সরকারের নানামুখী পদক্ষেপে ডলার বাজারে কিছুটা স্বস্তির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ডলারের ঝাঁঝালো তেজ কিছুটা কমে নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। গত সপ্তাহে কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজারে ডলার ১২০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল।
চলতি সপ্তাহের বুধ ও বৃহস্পতিবার সেটি নেমে এসেছে ১১০ থেকে ১১১ টাকায়। অর্থাৎ এক সপ্তাহের ব্যবধানে খোলাবাজারে ডলারের দাম কমেছে ১০ টাকা। ডলার বাজারের চাপ কমাতে সরকার রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি ও আমদানিতে চাপ কমানোর দিকে নজর দেয়।
এর অংশ হিসেবে সমপ্রতি বিদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে নানা শর্ত দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে কমছে আমদানির পরিমাণ। অন্য দিকে, প্রবাসী আয় রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়ায় বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে। ফলে হুহু করে বাড়তে থাকা মার্কিন ডলার এখন উল্টো পথে হাঁটছে। কমছে ডলারের দাম, বিপরীতে বাড়ছে টাকার মান।
তবে এখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ১৫ টাকা বেশি দাম খোলাবাজারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বর্তমানে ডলার বিক্রি করছে ৯৫ টাকা দরে। বাজার ঘুরে দেখা যায় কয়েকদিন আগেও ডলারের যে ঝাঁঝালো ভাব ছিল তা এখন কিছুটা কমেছে। মতিঝিলের খুচরা ডলার বিক্রেতা মো. মিসু জানান, এখন বাজারে ভাটা যাচ্ছে। দাম কমতির দিকে আছে।
গত বুধবার যে রেটে বিক্রি করেছি আজও একই রেটে বিক্রি হচ্ছে। আজ যারা বিক্রি করবে তাদের ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা রেট দিচ্ছি। আর যারা কিনবে তাদের কাছ থেকে ১১০ টাকা নিচ্ছি। দেশে ডলারের সংকট কাটাতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। আমদানিতে দেয়া হয়েছে নানা শর্ত। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে দেয়া হয়েছে নীতিগত ছাড়।
এছাড়া ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে বৈঠক করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ডলার কারসাজির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ধরতে চালাচ্ছে অভিযান। অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। অন্য দিকে, বাজারে আরও স্থিতিশীলতা আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বুধবার মানি এক্সচেঞ্জগুলোর সাথেও বৈঠক করেছে।
ওই বৈঠকে প্রতি ডলারে সর্বোচ্চ দেড় টাকা মুনাফার সীমা ঠিক করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর আগে গত রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকের সংগঠন-বাফেদা বৈঠক করে। সেখানে বলা হয়, ব্যাংকগুলো ডলার কেনা-বেচায় কত টাকা মুনাফা করবে তা তারা নিজেরাই ঠিক করবে। তবে বেচাকেনার মধ্যে পার্থক্য যেন এক টাকার বেশি না হয়।
বাজারে অভিযানও অব্যাহত রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অভিযানে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ইতোমধ্যে পাঁচটি মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে, শোকজ করা হয়েছে ৪২টিকে। এ ছাড়া ছয়টি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে অপসারণ করার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যাংকগুলো হলো— বেসরকারি খাতের ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, সি?টি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক ও সাউথ-ইস্ট ব্যাংক এবং বিদেশি খা?তের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও অনিয়ম অব্যাহত রাখায় ছয়টি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে শোকজ করা হয়েছে।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যেসব ব্যাংকের এমডিদের চিঠি দেয়া হয়েছে এগুলো হলো— ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ-বাংলা, প্রাইম ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, সাউথ-ইস্ট ব্যাংক ও বিদেশি খাতের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক রয়েছে। কোনো কোনো ব্যাংক ডলার বিক্রি করে ৭৭০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা করছে।
এমন তালিকায় ১২ ব্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে— ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, সাউথ-ইস্ট ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, ইসলামী ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংক। পর্যায়ক্রমে এসব ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এসব পদক্ষেপের কারণে ডলারের দাম কিছুটা কমতে শুরু করেছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখোপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘মানি এক্সচেঞ্জগুলোকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর গড় রেট থেকে এক টাকা বেশি দামে ডলার ক্রয় করে সর্বোচ্চ দেড় টাকা মুনাফা করতে বলা হয়েছে।
এর আগে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সর্বোচ্চ মুনাফার সীমা এক টাকা বেঁধে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নিয়ম না মানলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ তিনি বলেন, ডলারের সংকট কাটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তার ইতিবাচক ফল পাওয়া যাচ্ছে।
আশা করছি শিগগিরই বাজার স্থিতিশীল হয়ে যাবে।’ মানি চেঞ্জারস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মো. হেলাল সিকদার বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে বৈঠক করেছি। তারা মুনাফার হার সর্বোচ্চ দেড় টাকা পর্যন্ত অনুমতি দিয়েছে।’ এছাড়া ডলারের বাজার পরিস্থিতি নিয়ে নানা পরামর্শ দিয়েছে বলে তিনি জানান।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, চলতি আগস্ট মাসের প্রথম ১৬ দিনে ১১৭ কো?টি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে বাংলাদেশে। দেশীয় মুদ্রায় (প্র?তি ডলার ৯৫ টাকা ধ?রে) এর পরিমাণ ১১ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। এর সাথে কমেছে আমদানি এলসি খোলার হারও।
আমদানির লাগাম টানতে যেসব শর্ত দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, তার সুফল আসতে শুরু করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট মাসের ১১ দিনে দেশে মোট ১৬১ কোটি ডলার সমপরিমাণ মূল্যের আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে। যা জুলাই মাসের ওই ১১ দিনের তুলনায় ৯৪ কোটি ডলার বা ৩৬ শতাংশ কম। তখন আমদানি হয়েছিল ২৫৫ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, জুলাই মাসে দেশে মোট ৫৫৫ কোটি ডলার মূল্যের পণ্যের আমদানি ঋণপত্র খোলা হয়েছে, যা জুন মাসের তুলনায় ৩০ দশমিক ২০ শতাংশ কম। জুন মাসে আমদানি ঋণপত্র খোলা হয়েছিল ৭৯৬ কোটি ডলারের। তবে জুন মাসে অবশ্য মে মাসের তুলনায় আমদানি ঋণপত্র ৭ শতাংশ বেশি খোলা হয়েছিল। মে মাসে ঋণপত্র খোলা হয় ৭৪৪ কোটি ডলারের।