সক্রিয় কারসাজিচক্রের অদৃশ্য হাত

জাহিদুল ইসলাম প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৭, ২০২২, ০১:১৭ এএম

বছরের পর বছর ধরে বিনিয়োগকারীদের জন্য ভালো কোনো খবর দিতে পারেনি। এমনকি লভ্যাংশ না দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। আবার পরিসংখ্যান ও বিশ্লেষণ চিত্রেও রয়েছে বাজে অবস্থায়। অথচ ক্রমাগত বাড়ছে শেয়ারের দর। পুঁজিবাজারে ওষুধ ও রসায়নের খাতের ওরিয়ন ইনফিউশন নিয়ে এমন ঘটনা ঘটনায় কারসাজি চক্রের অদৃশ্য হাত দেখছেন বিশ্লেষকরা। বিষয়টি নিয়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণও করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন। ফলে এই কোম্পানির শেয়ার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, বছর শুরুর দিকে শেয়ারের দাম ছিল ৮৯ টাকা। এরপর নানা উত্থান-পতনে গত ২৫ মে প্রতিটি শেয়ারের দাম দাঁড়ায় ৭৬.৫০ টাকায়। তখন থেকেই ঘুরতে থাকে এই কোম্পানির শেয়ারের ভাগ্য। উলম্বভাবে (সোজা উপরের দিকে) কোম্পানির শেয়ারদর ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে গত ১৪ আগস্ট থেকে। ওই দিন ক্লোজিং প্রাইস দাঁড়ায় ১২৯.১০ টাকায়। কিন্তু ওই দিন থেকে সর্বশেষ গত মঙ্গলবার পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার দর ৩৫৪.৪০ টাকায় দাঁড়ায়। মাত্র ১৫ দিনে শেয়ার দর ২২৫.৩০ টাকা এবং ১৭৪.৫১ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। আর গত ২৫ মে থেকে এই শেয়ার দর বাড়ে ২৭৭.৯০ টাকা। যার প্রবৃদ্ধির হার ৩৬৩.২৬ শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় পাঁচগুণ দর বৃদ্ধি পায়।

২০২১-২২ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিক শেষে (জুলাই ২১-মার্চ ২২) প্রতিষ্ঠানটির বিক্রি মূল্য থেকে পরিচালন ব্যয়, সুদজনিত ব্যয় ও কর সঞ্চিতি বিয়োগ এবং অন্যান্য আয় যোগ শেষে নিট মুনাফা দাঁড়িয়েছে দুই কোটি ৯১ লাখ টাকা বা শেয়ারপ্রতি ১.৪৩ টাকা। নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে প্রাইস আর্নিং (পিই) রেশিও ২৩৮.২৫। এ ক্ষেত্রে বোঝা যায়, প্রতিষ্ঠানটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।

এরপরও এমন অস্বাভাবিক শেয়ার দর বৃদ্ধিকে কারসাজি বলছেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা। মুনাফায় দুর্বল কোম্পানির কাতারে থাকা ওরিয়ন ইনফিউশনের শেয়ার দর অস্বাভাবিক উত্থানে মৌলভিত্তির অনেক কোম্পানিকে ছাড়িয়ে গেছে। অথচ সেসব কোম্পানি মুনাফার দিক থেকে রয়েছে বহুগুণ এগিয়ে।

বাজার বিশ্লেষকদের মতে, স্বল্প মূলধনী কোম্পানি হলে কারসাজির মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেয়া সহজ হয় বাজার জুয়াড়িদের জন্য। ওরিয়ন ইনফিউশনের পরিশোধিত মূলধন ২০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা এবং শেয়ার সংখ্যা দুই কোটি তিন লাখ ৬০ হাজার প্রায়। এরমধ্যে আবার উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের ৪০.৬১ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক ১৯.২৮ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারী রয়েছে ৩৯.৮২ শতাংশ। অর্থাৎ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৮১ লাখ সাত হাজার ২৫৬টি শেয়ার আছে। ফলে স্বল্প সংখ্যক শেয়ারের কারণে খুব সহজেই এসব কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি করতে পারে অসাধু চক্র। ক্রমাগত কিনতে থাকে শেয়ার।

এতে একদিকে যেমন শেয়ারের দাম বাড়ে, অপরদিকে তৈরি হয় শেয়ার সংকট। এরই মাঝে চক্রটির কিছু সদস্য গুজব ছড়াতে থাকে দর আরো বৃদ্ধি পাওয়ার। এসব গুজবে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা যখন শেয়ার কিনতে শুরু করে সে সময় বিক্রি করতে থাকে চক্রটি। অবশ্য সংশ্লিষ্ট কোম্পানির কেউ জড়িত না থাকলে শেয়ার নিয়ে কারসাজি সম্ভব নয় বলেও জানান বাজার বিশ্লেষকরা।

তারা বলছেন, কোন ব্রোকারেজ হাউজ এবং কোন বিও আইডি থেকে কোম্পানির শেয়ার কেনা হয় তার তথ্য থাকে কোম্পানিগুলোর কাছে। ফলে কোম্পানির কর্মকর্তাদের হাতে রাখতে কারসাজি চক্র তাদের জন্যও রাখে লোভনীয় অফার।

তারা বলেন, ওরিয়ন ইনফিউশনের দর অস্বাভাবিক বাড়িয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে উচ্চদরে শেয়ারটি ধরিয়ে দিতে চাইছে একটি চক্র। এর মাধ্যমে তারা মুনাফা নিয়ে কেটে পড়লেও ঝুঁকির মুখে পড়বে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ। একই ঘটনা ঘটছে পুঁজিবাজারের আরেক দুর্বল কোম্পানি সোনারগাঁও টেক্সটাইলকে ঘিরে। গত আগস্ট মাসেও যখন শেয়ার বাজার টানা পতনের দিকে যাচ্ছিল সে সময় যেন পাগলা ষাঁড়ের মতো ঊর্ধ্বমুখী ছুটছিল এই কোম্পানির শেয়ার।

