দেশের মেধা বরাবরই বিদেশে গিয়ে হারিয়ে যায়। এর সংখ্যাটা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষকরা সাধারণত উচ্চতর ডিগ্রি নিতে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোতে বেশি গমন করে থাকেন। এসব শিক্ষক ছুটিকালীন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেতন-ভাতা সব কিছু পেয়ে থাকেন।
নীতিমালায় বলা আছে, শিক্ষাছুটি শেষে দেশে এসে স্বপদে বহাল হবেন। তবে বেশিরভাগই দেশের মেধা বিদেশে গিয়ে উধাও হয়ে যায়। তারা দূরপরবাসেই থেকে যায় পরিবার নিয়ে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বর্তমানে দেশের ৩৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হাজার ৬৮০ জন শিক্ষক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। এর মধ্যে ছুটি শেষ হলেও দেশে এখনও ফেরেননি ২৭১ জন। এছাড়াও দীর্ঘদিন দেশে না ফেরায় ১২০ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা এক ধরনের প্রতারণা। যারা বিদেশে লেখাপড়া করতে গিয়ে আর ফিরছেন না তারা দেশের জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলেন। এরফলে রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুরু হয়েছে শিক্ষক সংকট। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তাদের বেতন-ভাতা দেয়া হয়, এমনকি তাদের স্টুডেন্ট লেভেলটাও তো ট্যাক্সের টাকা খরচ হয়েছে। তবে দেশের জন্য তাদের কি কিছুই করার নেই।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, স্কলারশিপ, পিএইচডি বা প্রেষণ, অবকাশ যাপন, চিকিৎসা ও অন্যান্য কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৫৬ জন শিক্ষক বিদেশে অবস্থান করছেন। এর মধ্যে ২৯ জন শিক্ষক নির্ধারিত সময় পার হলেও আর কর্মস্থলে ফেরেননি।
এরফলে নিয়ম অনুযায়ী তাদের কাছে পাওনা টাকা আদায় শুরু হয়েছে। চাকরিচ্যুত করা হয়েছে ৩৭ জনকে। তাদের কাছ থেকেও পাওনা টাকা আদায়ের প্রক্রিয়া চলছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) উচ্চশিক্ষা নিতে বিদেশ গেছেন ১৭১ জন শিক্ষক। তাদের মধ্যে ৪১ জনের ছুটি শেষ হলেও ফিরছেন না দেশে। ফলে এ পর্যন্ত ২১ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। বাকিদের বিষয়ে নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের কাজ শুরু করেছে বুয়েট কর্তৃপক্ষ।
এছাড়া উচ্চশিক্ষা নিতে বিদেশ গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেননি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) ছয়জন শিক্ষক। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৭ জন, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৪ জন, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) ৭৪ জন, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৩ জন, বাংলাদেশ টেক্সটাইলের ২৫ জন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৯ জন, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ জন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪১ জন, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯ জন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৪ জন, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩১ জন, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭ জন, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) ৭৩ জন, চট্টগ্রাম প্রকৌশলী ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ জন, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮ জন, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিম্যাল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৩ জন, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১ জন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩ জন, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ৩৫ জন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ৫৪ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির আটজনসহ মোট এক হাজার ৬৮২ জন শিক্ষক বিদেশে অবস্থান করছেন।
এ বিষয়ে ইউজিসির চেয়ারম্যান (চলতি দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগম আমার সংবাদকে বলেন, কোনো শিক্ষক বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে গিয়ে সেখানে ভালো চাকরি পেয়ে যায় আর যদি দেশে না আসে সেটা কি বন্ধ করা সম্ভব। এটাতো খুবই কঠিন কাজ।
তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সময় ফিক্সড করে পাঠাই, তারা না আসলে রিজাইন দেয়। টাকা ফেরত দেয়, এটা দীর্ঘমেয়াদি হয়ে যায়। ফলে দেখা যায় এতে সরকার লাভবান হয় না।
বিদেশে থেকে না আসায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দিন দিন শিক্ষক সংকট বেড়ে যাচ্ছে এমন প্রশ্নের উত্তরে ইউজিসির চেয়ারম্যান বলেন, এটা তো অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা তো উচ্চশিক্ষাটাকে বাধা দিতে পারি না।
একজন সহকারী শিক্ষক কষ্ট করে স্কলারশিপ নেই তাকে তো আমরা বাধা দিতে পারি না। অনেককে তো অব্যাহতিপত্র নিয়ে বিদেশে পাঠানো হয়। যেসব শিক্ষক ফিরে আসতে অনীহা প্রকাশ করবেন, তাদের বিরুদ্ধে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়। তাকে টাকা ফেরত দিতে হবে।
এদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য রাজস্ব খাতে বৃত্তি কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে ইউজিসি। সেখান থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে তিন বছরের ব্যয় বহন করা হবে। বিশ্বের র্যাকিংয়ে ৩০০তম অবস্থানে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আবেদন করা যাবে।
এর শর্ত হিসেবে শিক্ষককে দিয়ে যেতে হবে চাকরির অব্যাহতিপত্র। চার বছরের মধ্যে তিনি ফিরে না এলে এটি কার্যকর করতে পারবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ বাবদ যত অর্থ ব্যয় হবে তা ফেরত দিতে হবে শিক্ষককে। তা না হলে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া যাবে।
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. ইকরামুল কবির আমার সংবাদকে বলেন, বিদেশে গিয়ে থেকে যাওয়াটা অনুচিত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমন একটা আইন করছে— ৫০ শতাংশ শিক্ষক বাইরে স্কলারশিপ নিয়ে যেতে পারবে। এর ফলে দেখা যাচ্ছে অধিকাংশ শিক্ষক এই সুযোগ গ্রহণ করে বিনা বেতন আবার কেউ কেউ বেতনসহ গেলেও যে সময়ের মধ্যে আসার কথা সে সময়ের মধ্যে আসে না। এরা বিদেশে গিয়ে কিভাবে থাকা যায় সেই চেষ্টা করে।
এ শিক্ষাবিদ বলেন, যারা যায় তাদের নির্দিষ্ট সময় পার হলে তার বাড়তি সময়ের জন্য বৈধ একটা নিয়ম থাকা উচিত। অনেকের হয়তো ডক্টরেট ডিগ্রিটা এক বছরে সম্পূর্ণ হয়নি, তার যদি বাড়তি একবছর সময় দেয়া হয়।
এরপরও যদি না আসে তাহলে পরবর্তী ছয় মাসের নোটিসে চাকরিচ্যুত করা উচিত বলে মনে করেন অধ্যাপক ড. ইকরামুল। এতে করে বিশ্ববিদ্যায়গুলোর টাকাটাও কিছু বাঁচবে এবং এখানে নতুন রিক্রুটমেন্টের সুযোগ থাকে।