দাবির টাকা পরিশোধে গ্রাহক হয়রানি, গুরুত্বপূর্ণ পদে অযোগ্যদের পদায়ন, আইন লঙ্ঘন করে কার্যক্রম চালানো, সর্বোপরি নিয়ন্ত্রক সংস্থার উদাসীনতায় বিপর্যস্ত বিমা খাত। ফলে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত খাতটি নিয়ে সরকার যতটা যত্নবান, ঠিক ততটাই লাগামছাড়া কোম্পানিগুলো। ফলে স্বাধীনতার পর থেকে বিমা খাত যত বড় হয়েছে, তার থেকেও বেশি জড়িয়েছে অনিয়মের নাগপাশে। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার দিকেই অভিযোগের তীর সংশ্লিষ্টদের।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চতুর্থ প্রজন্মের স্বদেশ লাইফ ইন্স্যুরেন্সে ২০২০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সিইও হিসেবে নিয়োগ পান ইখতিয়ার উদ্দিন শাহীন। যথাযথ শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকলেও ওই বছরের ডিসেম্বরে তার নিয়োগ অনুমোদন করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। একইভাবে গোল্ডেন লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সিইও আমজাদ হোসেন কনক ও হোমল্যান্ড লাইফের সাবেক সিইও আজিজুল ইসলাম তালুকদারের পদও অনুমোদন করা হয়। অথচ উভয়েই সার্টিফিকেট বিক্রির প্রতিষ্ঠান হিসেবে অভিযুক্ত দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপত্র দাখিল করেছেন।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন দুর্বল কাগজপত্রে নিয়োগ অনুমোদন রহস্যজনক। এছাড়া ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্সের মিয়া ফজলে করিম, আলফা ইসলামি লাইফের নূরে আলম সিদ্দিক অভি, প্রটেক্টিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ড. কিশোর বিশ্বাস ও সেনাকল্যাণ ইন্স্যুরেন্সের সিইও ব্রি. জে. শফিক শামীমসহ বিমা খাতের অনেক সিইওরই নেই প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কর্ম অভিজ্ঞতা। অনেকে আবার জালিয়াতির মাধ্যমে কাগজপত্র তৈরি করে তা দাখিল করেছেন নিয়ন্ত্রক সংস্থায়। এসব বিষয়ে জানার পরও নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে ব্যবস্থা না নেয়ায় তারা অনায়াসে অফিস, বিদেশ ট্যুর করে নিয়ম বহির্ভূতভাবে টাকা সরিয়ে নিচ্ছেন প্রতিষ্ঠান থেকে। আবার অনেকেই আছেন যারা খোদ নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন ছাড়াই সিইও হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন।
এদিকে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের ক্ষেত্রে আইডিআরএ’র কড়াকড়ির পরও পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি। সর্বশেষ ২০২১ সালেও ১৫টি লাইফ ও ২১টি নন-লাইফ বিমা কোম্পানি অতিরিক্ত ব্যয় করেছে। এর মধ্যে জীবন বিমা প্রতিষ্ঠান বায়রা লাইফ, বেস্ট লাইফ, চার্টার্ড লাইফ, ডায়মন্ড লাইফ, গোল্ডেন লাইফ, যমুনা লাইফ, জীবন বিমা কর্পোরেশন, এলআইসি বিডি, মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ, পদ্মা ইসলামী লাইফ, প্রোটেক্টিভ ইসলামী লাইফ, সানফ্লাওয়ার লাইফ, স্বদেশ লাইফ, ট্রাস্ট লাইফ, জেনিথ ইসলামী লাইফ রয়েছে। আবার সাধারণ বিমা কোম্পানির মধ্যে রয়েছে অগ্রণী ইন্স্যুরেন্স, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ, বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি (বিজিআইসি), সিটি জেনারেল, ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স, এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স, গ্লোবাল ইন্স্যুরেন্স, গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স, ইসলামি কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স, ইসলামী ইন্স্যুরেন্স বাংলাদেশ, কর্ণফুলী ইন্স্যুরেন্স, মেঘনা ইন্স্যুরেন্স, পিপলস, ফিনিক্স, প্রাইম ইন্স্যুরেন্স, রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্স, রূপালী ইন্স্যুরেন্স, সাউথ এশিয়া, স্ট্যান্ডার্ড, তাকাফুল ইসলামী এবং ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্স।
