‘বিএনপির তরীতে পা রেখেই জামায়াতের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে হবে। অন্যথায় জামায়াতের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে মৃত্যুছাপ পড়বে। হয়তো সাময়িক ভোটের রাজনীতিতে কয়েক নেতার ভাগ্য খুলবে কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি জামায়াত ভোটের রাজনীতি থেকে পিছিয়ে যাবে’ এমন মন্তব্য দলটির বয়োজ্যেষ্ঠ কর্মপরিষদের এক সদস্যের।
সমপ্রতি জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান দলের রুকন সমাবেশে বিএনপি জোট ছাড়ার ইঙ্গিত দেন। দেন ভোটের মাঠের আভাস। সিক্রেট সমাবেশের একটি ভিডিও ভাইরাল হলে জামায়াতের শীর্ষ দুই নেতা আমার সংবাদকে জানান, জামায়াত জোট ছাড়ার কোনো ঘোষণা দেয়নি, ২০ দলের গঠনমূলক সমালোচনা করেছে মাত্র।
এ নিয়ে বিএনপিতেও সন্তোষ-অসন্তোষ চলছে। সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদার অনুসারী যারা রয়েছেন তারা বলেছেন— জামায়াত কোনোভাবেই জোট ছাড়তে পারে না। জোট রেখেই সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন করা উচিত।
[225298]
অন্যদিকে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অনুসারীরা বলছেন— জামায়াত অনলাইনে যে বক্তব্য দিয়েছে তাতে স্পষ্ট, দলটি আর বিএনপি জোটে নেই। তারা থাকতে চাইলেও আমাদের জোটে আর রাখা হবে না।
জোট নিয়ে জামায়াতের এমন বিস্ফোরক মন্তব্যে দলটির নীতিনির্ধারণী কয়েকজন নেতার সাথে কথা বলে জানা যায়, আগামী দ্বাদশ নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করছে দলটি। ইতোমধ্যে প্রায় শতাধিক আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।
১৪০-১৭০টি আসনে আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী দেবে দলটি। তবে বিএনপির বুদ্ধিজীবী ও দলের একাংশ মনে করছে— জামায়াত বের হয়ে গেলে বিএনপি কলঙ্কমুক্ত হবে।
কয়েকটি বিশেষ দেশের কাছে জামায়াতের কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। জামায়াতের কারণে সব সময় ভোটের আসনে সমস্যা তৈরি হয়। এখন জামায়াত যে লোভে বিএনপি ছাড়ার ইঙ্গিত দিয়েছে তা সফল হবে না।
বিএনপি যদি মজবুত অবস্থানে থাকতে পারে, ভোটের মাঠ শক্তভাবে ধরে রাখতে পারে তাহলে জামায়াতের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হবে না। জামায়াত হয়তো মনে করতে পারে, বিএনপি যদি আগামী নির্বাচনে না যায় তাহলে তারা ওই আসনগুলো দখল করতে পারবে। জামায়াত ভোটের যে হিসাব কষেছে তা বাস্তবায়ন হবে না। জামায়াত লাভে লোভের যে হিসাব কষেছে তা বাস্তবায়ন হবে না।
তবে জামায়াত মনে করছে, আগামী দ্বাদশ নির্বাচনে বিএনপি ভোটের মাঠে তালগোল পাকিয়ে ফেলবে । যেমন একাদশ সংসদ নির্বাচনে ড. কামালকে নিয়ে ঐক্য গঠন করে চলমান সরকারকে কৌশলে বৈধতা দেয়া হয়।
[231471]
এবারও বিএনপি জাতীয় সরকারের ভাষ্য তুলে পুরোনো প্রেসক্রিপশন হাঁটছে। আগেও যেমন বিএনপি ঘোষণা দিয়েছিল খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে নির্বাচনে যাবে না। নির্বাচনে ভরাডুবির মাত্র ছয়টি আসন পাওয়ার পর আবার ঘোষণা দেয়া হয় তাদের কেউ সংসদে যাবে না। কিন্তু বিএনপি কোনো কথাই রাখেনি। আন্দোলনের অংশ হিসেবে সব কিছুই করা হয়। রাজনৈতিক কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি।
তাই জামায়াতে ইসলামী পুরোনো একলা চলো নীতি গ্রহণ করে ভোটের মাঠে নিজস্ব গতিতে অবস্থান তৈরি করছে।
