চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একাধিক পদক্ষেপ

মো. মাসুম বিল্লাহ প্রকাশিত: আগস্ট ২৯, ২০২২, ০১:৫২ এএম

বর্তমান সরকারের নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ার রূপকল্পের সঙ্গে সমানতালে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে যেকোনো দুর্যোগ-দুর্ঘটনায় প্রথম সাড়াদানকারী সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। অসংখ্য সীমাবদ্ধতা নিয়েও দুর্জয় সাহস আর দৃঢ়প্রত্যয়ে গতি, সেবা ও ত্যাগের মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে ফায়ার সার্ভিসের প্রতিটি কর্মী সর্বদাই মানবসেবায় নিয়োজিত থেকে দেশজুড়ে সুনামের সাথে সেবা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট সব দুর্যোগে ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই দুর্ঘটনাস্থলের উদ্দেশে গমন এবং প্রথম সাড়াদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স যেকোনো বিচারেই প্রশংসাযোগ্য বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। যেকোনো দুর্যোগ-দুর্বিপাকে সেবা ও জনগণের জানমাল হেফাজতে অঙ্গীকারবদ্ধ ফায়ার সার্ভিসের কর্মীবাহিনী অংশ নিচ্ছে জঙ্গিবিরোধী যৌথ অভিযানেও।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বর্তমান সরকারও বাস্তবমুখী বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করায় একদিকে যেমন প্রতিষ্ঠানটির সেবার গুণগত মান উন্নীত হয়েছে, তেমনি সেবামূলক কার্যক্রমও হচ্ছে সম্প্রসারিত। বর্তমান ফায়ার সার্ভিসকে ভবিষ্যতে আরও আধুনিক ও বিশ্বমানের করে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েও সার্বিক কার্যক্রমে এগিয়ে যাচ্ছে সরকার।

এরই মধ্যে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, আবাসিক এলাকায় কেমিক্যালের দোকান কিংবা গোডাউন স্থাপন, অগ্নিনির্বাপণের জন্য শহর এলাকায় পানি উৎসের অভাব, হাইড্রেন্ট সিস্টেম, ইনবিল্ট ফায়ার ফাইটিং ফ্যাসিলিটিজের স্বল্পতা, ট্রাফিক জ্যাম, রাস্তাঘাটের অপ্রতুলতাসহ জনসচেতনতার অভাবজনিত একাধিক চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হচ্ছে ফায়ার সার্ভিসকে।

দুর্যোগে-দুর্বিপাকে সময়মতো সাড়াদান এবং দুর্ঘটনা মোকাবিলা করে উদ্ধার অভিযান পরিচালনাও যে কারণে অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে বলেও জানান সংশ্লিষ্টরা।

ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, অগ্নি দুর্ঘটনাকবলিত ভবনের সামনে এতবেশি ক্যাবল থাকে যে ক্যাবলের কারণে লেদার স্থাপন করাও দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে।

আবার উৎসুক জনতাও গাড়িতে ওঠে বসে কাজের বিঘ্ন ঘটায়। রাজধানীর বনানীর এফআর টাওয়ারে আলোচিত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় উৎসুক জনতার কারণেই ভুল বাটনে চাপ পড়ে একজন ফায়ার ফাইটারও মারা যায়। এমন একাধিক ঘটনায় দেখা গেছে, উৎসুক জনতার কারণে ফায়ার ফাইটারদের অগ্নিদুর্ঘটনা মোকাবিলায় যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে।

তাছাড়া অধিকাংশ ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, পানির সোর্স পাওয়া যায় না। যে ভবনে অগ্নিকাণ্ড ঘটে সে ভবনের পাশের বাসিন্দারাও সহযোগিতা করে না। অথচ হাজার হাজার লোক এসে ভিড় জমিয়ে ফায়ার সার্ভিসের কাজে ক্ষতি করছে। তবে দুর্যোগে কাজ করার আগেই এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ফায়ার সপ্তাহ, মহড়া, নিয়মিত গণসংযোগ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে ফায়ার সার্ভিস।

এরমধ্যে আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস, আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস পালনের পাশাপাশি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় এবং পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠানেও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ফায়ার সার্ভিস।

এদিকে দুর্যোগ মোকাবিলার আগেই এসব চ্যালেঞ্জ প্রতিটি ফায়ার ফাইটারের অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও সেবার প্রবল মানসিকতায় সফলভাবে মোকাবিলা করে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় গত তিন বছরে মিরপুর রূপনগর বস্তি, নারায়ণগঞ্জের বায়তুস সালাত মসজিদ ও হাসেম ফুডস, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প, এমভি অ্যাডভেঞ্চার-৯ অগ্নিদুর্ঘটনাসহ অন্যান্য দুর্ঘটনা সফলতার সাথে মোকাবিলা করে ৭৯ হাজার ৭৬০টি অগ্নিদুর্ঘটনা ও ৩৪ হাজার ৫৮৪টি অন্যান্য দুর্ঘটনা মোকাবিলা করে চার হাজার ৮৯৫ কোটি টাকার সম্পদ রক্ষাসহ ৫২ হাজার ৭২ জনকে জীবিত এবং সাত হাজার ২৬০ জনকে মৃত উদ্ধার করে ফায়ার ফাইটাররা।

