টিকটক ভিডিও বানানোর জন্য মায়ের কাছে মোবাইল চেয়েছিল ১০ বছরের শিশু সাজ্জাদ হোসেন হিমেল। কিন্তু মা রুমি আক্তার তাকে মোবাইল দেয়নি। ছেলেকে ঘরে রেখে তালা দিয়ে গোসলে যান তিনি। গোসল থেকে ফিরে দরজার তালা খুলে ঘরে ঢুকেই দেখেন সাজ্জাদের গলায় ওড়না প্যাঁচানো, ঝুলে আছে জানালার গ্রিলের সাথে।
তাৎক্ষণিক তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনাটি গত ২৯ জুলাইয়ের। লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার সোনাপুর ইউনিয়নের রাখালিয়া গ্রামের কাতার প্রবাসী খোকনের ছেলে সাজ্জাদ।
সে স্থানীয় একটি কেজি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ত। শুধু সাজ্জাদ নয়, চলতি বছরে অনলাইনে ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম টিকটকে ভিডিও করতে গিয়ে ১১ তরুণ-তরুণী প্রাণ হারিয়েছে। কেউ ইচ্ছাকৃত, কেউ আবার অনিচ্ছাকৃত। এই প্ল্যাটফর্মে প্রতিনিয়তই বিভিন্ন ধরনের নতুন নতুন ভিডিও তৈরির ট্রেন্ড চলছে।
আর এসব ঝুঁকিপূর্ণ ট্রেন্ড অনুসরণ করে ভিডিও বানাতে গিয়েই বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে অল্প বয়সি কিশোর-কিশোরীরা। এ ছাড়াও সমাজে যৌন নিপীড়ন, নারীপাচার, অশ্লীলতা ও কিশোর অপরাধও উসকে দিচ্ছে ভার্চুয়াল মাধ্যম টিকটক। এর মাধ্যমে পাচারকারী চক্র নারী-শিশু ও কিশোরীদের টার্গেট করে ভালো চাকরি, নায়িকা বা মডেল বানানোর লোভ দেখায়।
সাম্প্রতিক সময়ে এরকম একটি পাচারের ঘটনাও আলোড়ন তৈরি করে। ভারতে পাচার হওয়া একজন নারী তিন মাসের বন্দিদশা থেকে পালিয়ে ঢাকার হাতিরঝিল থানায় মামলা করার পর পুলিশ একটি চক্রের তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। সেই তরুণীকে টিকটকের তারকা বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে ভারতে পাচার করা হয়েছিল। পরে সেখানে তাকে আটকে রেখে যৌনকর্মে বাধ্য করা ও নির্যাতন করা হয়।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের সহায়তায় ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামে মানবপাচার নিয়ে একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে ভারতে অথবা ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপে মানবপাচারের ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যবহার বেড়েছে।
বিশেষ করে ফেসবুক, টিকটক, ইমোসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। মাসে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ পাচারের শিকার হচ্ছে বলে গবেষকরা ধারণা করেন। শুধু ভারতে পাচার হওয়া দুই হাজার নারীকে গত ১০ বছরে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের এক প্রতিবেদনে লক্ষ করা যায়, গত কয়েক বছর যাবৎ চীনা শর্ট ভিডিও মেকিং প্ল্যাটফর্ম টিকটকের অপব্যবহার এতটা বেড়েছে যে, বর্তমান প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে মৃত্যুফাঁদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে টিকটক। নায়ক-নায়িকা, মডেল, সংস্কৃতিকর্মীসহ অনেকেই টিকটকে গা ভাসিয়েছেন।
এর থেকে বাদ যায়নি শিক্ষক, শিক্ষার্থী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। এমনকি টিকটক ভিডিও করে সরকারি-বেসরকারি চাকরি থেকে বহিষ্কারের মতো ঘটনাও ঘটেছে। তাছাড়া পাড়া-মহল্লায় টিকটক নিয়ে গড়ে উঠছে কিশোর গ্যাং। কিন্তু বাংলাদেশে টিকটকের কোনো লাইসেন্স না থাকায় তাদের আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না। ফলে এই প্রতিষ্ঠানটিকে আইনি কাঠামোর আওতায় আনার জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানানো হয়েছে।