দেশের রাজনীতিতে চোখ রাখা ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সারা দেশে বিএনপির কিছু দুর্গ রয়েছে। এবার দ্বাদশ নির্বাচনে যদি বিএনপি অংশগ্রহণ না করে তাহলে বিএনপির দুর্গগুলো জামায়াতের জন্য বোনাস পয়েন্ট হবে। একইভাবে দেশের ভোটের স্বচ্ছতাও বজায় থাকবে। জামায়াত হতে পারে এরশাদ স্টাইলে ভোটের ঘুঁটি। এ জন্য জামায়াত চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া, যশোর, ঠাকুরগাঁও, পটুয়াখালী, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, চট্টগ্রাম, নীলফামারী, লক্ষ্মীপুর, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জের প্রায় অর্ধশত আসনে চোখ রেখেছে। তারা রাজনীতির কোনো ইস্যুতেই ভোটের মাঠ হাতছাড়া করতে চাচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভোটযুদ্ধে নামার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি আছে দলটির। দেশে সমপ্রতি নানান ইস্যুতে সরকারের ওপর ক্ষিপ্ত দেশের জনগণ। বিএনপি যদি আন্দোলন না করে তাহলে আন্দোলনের মাধ্যমে জামায়াত তাদের ফের শক্তির জানান দেবে। বর্তমানে দলটির গুরুত্বপূর্ণ ভোটের পলিসির নেতারা কারাগারে আটক রয়েছেন। কিন্তু চলমান আমির সম্পূর্ণরূপে রাজনীতিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। যেকোনো উপায়ে ভোটের ফসল ঘরে নিতে চাচ্ছেন। এ জন্য পর্দার আড়ালে সরকারের ঘরেও কৌশলগতভাবে পা পড়েছে। চাওয়া হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর দাঁড়িপাল্লা। তবে অন্য প্রতীকে নির্বাচনের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
সমপ্রতি দলের এক রুকন সমাবেশে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা এতদিন একটা জোটের সাথে ছিলাম। ছিলাম বলে আপনারা হয়তো ভাবছেন কিছু হয়ে গেছে নাকি? আমি বলি— হয়ে গেছে। ২০০৬ সাল পর্যন্ত এটি একটি জোট ছিল। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর জোট তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। সেদিন বাংলাদেশ পথ হারিয়েছিল। সেটি আর ফিরে আসেনি। বছরের পর বছর পর এই ধরনের অকার্যকর জোট চলতে পারে না। (বিএনপি) এই জোটকে কার্যকর করার কোনো চিন্তা নেই।
বিষয়টি আমাদের কাছে স্পষ্ট দিবালোকের মতো এবং তারা আমাদের সাথে বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন বাস্তবতা হচ্ছে— নিজস্ব অবস্থান থেকে আল্লাহর ওপর ভর করে পথচলা। তবে হ্যাঁ, জাতীয় স্বার্থে একই দাবিতে যুগপৎ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করব ইনশাআল্লাহ।’ তবে কোনোভাবেই ২০ দলীয় জোট থেকে জামায়াতে ইসলামীর বের হওয়া আপাতত উচিত হবে না। যদি বিএনপি ঘোষণা দিয়ে বের করে দেয় তাহলে ভিন্ন কথা। সেখানে থেকে দেশের মানুষের একটি পজিটিভ দিক থাকতে পারে।
নাম গোপন রেখে দলটির বয়োজ্যেষ্ঠ কর্মপরিষদের এক সদস্যে আমার সংবাদকে বলেন, ‘বিএনপির তরীতে পা রেখেই জামায়াতের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে হবে। অতীতে বিএনপির সমর্থন নিয়েই জামায়াতকে ভাগ্য নির্ধারণ করতে হয়েছে। মন্ত্রী হয়েছে, এমপি হয়েছে। রাজনীতি করতে গেলে ঐক্যবদ্ধতা দরকার আছে। যদি কোনো হিসাবে ভাঙন তৈরি হয় তাহলে কিছু নেতার ভাগ্য খুলতে পারে, তবে ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ে শঙ্কা থেকে যায়।’
[231602]
