সারের মূল্যবৃদ্ধি

কৃষকের কপালে চিন্তার ভাঁজ

বেলাল হোসেন প্রকাশিত: আগস্ট ৪, ২০২২, ০৩:৫০ পিএম

চলমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ডামাডোলই মূলত দাম বৃদ্ধির প্রধান কারণ বলে দাবি করছে সরকার। এর ফলে শঙ্কায় আছেন দেশের প্রান্তিক চাষিরা।

ডিলার পর্যায়ে ইউরিয়া সারের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য কেজি প্রতি ১৪ থেকে বাড়িয়ে ২০ টাকা এবং কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি ১৬ থেকে বাড়িয়ে ২২ টাকা পুনর্নিধারণ করা হয়েছে।  হঠাৎ করে ইউরিয়া সারের কেজিপ্রতি ছয় টাকা দাম বৃদ্ধি করায় আবাদ নিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন কৃষকরা। বর্তমানে আমনের ভরা মৌসুমে হঠাৎ করে ইউরিয়া সারের দাম বাড়ায় তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ।

আবাদের খরচ বাড়ার শঙ্কায় প্রান্তিক চাষিরা বলছেন, বিঘা প্রতি এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ হবে। কৃষকরা আরো বলছেন, এ বছর বর্ষায় ঠিকমতো বৃষ্টি না হওয়া এবং বিদ্যুতের ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে এমনিতে সেচ ও চাষে ডিজেলের ব্যবহার বাড়ায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে। সারা দেশে কৃষকরা সেচ ও চাষ দিয়ে জমি প্রস্তুত করে ধান রোপণ করছেন।

গত মৌসুমে দাম বেশি পাওয়ায় এবার কৃষকরা ধান চাষে ঝুঁকেছেন। বর্ষা মৌসুমে চাষ হওয়ায় আমন ধানে সেচ খরচ কম লাগে কৃষকের। কিন্তু এবার পাল্টে গেছে সে হিসাব। পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় জমি চাষ ও সেচ দিতে খরচ বেশি হচ্ছে কৃষকের। তারপর কেজিতে ছয় টাকা বেড়েছে ইউরিয়ার সারের দাম। সারের দাম বাড়ায় আমন ধানসহ সব ধরনের ফসলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে।

রংপুর পীরগঞ্জ থানার আরাজি গঙ্গারামপুর গ্রামের বর্গাচাষি লালমিয়া আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমি অল্প জমি বর্গা নিয়া চাষ করি, বর্তমানে সব কিছুর দাম বাড়তি— এর ওপর আবার যোগ হলো সারের দাম। এত খরচ করে তো ধানের দাম পাওয়া যায় না।’

তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘বর্তমানে যে অবস্থা তাতে আর জমি চাষ করে পেটে ভাত হবে না। কোথাও হয়তো কাজ-টাজ করে জীবন চালাতে হবে।’

কৃষি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এক বছর আগে ২০২১ সালের জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি ইউরিয়ার দাম ছিল ৩২ টাকা। চলতি বছরের জুলাইয়ে সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮১ টাকায়। এমওপি (পটাশ) সারের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। গত বছর প্রতি কেজি এমওপির দাম ছিল ৪০ টাকা। এবার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২০ টাকায়। টিএসপি সারের দাম বেড়েছে ১৫০ শতাংশ। গত বছর যে টিএসপি সার ছিল ৪২ টাকা কেজি, সেই সার এবার ১০৫ টাকা কেজি। ডিএপি সারের দাম ১৬৬ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১২০ টাকা।

এ বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম আমার সংবাদকে বলেন, সারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে কৃষকদের ওপর মনস্তত্বিক নীতিবাচক প্রভাবে তারা চাষাবাদ থেকে নিরুৎসাহিত হবে। খড়া, পানির সমস্যার কারণে আমন ধানের উদৎপাদন এমনিতেই বিলম্ব হবে এর মধ্যে সারের দামটা এমন সময় বাড়ানো হলো এতে করে আমনের উৎপাদন কমে যাবে। ইউরিয়া সারের দাম বাড়ানোয় এই সারের ব্যবহার কমে যাবে এর ফলে অন্যান্য সারের ব্যবহারও কমে যাবে।

এর ফলে খাদ্যশস্য উৎপাদনে কৃষকদেরকে নিরুৎসাহিত করবে এবং উৎপাদন বাধাগ্রস্ত করবে। আমন যদি বাধাগ্রস্ত হয় তাহলে সামে বোরো ফসল উৎপাদনেও বাধাগ্রস্ত হবে।

তিনি বলেন, সরকার একদিকে বলল এক ইঞ্চি কৃষি জমি যেন পতিত না থাকে আবার একদিকে কৃষিপণ্য উৎপাদনের উপকরণের দাম বাড়িয়ে দিলাম তাহলে নীতিটা তো ভিন্ন ধরনের হয়ে গেল। কৃষি অর্থনীতিবিদ বলেন, আমরা এখন আমরা চালের জন্য তো আমদানি নির্ভর হয়ে গেছি।

গত আউশ উৎপাদন খারাপ হয়েছে, আমনটাও ভালো দেখা যাচ্ছে না। এতে করে আমদানির জন্য সরকার ১০ লাখ টন চালের কথা বলেছিল এটি ১৫ লাখ টন হতে পারে। বর্তমানের অবস্থা কথা বিবেচনা করে তিনি বলেন, এই আমদানি হয়তো ২০-২৫ লাখ টন বেড়ে যেতে পারে।