এছাড়া ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি সার্ভিস ৯৯৯-এর আওতায় ৮২ হাজার ৬৬৭টি  কল-এ তাৎক্ষণিক সাড়া প্রদানের পাশাপাশি আলোচিত রূপনগর বস্তি, নারাণগঞ্জের বায়তুস সালাত মসজিদ ও হাসেম ফুডস, রোহিঙ্গা ক্যাম্প, এমভি অ্যাডভেঞ্চার-৯ ও সবশেষ সীতাকুণ্ডসহ পুরান ঢাকার মতো বড় বড় অগ্নিদুর্ঘটনাসহ অন্যান্য দুর্ঘটনাও সফলতার সঙ্গে মোকাবিলায় সক্ষমতার জানান দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।

গত তিন বছরে ৭১টি ফায়ার স্টেশন চালুর মাধ্যমে বর্তমানে দেশজুড়ে ৪৮৯টি ফায়ার স্টেশনের মাধ্যমে সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে ফায়ার সার্ভিস। এর মধ্যে নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্সে ৫৭ হাজার রোগীকে পরিবহনের মাধ্যমে সেবা দিয়েছে সংস্থাটি।

জানা গেছে, কর্মীদের মনোবল বৃদ্ধি ও সেবার মান আরও গতিশীল করার লক্ষ্যে একই সময়ে ১৩১ জনকে পদক ও ২৭৬ জনকে বৈদেশিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় করা হয়েছে ১০২.৯২ একর ভূমি অধিগ্রহণ, যেখানে নির্মিত হবে আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফায়ার একাডেমি।

এছাড়া গত তিন বছরে ছয় মাস মেয়াদি বিভিন্ন কোর্সের মাধ্যমে এক হাজার ৬৬০ জন বেসরকারি ব্যক্তিকেও ফায়ার সেফটি বিষয়ক উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যেও পাঁচ হাজার ১৮৪ জন নতুন কমিউনিটি ভলান্টিয়ার ও ২৩০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি ৪৫ হাজার ৯৯৪টি অগ্নিনির্বাপণী মহড়া, ১১ হাজার ৩২৪টি সার্ভে ও পাঁচ লাখ চার হাজার ৪৩৪ জনসাধারণকেও প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে ফায়ার সার্ভিস। অধিদপ্তরের জন্য সংগ্রহ করা হয়েছে ৪৮২ কোটি টাকার আধুনিক সরঞ্জামাদিও।

আধুনিক সরঞ্জাম নিয়েও অগ্নিদুর্ঘটনা মোকাবিলায় ফায়ার ফাইটারদের প্রাণান্তকর চেষ্টার মধ্যেও সবচেয়ে বেশি অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটছে বিচক্ষণতা ও উদাসীনতার কারণে।

গত শনিবার রাজধানীর গুলশান ক্লাবে ইলেকট্রনিকস সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশন অন বাংলাদেশ (ইসাব) ও বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস যৌথভাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইন উদ্দিন।

আগামী ২৪ থেকে ২৬ নভেম্বর তিনদিনব্যাপী বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ‘অষ্টম আন্তর্জাতিক ফায়ার সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি এক্সপো-২০২২’। প্রদর্শনীতে থাকবে অগ্নিনিরাপত্তা সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের পণ্যের সমাহার।

ডিজি মাইন উদ্দিন বলেন, সব ভবনে নিয়ম অনুযায়ী অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকলে এত প্রাণহানি ঘটত না। ভবন এবং স্থাপনার মালিকের উদাসীনতা ও গাফিলতির কারণে দুর্ঘটনার সময় আগুন নিয়ন্ত্রণে জীবন বাজি রাখতে হয় ফায়ার সার্ভিস সদস্যদের। এতে অনেক সদস্য হতাহত হচ্ছেন।

একাধিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই অগ্নিদুর্ঘটনা সফলভাবে মোকাবিলার জন্য একাধিক পদক্ষেপ হাতে নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পসমূহ সম্পন্নকরণ, নতুন কমিউনিটি ভলান্টিয়ার তৈরি ও সতেজকরণ, গ্যাপ এরিয়াতে ফায়ার স্টেশন নির্মাণ, ১০টি বিশেষায়িত অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার ইউনিট স্থাপন, জাইকা ও কইকার সহায়তায় আধুনিক হেডকোয়ার্টার এবং জনগণের দোরগোড়ায় অ্যাম্বুলেন্স সেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে অ্যাম্বুলেন্স সেবা সম্প্রসারণ প্রকল্পও প্রস্তাব করা হয়েছে।

বিভাগীয় সদর দপ্তরসহ ওয়ার্কশপ ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আবাসিক ভবন স্থাপন, স্যাটেলাইট ফায়ার স্টেশন স্থাপনসহ সাংগঠনিক কাঠামো যুগোপযোগীকরণের পদেক্ষপও হাতে নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।