কুমিল্লার দাউদকান্দি ট্রমা সেন্টারের বহির্বিভাগের কার্যক্রম চালু হয়েছে। প্রশাসনিক অনুমোদন হয়েছে। একজন অর্থপেডিক কনসালটেন্ট, একজন নার্স কর্মরত রয়েছেন। কোনো মেডিকেল অফিসার পদ নেই। ফেনী সদরের মহিপাল ট্রমা সেন্টারের বহির্বিভাগ চালু রয়েছে। সেখানে একজন আবাসিক মেডিকেল অফিসার, একজন মেডিকেল অফিসার ও নার্স রয়েছেন। ময়মনসিংহের ভালুকা ট্রমা সেন্টার চালু রয়েছে। 

সেখানে একজন কনসালটেন্ট কর্মরত রয়েছেন। ঢাকার ধামরাই উপজেলা ট্রমা সেন্টার ভবনটি হস্তান্তর করা হয়নি। কিছু যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়েছিল। সেগুলোও নষ্ট হয়ে গেছে। গোপালগঞ্জের সদরের ট্রমা সেন্টারটি নির্মাণকাজ শেষে এখনো হস্তান্তর করা হয়নি।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মহাসড়ক (ঢাকা মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের) এবং পদ্মা সেতু থেকে সবচেয়ে কাছে মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। মহাসড়ক থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের দূরত্বে শ্রীনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পাশে ট্রমা সেন্টারটি নির্মাণ করা হয়। 

গত আট বছরেও ভবনটি বুঝে নেয়া হয়নি। চালু করার কোনো উদ্যোগও নেয়া হয়নি। স্থানীয়রা জানান, ভবনটি দীর্ঘদিন পড়ে থাকায় সীমানা প্রাচীর টপকে ভেতরে মাদকের আড্ডা হয়। শ্রীনগর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আবু তোহা মো. শাকিল বলেন, এক্সপ্রেসওয়ে কোলঘেঁষা আমার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। 

এই মহাসড়কে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে প্রথমে আমার হাসপাতালে রোগী নিয়ে আসা হয়। ট্রমা সেন্টারটি বন্ধ থাকায় রোগীদের সেবা না দিয়ে উল্টো হতাশ করে দিয়ে ঢাকায় রেফার্ড করতে হয়। দুর্ঘটনার ক্ষতি কমিয়ে আনতে মহাসড়কের পাশের এই ট্রমা সেন্টার চালু সময়ের দাবি। এ জন্য আমি অতিরিক্ত যেকোনো দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত। 

মুন্সীগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. মো. মঞ্জুরুল আলম বলেন, ট্রমা সেন্টারের এখন পর্যন্ত শুধু অবকাঠামো হয়েছে। পিডাব্লিউডি এখনো আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগকে ভবনটি হস্তান্তর করেনি।

ঢাকার ধামরাই ট্রমা সেন্টার, শিবালয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সংলগ্ন ট্রমা সেন্টার, মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলা ট্রমা সেন্টার  ও শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলা ট্রমা সেন্টার এখনো চালু করা সম্ভব হয়নি। জাজিরা উপজেলা ট্রমা সেন্টারটি অবহেলায় পড়ে থাকেনি। প্রতিষ্ঠানটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবন হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। ঢাকা আরিচা মহাসড়কের পাশে ধামরাই ট্রমা সেন্টার। তিনতলা ভবনটি এখনো হস্তান্তর করেনি ঠিকাদার। 

এক যুগেরও বেশি সময় আগে তিনতলা ভবন নির্মাণ শেষ হলেও লোকবল, যন্ত্রপাতি কোনো কিছুই দেয়া হয়নি। ঠিকাদার থেকে ভবনটিও বুঝে নেয়া হয়নি। তালাবদ্ধ ভবনের লোহার দরজা-জানালায় মরিচা ধরেছে। ফ্লোরে ময়লার ভাগাড়। ভেতরে-বাইরে শ্যাওলা পড়েছে। খসে পড়েছে পলেস্তারা। 

মানিকগঞ্জে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ ও মিশুক মনির মারা যাওয়ার পর ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসায় শিবালয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ট্রমা সেন্টার স্থাপনের জন্য চার তলাবিশিষ্ট অত্যাধুনিক ভবন নির্মিত হয়। ময়লার ভাগাড় পরিণত হলেও সেন্টারটি এখনো চালু হয়নি। 

মানিকগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. মোয়াজ্জেম আলী খান চৌধুরী বলেন, জেলায় দুটি ট্রমা সেন্টার করা হয়েছে। শিবালয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সাথে ২০১৪ সালে একটি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এখনো হস্তান্তর করা হয়নি। লোকবল পদায়ন ও লজিস্টিক সরবরাহ করা হয়নি। লজিস্টিক ও লোকবল পেলে সেন্টারটি চালু করা যাবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, ট্রমা সেন্টারসহ যতগুলো অবকাঠামো হয়েছে কিন্তু জনবল, ফার্নিচার, মেডিকেল ইক্যুইপমেন্ট হয়নি  সবগুলো নিয়েই একটি কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। ট্রমা সেন্টারের কনসেপ্টটাই ভুল ছিল। আমরা যেখানে উপজেলা লেভেলেই এখনো পর্যাপ্ত চিকিৎসক দিতে পারছি না বা রাখতে পারছি না সেখানে একটি রাস্তার পাশে ট্রমা সেন্টার করা। ওখানে তো একজন রোগীর আইসিইউ লাগতে পারে। কিভাবে আইসিইউ সেটাপ করবে। 

ওখানে বিদ্যুৎতের একটা ব্যাপার আছে। ওখানে একটি ওটি লাগতে পারে। তাও একটি ওটি লাগা মানে ওখানে একজন অ্যানেস্থেসিয়া মাস্ট লাগবে। একজন অর্থপেডিক কনসালটেন্ট মাস্ট লাগবে। এরকম একটি সেটাপ লাগবে। কিন্তু এরকম সেটাপ তো আমরা দিতে পারব না। এর চেয়ে বলা হয়েছিল— যদি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে আমরা স্ট্যান্ডার্ড করি। ট্রমার বিষয়টি যদি উপজেলায় আলাদাভাবে স্ট্যান্ডার্ড করি। 

এরপর কিন্তু অনেকগুলো ট্রমা সেন্টার হয়েছে উপজেলার ভেতরে। তাহলে যেখানে অ্যাক্সিডেন্ট হবে তাৎক্ষণিকভাবে কিন্তু উপজেলা ট্রমা সেন্টারে চিকিৎসা নিতে পারবে। শুরুতে ডিসিশন ছিল হাইওয়ের পাশে করতে হবে। তিনি বলেন, যেহেতু আমরা শতকোটি টাকার কাজ করে ফেলেছি তাই ভবনগুলো তো ফেলে রাখা যাবে না। সুতরাং এখান থেকে যেই সেবাই হোক সেটা আমাদের দিতে হবে। 

এগুলো কাজে লাগানোর একটা আলোচনা চলতেছে। ধরুন ওখানে সপ্তাহে দুই তিন দিন একজন অর্থপেডিক ডাক্তার যাবেন। ফিজিউথেরাপিস্ট যাবেন। রোগী দেখবেন। প্রাথমিক চিকিৎসা দেবেন। এরকম একটা ফাংশনাল প্রাইমারি আলোচনা চলছে। ফেলে রাখার আর সুযোগ নেই, আমরা কাজে লাগাব।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক বলেন, ‘আলাদাভাবে একটা ভবন করে ট্রমা সেন্টার করে এটি ইকোনমিক না, এটা পসিবল না। ধরো সড়ক দুর্ঘটনা হলো হাতে আঘাত লাগল, মুখে, পেটেও আঘাত লাগল। বুকে আঘাত লাগলে চেস্ট সার্জন লাগে। পেটে আঘাত লাগলে জেনারেল সার্জন লাগে। মাথায় আঘাত লাগলে নিউরোসার্জন লাগে। চোখে আঘাত লাগলে অফথামোলজিস্ট লাগে। 