ওই কমিটিতে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীকে চেয়ারম্যান ও কমিশনের কোনো সদস্য বা সচিবকে সদস্য করার পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন।
এ প্রসঙ্গে সংগঠনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, এত তরুণ-তরুণীর মৃত্যুর কারণ টিকটক হলেও এখন পর্যন্ত টিকটক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কোনো অভিভাবক বাংলাদেশে মামলা করেনি। টিকটক বাংলাদেশের লাইসেন্সধারী কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। এই প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে অথচ সরকার এই প্ল্যাটফর্ম থেকে কোনো প্রকার রাজস্ব পায় না।’
সম্প্রতি ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, এক তরুণী রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে টিকটকের ভিডিও করতে গিয়েছিল এবং ঠিক সেই সময়েই ট্রেন চলে আসে এবং সে বুদ্ধি করে রেললাইনের মাঝের ফাঁকা জায়গায় শুয়ে পড়ে নিজেকে রক্ষা করে।
টিকটককে মৃত্যুফাঁদ হিসেবে উল্লেখ করে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, গত ৮ জুলাই নোয়াখালীর চাটখিলে আলমারির ওপর উঠে আড়ার সাথে ফাঁস দেয়ার অভিনয় করে টিকটক ভিডিও বানানোর সময় অসাবধানতাবশত পা পিছলে গেলে সানজিদা আক্তার নামে (১০) বছর বয়সি এক কিশোরীর মৃত্যু হয়। সে শিবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। এর কয়দিন পরই ১১ জুলাই কুমিল্লায় চলন্ত ট্রেনের ছাদে টিকটক করতে গিয়ে পা পিছলে ১৫ বছর বয়সি মেহেদী হাসান নামে এক কিশোরের মৃত্যু হয়।
এর আগে গত ৬ জুন রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায় দুটি মোটরসাইকেল নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছিল ছয় বন্ধু। এ সময় টিকটকের জন্য মোবাইল ফোনে ভিডিও করতে গেলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি মোটরসাইকেল সড়কের পাশে গাছের সঙ্গে ধাক্কা খায়। এতে নবম শ্রেণির ছাত্র কিশোর আফিফ হোসেনের মৃত্যু হয়।
গত ২ মার্চ রাজবাড়ী জেলার কালুখালি উপজেলায় টিকটক করতে গিয়ে রেলের নিচে কাটা পড়ে মৃত্যু হয় হোসেন (১৬) নামে এক কিশোরের। ৮ মে নড়াইলের কালিয়ায় টিকটক করতে বাধা দেয়ায় মায়ের সাথে অভিমান করে কীটনাশক পানে আত্মহত্যা করে সুমি আক্তার (১৯)।
১৬ মে চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার শহরের লাল ব্রিজের কাছে হূদয় (১৫) নামে এক কিশোর নকশি কাঁথা এক্সপ্রেস ট্রেনের সামনে টিকটক বানাতে গিয়ে কাটা পড়ে। ২২ মে নীলফামারীর সৈয়দপুরে টিকটক করতে গিয়ে নদীতে ডুবে মৃত্যু হয় মুস্তাকিম ইসলাম (১৬) নামে এক কিশোরের।
এ ছাড়া পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে তার অন্যতম কারণ টিকটক। গত ৩ জুলাই রাজশাহীতে ‘কিশোর গ্যাং’-এর দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বে খুন হয় ১৭ বছর বয়সি সনি। প্রথমে সানি তরবারি হাতে নিয়ে টিকটকে ভিডিও আপলোড করলে প্রতিপক্ষ গ্রুপ তা নিজেদের জন্য হুমকি মনে করে।
এর জেরেই খুন করা হয় সানিকে। এর আগে ২০১৯ সালের মার্চ মাসে টিকটক ভিডিও আপলোডকে কেন্দ্র করে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আরাফাত খুন হয়। র্যাবের এক কর্মকর্তা জানান, টিকটকের মাধ্যমে অপরাধে জড়ানো বা বিপদে পড়া তরুণ-তরুণীদের মধ্যে অধিকাংশ তরুণী।
