নাম তুলা মিয়া, বয়স ৫৫ বছর, গ্রামের বাড়ি বরিশাল। দীর্ঘদিন ধরে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন ঢাকার কেরানীগঞ্জে। একরুমের একটি টিনশেডের ঘরে দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন তিনি। ঘরভাড়া ও থাকা-খাওয়া মিলিয়ে প্রতিমাসে তার খরচ হয় প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। তিনি সদরঘাটে নৌকায় করে যাত্রী পারাপার করে প্রতিদিন আয় করেন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা।
তিনি বলেন, ‘একদিকে নিত্যপণ্যের দাম বেশি অন্যদিকে আগের মতো আয়রোজগারও নেই। এখন আর নৌকার আয়ে চলে না সংসার। আমার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে অসুখও বাসা বেঁধেছে। মেয়ে বড় হয়েছে তাকে বিয়েও দিতে হবে। আমার চিন্তার কোনো কূল কিনারা নাইগো। একেতো অন্য কাজ করার বয়স নেই, আবার এ পেশা ছেড়ে দিতেও পারছি না।’
সদরঘাটের আরেক মাঝি সুলেমান রহমান, বয়স ৪৪ বছর, গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠি। তার পরিবারের সবাই গ্রামের বাড়িতে থাকেন। তিনি থাকেন নৌকাতেই। গত ১০ বছর ধরে নৌকা ভাড়া নিয়ে যাত্রী পারাপারের কাজ করছেন। মালিককে নৌকার ভাড়া দেন ৯০ টাকা, আর তিন বেলা খাওয়াসহ অন্যান্য খরচ হয় ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা। যাত্রীপারাপারে দৈনিক আয় করেন সাড়ে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। সবমিলিয়ে দিনে যা আয় হয় তার অর্ধেকের বেশি খরচ হয়ে যায়। মাস শেষে হাজার পাঁচেক টাকা বাড়িতে পাঠাতে পারেন।
তিনি বলেন, কলা-রুটি খেতে গেলেও ৩০ টাকা লাগে। সবকিছুর দাম এখন ডাবল ডাবল। বাড়িতে যে টাকা পাঠায় তাতে হয় না। লঞ্চে আগের মতো যাত্রীর চাপ থাকলে নৌকাতেও কামাই হয়। কিন্তু এখন আর আগের মতো নেই। মেয়ে বড় হয়েছে, বিয়ে দিতে হবে। চিন্তা করছি নৌকা আর চালাব না। নৌকার আয় দিয়ে আর সংসারের খরচ চালানো যাবে না। শুধু সদরঘাট এলাকার মাঝিদের অবস্থা এমন নয়, অন্যান্য ঘাটের মাঝিদেরও এখন আর নৌকা বয়ে সংসার চলছে না।
সদরঘাট, বেরাইদ বোর্ড ঘাট, ডেমরা ঘাট, আমিন বাজার ঘাটের মাঝিরা দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, চারদিকে নতুন নতুন ব্রিজ হওয়ায়, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো থাকায় মানুষজন বাসে বা অন্যান্য বাহনে চলাচল করছেন। কোনো উৎসব ও পিকনিক ছাড়া মানুষজন নৌকায় উঠছেন না। ফলে জৌলুস হারাচ্ছে নৌকা, আর মাঝিরা সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। নিত্যপণ্যের দাম বেশি থাকায় দৈনিক যে টাকা আয় করেন মাঝিরা, তাতে বাজারের থলে ভরছে না।
এতে অনেকে এ পেশা ছাড়তে চাইলেও বয়স বেশি হওয়ায় ছাড়তেও পারছেন না। এছাড়া পদ্মা সেতু চালু হওয়ার আগে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে যাত্রীর চাপ বেশি ছিল। কিন্তু এ সেতু চালু হওয়ায় নৌকার আয় অনেক কমে গেছে। সাধারণত যারা সদরঘাট দিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে যেতে চায় তারা যায়। সদরঘাটে শতাধিক নৌকা রয়েছে সে অনুযায়ী যাত্রী নাই। একদিকে আয় কম অন্যদিকে নিত্যপণ্যের দাম বেশি। তাতে সংসার চালানো কঠিন হয়ে গেছে।