তিনি বলেন, কিছু অর্থ সাশ্রয়ের জন্য সারের দাম বাড়িয়ে আমরা আমদানিকেই উৎসাহিত করছি এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদনটাকেই নিরুৎসাহিত করছি।

সরকারের নীতিমালাকে রিভাইস করার পরামর্শ দিয়ে এ কৃষি অর্থনীতিবিদ বলেন, এখন তো আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম কমছে। ইতোমধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ দাম কমে গেছে এবং ভবিষ্যতে এ দাম আরো কমবে কিছু দিন পর হয়তো ব্যালেন্স হয়ে যাবে। কিন্তু অপেক্ষা না করে তড়িঘড়ি করে দাম বাড়ানোটা ঠিক হয়নি, একটু অপেক্ষা করা যেত। আমাদের অভ্যন্তরীণ সারের উৎপাদন এক সময় ৮০ শতাংশ ছিল এখন তা কমতে কমতে ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে। সম্প্রতি গ্যাসের অভাবে সারকারখানা বন্ধ করে দেয়া হলো। এখানে গ্যাসের জোগান দিয়ে চালু রাখা দরকার ছিল।

এতে করে আমরা আমদানিনির্ভরতার দিকে বেশি চলে যাচ্ছি। একদিকে আমাদের চালের আমদানিনির্ভরতা বাড়ছে অন্য দিকে সারের আমদানিনির্ভরতা বাড়ছে। কৃষকবান্ধবের চেয়ে তো আমরা ক্রমেই ব্যবসাবান্ধব হয়ে যাচ্ছি।’

তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘এ সরকারের কৃষকবান্ধব নীতি গ্রহণ করা উচিত।’  

এদিকে সরকারি উদ্যোগে কৃষকদের ইউরিয়া সারের ব্যবহার কমানোর জন্য সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা না করে যৌক্তিক সার ব্যবহারের জন্য দাম বাড়ানো কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত নয় বলে জানিয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোট।

তারা বলছে, এমনিতেই সব কৃষি উপকরণের দাম বাড়ার কারণে কৃষি ফসলের উৎপাদন খরচ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। প্রতি মৌসুমে কৃষকরা ধানের ন্যায্যমূল্য পায় না বলে রাস্তায় ধান ফেলে বিক্ষোভ করতে করছে। কৃষিঋণ শোধ করতে পারে না বলে কৃষকরা আত্মহত্যা করছে। ফলে সারের দাম বাড়ানোয় কৃষিপণ্যে এর প্রভাব পড়বে। অবিলম্বে সারের বর্ধিত মূল্য প্রত্যাহারের জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোট।

এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘ইউরিয়া সারের দাম কেজিতে ছয় টাকা বৃদ্ধির ফলে উৎপাদনে প্রভাব পড়বে না। একই সাথে, আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম কমলে দেশেও সারের দাম কমানো হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

মন্ত্রী বলেন, সরকার ইউরিয়া সারের সুষম ব্যবহারের উপর গুরুত্বারোপ করে আসছে। কৃষকদের মধ্যে ইউরিয়া সার বেশি ব্যবহার করার প্রবণতা রয়েছে। ডিএপি সারে ১৮ শতাংশ নাইট্রোজেন বা ইউরিয়া সারের উপাদান রয়েছে। সে জন্য ডিএপির ব্যবহার বাড়িয়ে ইউরিয়া সারের অপ্রয়োজনীয় ও মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার কমিয়ে আনার জন্য সরকার ডিএপি সারের মূল্য প্রতি কেজি ৯০ টাকা থেকে কমিয়ে প্রথমে ২৫ টাকা (২০০৯ সালে), এবং পরে ২০১৯ সালে ২৫ টাকা থেকে কমিয়ে ১৬ টাকা করে কৃষকদের দিয়ে যাচ্ছে। এ উদ্যোগের ফলে বিগত কয়েক বছরে ডিএপি সারের ব্যবহার দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

অন্যদিকে, ডিএপির ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে ভেবেছিলাম ইউরিয়া সারের ব্যবহার কমবে, কিন্তু কমেনি। দাম বৃদ্ধির ফলে ইউরিয়ার ব্যবহার কমবে বলে আশা প্রকাশ করেন মন্ত্রী।

প্রসঙ্গত, এই সার দিয়েই শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক বিপর্যয় শুরু হয়েছিল। সারের দাম বাড়ায় তারা রাসায়নিক সার থেকে সরে গিয়ে জৈব সারের ব্যবহার বাড়িয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে জৈবসারে ফিরে যাওয়ায় তাদের উৎপাদনে ধস নামে। এই ধসের সাথে পর্যটনের ধস যোগ হওয়ার পর দ্বীপ দেশটিতে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়।

বৈশ্বিক বাজারে দাম বাড়ার কারণে সরকারকে আরও বেশি পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হবে। সার বাবদ ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারের ভর্তুকি ছিল সাত হাজার ৭১৭ কোটি টাকা। সদ্য বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে লেগেছে ২৮ হাজার কোটি টাকা।