আর এদের মধ্যে নবম থেকে শুরু করে একাদশ প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরাই ৯৫ শতাংশ। টিকটক ও ইমোর মাধ্যমে এসব উঠতি বয়সি অপরিচিত তরুণ-তরুণীরা নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তুলছেন। পরে সেই সম্পর্কের হাত ধরে বাড়ি থেকে অজানা উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ছে তারা। এভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে বেশি বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে তরুণীরা।
এদিকে গত ২১ জুলাই টিকটক ব্যবহারকারীদের ওপর নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এ জন্য তারা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করে। এরপরই ২৬ জুলাই টিকটটের একটি টিম বাংলাদেশে এসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার সাথে বৈঠক করার কথা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে আসেননি টিকটক কর্তৃপক্ষ।
ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম ইউনিটের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ তারেক বিন রশিদ আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমরা টিকটকসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমগুলো সার্বক্ষণিক মনিটরিং করছি। মানবপাচার ও অপরাধের সাথে যুক্ত— এমন কোনো চক্র পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছি।
এছাড়াও আমরা একটি নিজস্ব ওয়েবসাইট তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি, যেখানে সাইবার ক্রাইম সম্পর্কে সচেতনতামূলক ধারণা দেয়া হবে। একই সাথে কেউ প্রতারণার শিকার হলে কী করণীয় আছে সে বিষয়ে পরামর্শ থাকবে। টিকটক কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাদের আসার কথা থাকলেও তারা আসেনি। পরবর্তীতে আবার মিটিংয়ের তারিখ জানাবে টিকটক টিম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, ‘টিকটক প্রযুক্তি আমাদের তরুণদের স্থিরতার চেয়ে অস্থিরতা ও উত্তেজনায় ভরিয়েছে বেশি। মানুষের মনে আকাশের ব্যাপ্তির চেয়েও বেশি ভাবনা ভর করতে পারে। তবে প্রকাশ্যে পরিমার্জন প্রয়োজন। আমাদের তরুণ সমাজের একটি অংশ উদ্ভট সংস্কৃতির আয়োজনে সাময়িক উত্তেজনায় যেসমস্ত কর্মে লিপ্ত হচ্ছে, তা মেনে নেয়া কষ্টকর। সমাজের মধ্যকার পচন, চিন্তার বিকৃতিপনা, মনুষ্য সংযুক্তির শরীরবৃত্তীয় চাহিদা টিকটকের মূল উপজীব্য।
এর মধ্য দিয়ে দুই ধরনের আসক্ত ব্যক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। যারা তৈরি করছে তারা নির্মাতা আসক্ত, অন্য পক্ষটি দর্শক আসক্ত। ফলে সমাজে নৈতিকতা গঠনে ও অনুশীলনে সমাজ গৃহীত রূপ পরিত্যাজ্য হচ্ছে। প্রয়োজন সম্মিলিত প্রতিরোধ পদক্ষেপ।
তিনি আরও বলেন, টিকটক প্রতিরাধে গৃহীতব্য ব্যবস্থাটি কঠিন ও কঠোরভাবে নেয়া উচিত। অন্যথায় প্রতিটি ঘরের পাশে একটি করে থানা বসাতে হবে। এখনই সময় জেগে ওঠার, নিজেদের তৈরি করার। সমাজ রূপান্তরের সময় চলছে। ঠিক না হলে পস্তাতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মাহফুজা খানম বলেন, ‘টিকটক কিশোর অপরাধের মতো ঘটনা উসকে দিচ্ছে। কিশোরদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তারা যে অপরাধগুলো করে তা একাকী নয়, দলগতভাবে করে থাকে। এ ক্ষেত্রে যেসব কিশোর-কিশোরীর চিন্তাভাবনা একই ধরনের, তারা যখন কোনো নেতিবাচক কাজ করে তা দলগতভাবেই করে। ফলে এই কম বয়সিদের মাদক গ্রহণ ও সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। যদি সরকারিভাবে এ ধরনের অ্যাপস নিয়ন্ত্রণ করা হতো তাহলে এর এত অবাধ ব্যবহার হতো না।