বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদক আতঙ্ক

মুছা মল্লিক প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৮, ২০২২, ০১:২২ এএম

দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাদক আতঙ্ক মহামারি রূপ ধারণ করেছে। ক্যাম্পাসের নির্জন স্থানগুলো অথবা ছাত্রাবাসের বিভিন্ন কক্ষে নিয়মিতই বসছে মাদকের আসর। শিক্ষার্থীদের অনেকেই প্রথম দিকে কৌতূহলবশে মাদক সেবন করলেও পরবর্তীতে এ চক্র থেকে বের হয়ে আসতে পারছেন না অনেকেই।

ফলে পেশাদার মাদকসেবীদের সাথে তারাও নিয়মিত মাদক জালে জড়িয়ে পড়ছেন। সময়ের সাথে সাথে জন্মদিন, নতুন প্রেম, চাকরি, ভালো ফল, এমনকি ব্রেকআপের পার্টিতেও মাদকের আয়োজন চলছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাদকের এসব আসর ও অংশগ্রহণ যেন এখন ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে।

সেবনকারীদের বেশির ভাগ উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ায় এসব আসরে অপেক্ষাকৃত দামি মাদকের চাহিদাই বেশি। সামপ্রতিক সময়ের ভয়ঙ্কর মাদক এলএসডিও এর অন্যতম উদাহরণ। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত উচ্চবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের কেন্দ্র করে এলএসডির বাজার গড়ে উঠলেও জনপ্রিয় মাদক হিসেবে এখনো ইয়াবাই শীর্ষে।

জানা গেছে, দেশের সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে ইয়াবা ও ফেন্সিডিলসহ নিয়মিত নানা রকম মাদক প্রবেশ করছে। এসব মাদকের একটি বড় গ্রাহক হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। তবে আগে সরাসরি বাহকের মাধ্যমে স্থানীয় মাদকসেবীদের হাতে পৌঁছালেও মাদক বাজারে পরিবর্তন এসেছে।

এসব মাদক পরিবহনের জন্য কুরিয়ার সার্ভিস, সরাসরি বিক্রয় এমনকি অনলাইন অর্ডারও নেয়া হচ্ছে। বর্তমানে ডার্ক ওয়েবে এসব মাদকের বাজার বসে। সেখানে মোবাইল ব্যাংকিং, ভিসা কার্ডসহ নানা মাধ্যমে দাম চুকানো হয়। দাম চুকানো হলে সরবরাহকারীরা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে তা বিভিন্ন দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। এ প্রক্রিয়ায় দেশ ও দেশের বাইরে থেকেও অনায়াসেই ক্রেতার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে মাদক।  

তবে অনলাইনভিত্তিক যারা মাদক কিনছেন তাদের প্রায় সবাই উচ্চশিক্ষিত ও বিত্তশালী। একাধিক শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদক এখন খুব স্বাভাবিক এবং সহজলভ্য পণ্য হয়ে উঠেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দুই ধরনের মাদকসেবী দেখা যায়, প্রথমত যারা আগেই মাদক সেবন করেছে এবং দ্বিতীয়ত নতুন শিক্ষার্থীদের একটি অংশ মাদক সেবনে ঝুঁকে পড়ছে। এ দুই শ্রেণির মাদকসেবীদের সরবরাহকারী নির্ধারিত। কেউ কেউ আবার বিচ্ছিন্নভাবেও মাদক কিনছেন।