সুতরাং একটি ট্রমা সেন্টারের ম্যানেজমেন্টে একজন আঘাতপ্রাপ্ত রোগীকে যদি চিকিৎসা ভালোভাবে করতে হয় তাহলে এসব স্পেশালিটির লোক অ্যাভেইলেবল করতে হবে। তাহলে আমাদের কি করতে হবে? যেখানে বড় হাসপাতাল আছে, যেখানে জেনারেল হাসপাতাল আছে, উপজেলা বা জেলা হাসপাতাল আছে সেই হাসপাতালের সাথে একটা ট্রমা উইং রাখতে হবে। কারণ ওই হাসপাতালে নিউরোসার্জন আছে, চেস্ট সার্জন আছে। জেনারেল সার্জন আছে, আই স্পেশালিস্ট আছে, অর্থপেডিক সার্জন আছে। এক কথায় সবাই আছে। 

তাদের আবার আলাদা করে লোক লাগছে না। সুতরাং যেখানে রোডসাইডের কাছাকাছি জেনারেল হাসপাতাল আছে সেখানে, অথবা যদি ট্রমা সেন্টার করতে হয় তাহলে এসব স্পেশালিটিকে অ্যাভেইলেবল করে সেখানে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। আর যদি আমরা মনে করলাম, একজনে হাতে আঘাত পেয়েছে তাকে প্লাস্টার করে বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। তাহলে যার মাথায় আঘাত লাগছে তার কী করব? 

সুতরাং ট্রমা সেন্টার যেভাবে যে উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল তখন আমি বলেছিলাম এটি নন ফাংশনাল। এটি হয় না, এটি নট ফিজিবল। এটি এক সময় চিন্তা করেছিল বিদেশিরা। আমি তখন বলেছিলাম তোমাদের এই থিউরি ভুল। কিন্তু আমার কথা কেউ শুনেনি। ট্রমা সেন্টার তৈরি করা হয়েছিল। 

এখন তো সেখানে জনবলও নেই, জিনিসপত্রও নেই। আমি যেসব জনবলের কথা বললাম সেটি দিতে পারলে ট্রমা সেন্টার ফাংশনাল হতে পারে। তাতে একটি জেনারেল হাসপাতাল চলতে পারে। একটি ছেলের রগ ছিড়ে যেতে পারে, পেটের মধ্যে আঘাত লাগতে পারে। আমি যেটি মনে করি রেডসাইডে যেই বিল্ডিং হয়েছে সেটি প্রাইমারি ট্রিটমেন্ট সেন্টার হতে পারে, ট্রমা সেন্টার হতে পারে না। 

প্রাইমারি ইঞ্জুরি ম্যানেজমেন্ট সেন্টার হতে পারে। চোখে আঘাত লাগছে একটা ব্যান্ডেজ করে সেকেন্ডারি চিকিৎসার জন্য পাঠিয়ে দিতে পারে।’ আমার সময় আমি আ বিদেশি থিউরি বাদ দিয়ে বড় বড় জেনারেল হাসপাতালের পাশে বা উপজেলা হাসপাতালের পাশে রোড সাইডে কোনো হাসপাতাল পড়ে সেখানেই ট্রমা সেন্টার বা উইংটা যোগ করা যেতে পারে। তাহলেই পসিবল।’
 
তিনি বলেন, ‘ট্রমা সেন্টার করতে হলে স্পেশালিস্ট, মাল্টি স্পেশালিস্ট লাগবে। মাল্টি স্পেশালিস্ট না থাকলে ট্রমা সেন্টার অপারেট করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া এসব প্রাইমারি সেন্টার হতে পারে। তার সাপোর্টে আশপাশে বড় হাসপাতাল থাকতে হবে। একটা স্যালাইন দিয়ে দিলো। ব্যাথার ওষুধ দিয়ে ইমিডিয়েট রেফার্ড করতে হবে যেখানে রোগীর দরকারি ফ্যাসিল্টি থাকবে। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. সামিউল ইসলাম বলেন, ট্রমা সেন্টার ডেভলপমেন্ট প্রসেসে আছে। প্রায়রিটি আছে। লোকবল, পদ সৃজন, স্ট্যান্ডর্ড কাঠামো তৈরির চেষ্টা করছি। সবচেয়ে আধুনিক করতে হলে পাঁচ থেকে ১০টি বেড করে ট্রমা সেন্টার সম্ভব নয়। তিনি বলেন, যেগুলোর ভবন নির্মাণ শেষ হয়েছে সেগুলো ২০২৩ সালের মধ্যে ফাংশনিংয়ের পরিকল্পনা রয়েছে। বাকিগুলো আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে চালু করা হবে।’