অথচ বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিতে না পারায় বি ক্যাটাগরিতে অবনমন হয় এই কোম্পানির। করোনাকালে দীর্ঘ দুই বছর কোম্পানিটির উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এতে মুনাফা ও আয় কমে যায় উল্লেখযোগ্যভাবে। ফলে ২০২১ সালের শেষদিকে শেয়ার দর ১৫-১৬ টাকায় নেমে আসে।

কিন্তু হঠাৎ করেই চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ক্রমাগত শেয়ার দাম বাড়তে থাকে। ১৭.৭০ টাকা দরের শেয়ার গত ১৬ আগস্ট সর্বোচ্চ ৭৮.১০ টাকায় উঠে আসে। অস্বাভাবিক এই মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে কোম্পানির কাছে জানতে চাওয়া হয় ডিএসইর পক্ষ থেকে।

এর জবাবে গত ৫ জুলাই প্রতিষ্ঠানটি জানায়, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে তাদের কোনো অপ্রকাশিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই। এ কারণে বাজার বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এ উত্থানের পেছনে কারসাজিই প্রধান কারণ। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর গত বছরের মাঝামাঝিতে উৎপাদনে ফিরলেও এখনো তা পূর্ণ মাত্রায় শুরু করেনি। তাছাড়া নদীবেষ্টিত বরিশালে অবস্থিত হওয়ায় এর উৎপাদন ব্যয় বেশি।

কেননা, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পর্যায়ে এখন বরিশালে গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়নি। ফলে বিদ্যুতের মাধ্যমে চলে উৎপাদন কার্যক্রম। তা সত্ত্বেও বাজারে এটির দাম বাড়ছে হু হু করে। অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ফলে সর্বশেষ অনিরীক্ষিত আর্থিক হিসাবে কোম্পানিটি পিই রেশিও দাঁড়িয়েছে ২৪৪ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ কেউ এখানে বিনিয়োগ করলে তার বিনিয়োগকৃত অর্থ উঠে আসতে ২০৬ বছর লাগবে, যদি মৌলিক অবস্থা অপরিবর্তীত থাকে।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা বলেন, যে কোম্পানির পিই রেশি যত বেশি, সেই কোম্পানিতে বিনিয়োগ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য তত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তাই এ ধরনের কোম্পানিতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন বিশ্লেষকরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ সালের পর থেকে কোম্পানিটি কোনো লভ্যাংশ দেয়নি। নিয়মানুযায়ী পরপর দুই বছর নগদ লভ্যাংশ না দিলে ইস্যুয়ার কোম্পানি ‘জেড’ শ্রেণিভুক্ত হবে। এ অবস্থায় কোম্পানির ওপর লভ্যাংশ দেয়ার যে চাপ, সেটিকে কাজে লাগিয়ে একটি চক্র লভ্যাংশ দেয়ার গুজব ছড়িয়ে শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি করছে। এদিকে ১৯৯৫ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এ কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন প্রায় সাড়ে ২৬ কোটি টাকা, যা ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের দুই কোটি ৬৪ লাখ শেয়ারে বিভক্ত।

কোম্পানিটির শেয়ারের সাড়ে ৪৪ শতাংশই রয়েছে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে প্রায় ৫৪ শতাংশ। স্বল্প মূলধনী কোম্পানি হওয়ায় কারসাজির মাধ্যমে এর দাম বাড়ানো সহজ বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

প্রতিষ্ঠান দুটির এমন অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধির বিষয়ে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের মুখমাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘শেয়ার বাজারে মূল্য বাড়বে-কমবে এটাই স্বাভাবিক। তবে আমাদের দেখতে হবে মার্কেট স্পেকুলেশন হচ্ছে কি-না। প্রতিষ্ঠানটির দুটির বিষয়ে আমরা অবগত আছি এবং সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হচ্ছে। কোনো সমস্যা পেলে আমরা ব্যবস্থা নেবো।’

শাকিল রিজভী বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনায় স্পেকুলেশন বোঝা যায়। সাধারণত কোম্পানির পরিচালক হতে বা অ্যাকোয়ার করতে বা দাম বাড়িয়ে বিক্রি করতে এ ধরনে ঘটনা ঘটানো হয়। তবে কি উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে সেটা তো যারা এর সাথে জড়িত তারাই ভালো বলতে পারবে।’

অপরদিকে অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, মার্কেট কনস্পাইরেসিজিংয়ের সাথে জড়িতদের যদি আইডেনটিফাই করা হয় তবে, তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে সেটা দেখতে হবে। তাদের শুধু জরিমানা করে ছেড়ে দিলে হবে না। কারাগারে পাঠাতে হবে। এ ক্ষেত্রে আইনের সংস্কার প্রয়োজন হলে তা করতে হবে। আর আমাদের একটি সমস্যা হলো, স্বতন্ত্র বিনিয়োগকারীরা একজনে একটা শেয়ার কিনলে আরেকজন এটি দেখে সেই শেয়ার কেনে। এভাবে শেয়ারের দাম বাড়ে এবং শেষে পর্যন্ত তারা ধরা খায়। এ থেকে রক্ষা পেতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ কিভাবে বাড়ানো যায়, তা নিয়ে কাজ করতে হবে।’