মূলত কমিশন বাবদ অতিরিক্ত ব্যয় এবং কোম্পানির পরিচালকদের স্বার্থে এমন অস্বাভাবিক খরচ দেখানো হয় বলে জানান খাত বিশেষজ্ঞরা।আবার নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর আইন পরিপালনেও অধিকাংশ কোম্পানির মধ্যে অনীহা দেখা গেছে। এরপরও এ নিয়ে তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি সংস্থাগুলোকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিমা ও বিএসইসির আইন ভাঙতে দেখা যায়। এর মধ্যে রয়েছে- এক পরিবার থেকে দুজনের অধিক পরিচালনা পর্ষদের সদস্য, একই পরিবারের হাতে ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার ধারণ, বিএসইসির নির্দেশনানুযায়ী এক পঞ্চমাংশ হিসেবে স্বতন্ত্র পরিচালক না থাকা, স্বতন্ত্র পরিচালকের যোগ্যতার শর্ত না মানা ইত্যাদি।
তবে বিমা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে গ্রাহকদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ— সময়মতো দাবি নিষ্পত্তির পরিবর্তে বছরের পর বছর ঘুরানো হয়। পপুলার লাইফের নেত্রকোনা জেলার গ্রাহক হায়দার আলী প্রায় ১৫ বছর আগে ১০ বছর মেয়াদি একটি বিমা করেন। তিন বছর চালানোর পর আর্থিক সমস্যার কারণে আর কিস্তি চালাতে পারেননি। পরে পলিসির মেয়াদ শেষে টাকার জন্য সংশ্লিষ্ট শাখায় যোগাযোগ করলে তারা জানান তিনি বিমা টাকা পাবেন না।
এদিকে চাঁদপুরের মতলব থানাধীন পাঁচআনী গ্রামের বিপ্লব সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সে ২০০৮ সালে ১০ বছর মেয়াদি একটি বিমা করেন। সময়মতো বিমার সব প্রিমিয়াম জমা দিয়েছেন। ২০১৮ সালে তার পলিসির মেয়াদ শেষ হলেও টাকা পেতে চাঁদপুরের সংশ্লিষ্ট শাখায় ধরনা দেন, কিন্তু আজ-কাল বলে দীর্ঘ দুই বছর তাকে ঘুরাতে থাকে সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা। শুধু যে দেশীয় কোম্পানিগুলোই গ্রাহক হয়রানি করছে তা নয়, জীবন বিমায় শীর্ষে অবস্থান করা মেটলাইফও গ্রাহক হয়রানির ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই।
ঢাকার মিটফোর্ডের ওষুধ ব্যবসায়ী ফরিদ আহমেদ ২০১৫ সালে মেটলাইফ ইন্স্যুরেন্সে একটি পলিসি করেন। দুই বছরে প্রিমিয়াম বাবদ ৬০ হাজার টাকা জমা দেয়ার পরে আর্থিক সমস্যার কারণে আর জমা দিতে পারেননি। এখন জমানো টাকা উত্তোলন করতে গেলে বলা হয়, এক লাখ ২৫ হাজার টাকা জমা দিতে হবে। এছাড়া টাকা পাবেন না, এটাই কোম্পানির নিয়ম। এখন তিনি না পারছেন ওই টাকা জমা দিতে, আর না পারছেন নিজের জমানো টাকা উত্তোলন করতে। এসব ক্ষেত্রেও নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতিই অভিযোগের তীর সচেতন মহলের। তারা বলছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা সব জেনেও এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না।
নাম গোপন রাখার অনুরোধ জানিয়ে আইডিআরএর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, যেখানে নিবন্ধন সনদই দেয়া হয় রাজনৈতিক বিবেচনায় অনিয়মের মাধ্যমে, সেখানে নিয়ম শৃঙ্খলা কতটুকু প্রতিষ্ঠা পাবে তা অনুমেয়। আইন-কানুন ও নীতি-নৈতিকতা যারা সংসদে বসে তৈরি করেন তারাই কোম্পানি পরিচালনা করতে গিয়ে আইন লঙ্ঘন করছেন। এক্ষেত্রে বিমা কোম্পানির সিইওদের প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করার ওপর জোর দেন ওই কর্মকর্তা।
বিমা খাতের অনিয়মের বিষয়ে বিশিষ্ট বিমাবিদ দাস দেব প্রসাদ বলেন, ‘বিমা খাতে সিইও নিয়োগের ক্ষেত্রে কঠোর হতে হবে। তাছাড়া যারা বর্তমানে সিইও হচ্ছেন তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ নেই। এ কারণে যারা পরবর্তীতে সিইও হবেন এমন লোকদের নিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।’
নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন অনিয়ম দূর করতে পারছে না— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক বিবেচনায় বিমা কোম্পানির নিবন্ধন সনদ দেয়া হচ্ছে, একথা সত্য। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থা যদি সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করে তবে অনিয়ম হওয়ার সুযোগ নেই।’
এসব বিষয়ে আইডিআরএ’র মুখপাত্র এস এম শাকিল আখতারের কাছে জানতে চাওয়া হয়। তিনি দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, ‘যেসব সিইও আইডিআরএর আইন লঙ্ঘন করছে তাদের আমরা শাস্তি ও জরিমানা করছি।’
এরপরও তারা আইন লঙ্ঘন করে কিভাবে, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এটা সত্য যে যারা বিমা কোম্পানির মালিক তারা অত্যন্ত প্রভাবশালী। ফলে তাদের বিরুদ্ধে সবসময় পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয় না।’