তিনি এও মনে করেন, দল যে সিদ্ধান্ত নেয় তাতে অবশ্যই কল্যাণ থাকতে পারে। এটুকু দোয়া থাকবে এমনি আমরা আমাদের শীর্ষ নেতাদের হারিয়েছি, গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতাকেই হারিয়েছি। আমাদের এখন সব কিছুতে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। বর্তমান আমির অনেক বেশি রাজনৈতিক বিচক্ষণ। ওনার মাধ্যমে জামায়াতের রাজনীতিতে ভালো কিছু আশা করা যায়।
২০ দলীয় জোট ইস্যুতে আমিরে জামায়াতের বক্তব্য ও আগামী রাজনীতির বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমরা ২০ দলীয় জোট ছাড়িনি। আমাদের দলের পক্ষ থেকে এ জাতীয় কোনো ঘোষণা দেয়া হয়নি। আমরা ২০ দলের সাথে আছি। জামায়াতের আমিরও কোনো জোট ছাড়ার ঘোষণা দেননি। তিনি জোটের গঠনমূলক কথা বলেছেন নিজস্ব ফোরামে। আমাদের ফোরামে এখন পর্যন্ত জোট ছাড়ার কোনো
সিদ্ধান্ত হয়নি।’ নির্বাচন ভাবনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাই। এ জন্য আমাদের আন্দোলন ও ভোটের প্রস্তুতি হিসেবে একটি রাজনৈতিক দল হয়ে যে প্রস্তুতি থাকা দরকার আমরা তা নিচ্ছি।’
দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম আমার সংবাদকে বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী বিএনপি জোটের সাথে আছে, জোট ছাড়েনি। এ জোটে থাকার কারণে দীর্ঘ এক বছর পর্যন্ত কোনো বৈঠক হয়নি। জোটের যে গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিএনপি সেটিকে যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছে না বলেই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির তার মনোভাব প্রকাশ করেছেন।’
[231549]
তিনি বলেন, ‘আমাদের ঘরোয়া একটি বৈঠকে তিনি যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন তাতে স্পষ্ট হয়নি যে, তিনি জামায়াত ছেড়েছেন। কিংবা ওই বক্তব্যে এমন কোনো ঘোষণাও ছিল না। কয়েকটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল জামায়াতে ইসলামীর আমিরের বক্তব্যকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছে বলেও দাবি করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বিএনপি জোট ছাড়েননি। জামায়াতে ইসলামী বিএনপি জোটে ছিল, এখনো আছে— তবে জোটের নিষ্ক্রিয়তার বিষয়ে অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন মাত্র।’
একই বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার আমার সংবাদকে বলেন, ‘জামায়াত ইসলামী জোট ছেড়েছে এমন কোনো সংবাদ আমাদের কাছে নেই। তবে আমার কাছে মনে হয় না জামায়াত-বিএনপি জোট ছেড়ে দেবে। জোট ছাড়া জামায়াতের উচিত হবে না। জোটে থাকলে জামায়াতেরই লাভ। এখন জামায়াত যদি এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাহলে জামায়াতের ভুল সিদ্ধান্ত হবে বলেও আমি মনে করি।’
এদিকে ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন বিএনপির আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। তিনি আমার সংবাদকে বলেন, ‘জামায়াত ভিডিওর মাধ্যমে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি জোট ছেড়েছে। এটি জামায়াতের অস্বীকার করার সুযোগ নেই। আমাদের কাছে সেই ভিডিও এসে পৌঁছেছে। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছেও জামায়াতের আমিরের সেই বক্তব্য আছে। আমরা এখন সেটিকেই আমলে নেবো। জামায়াত জোট নিয়ে যে ঘোষণা দিয়েছে— এখানে আর কোনো কথা থাকতে পারে না।’