এদিকে বাবু বাজার ব্রিজ, পোস্তগোলা ব্রিজ, বালু নদীর উপর নির্মিত সুলতানা কামাল সেতু দিয়ে যাত্রীরা চলাচল করছেন। এছাড়াও সড়কে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় নৌকার চাহিদা কমে গেছে। ফলে ধীরে ধীরে নৌকার সংখ্যারও কমে গেছে।
বেরাইদ বোর্ড ঘাটের মাঝি জামালউদ্দীন বলেন, আমি নৌকা বেয়েই সংসার চালাই। আমি বেরাইদ এলাকায় একটি টিনশেডের বাসায় একটি রুমে স্ত্রী-সন্তানসহ চারজন থাকি। একছেলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। আর মেয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ে। এ ঘাটে শুধু নাওড়া এলাকার বাসিন্দারা চলাচল করে। দৈনিক যে টাকা আয় হয় তাতে বাসা ভাড়া, খাবার খরচ চালানোই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রোজগারের অবস্থা ভালো না, ছেলে-মেয়েদের আর পড়াশুনা করাতে পারব কি-না জানি না। আমার স্ত্রী গৃহকর্মীর কাজ করেন। নৌকার আয়ে আর সংসার চলছে না। ভাবছি রিকশা চালাব। পোলাপান মানুষ করব।
সদরঘাট, বেরাইদ ঘাট ও আমিন বাজার ঘাট এলাকার নৌকার মালিক-ইজারাদাররা বলেন, আগে অনেক নৌকা ছিল। এখন নৌকা নেই বললেই চলে। বুড়িগঙ্গা নদীর উপর সদরঘাটের দুই দিকে দুইটা বড় বড় ব্রিজ। বাবুবাজার ব্রিজ ও পোস্তাগোলা ব্রিজ। ব্রিজ হওয়ায় দুই দিকের মানুষের চাপ কমেছে নৌকায়। এছাড়াও যাতায়াত সহজ হওয়ায় ব্রিজের উপর দিয়ে যাতায়াত বেড়েছে মানুষের। ফলে চাপ কমেছে পারাপারের নৌকায়।
সদরঘাট এলাকার মাঝি ফজলু মিয়া বলেন, বন্যা ও নদীভাঙনে সব কিছু হারিয়ে ঢাকায় বসবাস করছি। পরিচিত এক আত্মীয়ের বাসায় থেকে সদরঘাটে নৌকায় যাত্রী পারাপারের কাজ করছি। গত সাত বছর ধরে নৌকাই আয়ের উৎস। তবে বর্তমান সময়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। দিনে ৬০০-৭০০ টাকা আয় করি। দৈনিক নৌকার মালিককে ভাড়া দেই ৯০ টাকা, চা, নাস্তা-বিড়ি ১০০ টাকা, দুপুরের খাবার ৯০-১১০ টাকা। থাকে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। পাঁচজনের সংসারে চাল, ডাল, তরিতরকারি কিনে মাছের বাজারে যাওয়ার সুযোগ খুব কম থাকে। এই টাকা নিয়ে বাজারে গেলে থলে ভরে না। জিনিসের যে দাম তাতে করে চলা মুশকিল। মাংসের মুখ চোখে দেখি না বহুদিন। আগে চলত কিন্তু সব জিনিসের দাম বাড়ায় এখন আর কুলাতে পারি না।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহীন মোল্লা বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে নৌকার চাহিদাও কমে গেছে। তাতে মাঝিদের আয়ও কমে গেছে, ফলে এ ক্ষুদ্র আয়ে তাদের সংসার চালানো খুবই কষ্টকর, এসব মাঝি বা এই মুহূর্তে যারা বেকার মাঝি রয়েছে তাদের সাথে সরকারের সংশ্লিষ্টদের আলাপ আলোচনা করা দরকার। এসব মাঝিরা অন্য কোনো পেশা গ্রহণ করতে আগ্রহী সে অনুযায়ী তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। পাশাপাশি তাদের জন্য নামমাত্র সুদের বিনিময়ে ঋণের ব্যবস্থা করা, যাতে তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, উন্নয়ন বা সময়ের সাথে অনেক পেশার পরিবর্তন ঘটছে। আর প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের কারণে যে পেশাগুলো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, পাশাপাশি এর সাথে মূল্যস্ফূতি যুক্ত হয়ে তাদের অবস্থাটা শোচনীয় হওয়ার পথে। তাই বেকার মাঝি বা ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য নিজস্ব মোবাইল নাম্বারে বেকারভাতার ব্যবস্থা করা। তবে এ ভাতা দেয়ার আগে তাদের তালিকা তৈরি করা।