তবে যারা যেভাবেই মাদকে জড়িয়ে পড়ুক না কেন এদের বৈধতা দিচ্ছে কিছু অসাধু ছাত্রনেতা ও তাদের অনুসারীরা। এরা ক্যাম্পাসে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করে। এদের বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলেই নেমে আসে অন্ধকার। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মাদকসেবীরা প্রায় ১০ ধরনের মাদক সেবন করেন। সবচেয়ে ভয়াবহতা ইয়াবাকে ঘিরে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে অফিস-আদালত সবখানেই সর্বনাশা ইয়াবার থাবা। মাদকের সহজলভ্যতা, বন্ধুদের চাপ এবং বাবা-মায়ের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অনেকে মাদক গ্রহণে ঝুঁকছেন। অনেকেই আবার মাদক নিয়ে স্মার্ট হওয়ার প্রবণতা, হতাশা, একাকিত্ববোধ, বিষণ্নতা থেকে মুক্তি পেতে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছেন। সম্পর্কের টানাপড়েন ও প্রিয়জনের বিশ্বাসঘাতকতা থেকেও অনেকে মাদকের অন্ধকারে ডুব দিচ্ছেন। মাদকসেবী তরুণদের কেউ কেউ প্রতিনিয়ত মাদক ব্যয় নির্বাহ করতে নানাবিধ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। ফলে টাকা জোগাড় করতে হুমকি, অপহরণ এমনকি হত্যার মতো ঘটনাও ঘটছে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির কথা বলা হলেও প্রশাসনের আইনগত পদক্ষেপ নিতে অপারগতা, নিয়মিত নজরদারির অভাব ও আবাসিক হোস্টেল এবং ক্যাম্পাসে অভিযান পরিচালনার নজির না থাকায় এ সমস্যা জ্যামিতিকহারে বাড়ছেই। ফলে একদিকে যেমন মাদকসেবী শিক্ষার্থীদের জীবনে অন্ধকার নেমে আসছে; অপরদিকে সাধারণ শিক্ষার্থীরাও সংশয়ে দিন কাটাচ্ছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে ৮৭ দশমিক ৫ শতাংশই বন্ধুদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে মাদক গ্রহণ করেন। বাংলাদেশে মাদক গ্রহণে প্রতিদিনকার ব্যয় ১ দশমিক ৯ ডলার থেকে ৩ দশমিক ১ ডলার। এই টাকা জোগানো সবার পক্ষে সম্ভব নয়। মনে রাখতে হবে, ১ দশমিক ৯ ডলারের সীমাটা দারিদ্র্যমুক্তিরও সীমা। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে, কেউ এর চেয়ে বেশি আয় করলে তাকে দরিদ্র ধরা হয় না।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বলছে, দেশে এখন পর্যন্ত ২৪ ধরনের মাদকের সন্ধান মেলে। এসব মাদকের মধ্যে রয়েছে ইয়াবা, ফেন্সিডিল, হেরোইন, গাঁজা, চোলাই মদ, দেশি মদ, বিদেশি মদ, বিয়ার, রেক্টিফাইড স্পিরিট, ডিনেচার্ড স্পিরিট, তাড়ি, প্যাথেডিন, বুপ্রেনরফিন (টিডি জেসিক ইঞ্জেকশন), ভাঙ, কোডিন ট্যাবলেট, ফার্মেন্টেড ওয়াশ (জাওয়া), বুপ্রেনরফিন (বনোজেসিক ইঞ্জেকশন), মরফিন, আইচ পিল, ভায়াগ্রা, সেনোগ্রা, টলুইন, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ও মিথাইল-ইথাইল কিটোন। এছাড়া জামবাকসহ ব্যথানাশক ওষুধ কিংবা টিকটিকির লেজ পুড়িয়ে কেউ কেউ নেশা করে থাকে। এসব দ্রব্যের নেশাজনিত চাহিদা থাকায় বেশির ভাগই ভেজাল উৎপাদিত হচ্ছে দেশেই।

দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাদকের ভয়াবহতা ও এ সমস্যা থেকে করণীয় প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সাখাওয়াত হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, বিজাতীয় অপসংস্কৃতির চর্চায় অভ্যস্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা; বিশেষ করে যারা মাদকের সাথে জড়িত। তারা দেশীয় সংস্কৃতিতে উজ্জীবিত না হওয়ায় বিজাতীয় অপসংস্কৃতিতে আকড়ে ধরে ক্যাম্পাসে প্রতিপত্তি ধরে রাখার পাঁয়তারা থেকে মাদক সেবনসহ অন্যান্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এ হার প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

এর প্রধান কারণ সেখানে মাদক সেবনের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, নামমাত্র প্রক্টরিয়াল টিম থাকায় নেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। অপরদিকে এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে শিক্ষার্থীরা সিকিউরিটি সিস্টেমকে ফাঁকি দিয়ে অবাধে মাদকপণ্য নিয়ে ক্যাম্পাসে আসা যাওয়া করে এবং এর কারণে অন্যান্যরাও উদ্বুদ্ধ হয়। যারা এর সুবিধাভোগী ও যাদের সাথে আপনি মিশছেন মূলত আপনার পার্টনার বা ক্লোজ রিলেশনশপি মেইনটেন করেন এমন মানুষদের দ্বারা শিক্ষার্থীরা মাদক সেবনে জড়িয়ে পড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদকসেবীদের একটি চক্র রয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, এ চক্রের সাথে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যোগসাজশ রয়েছে। এ ধরনের সমস্যা সমাধানে ব্যাপকভাবে নজরদারি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। পরিবার থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও যারা এটি সরবরাহে জড়িত তাদের শনাক্ত করে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা জরুরি। কেননা শিক্ষার্থীরা জাতির সম্পদ, তারা নেশায় আাাক্রান্ত হলে ভবিষ্যতে জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. তারেক এম হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, ‘দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অপেক্ষা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তানরা পড়াশোনা করে। এদের বেশির ভাগই পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুসরণ ও অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের কারণে মাদকে জড়িয়ে পড়ে। এসব তাদের কাছে নিছক ফ্যাশনের বস্তু অথবা একটা ‘কুল’ বিষয় হয়ে ওঠে। ফলে উচ্চবিত্ত শিক্ষতদের বেশির ভাগই বিদেশি মাদকে আসক্ত হয়। পাশাপাশি এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও ধীরে ধীরে এ চক্রে জড়িয়ে পড়ে। মাদক একটি মানুষ থেকে তার ভেতরের জীবনীশক্তিকে কেড়ে নেয়।

গবেষণায় দেখা গেছে, মাদক সেবনের ফলে হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার ৩০ শতাংশ, ক্যান্সারজনিত মৃত্যু ৩৮ শতাংশ, ফুসফুসে যক্ষ্মার কারণে মৃত্যুর হার ৩৫ শতাংশ ও আন্যান্য শ্বাসতন্ত্রজনিত রোগে মৃত্যুর ২৪ শতাংশের জন্য মাদকদ্রব্য দায়ী। এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা, কাউন্সেলিং ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নজরদারির বিকল্প নেই।’