বৈষম্যের পারদ ঊর্ধ্বমুখী

রেদওয়ানুল হক প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৮, ২০২২, ০১:২৮ এএম

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যাত্রায় ক্রমেই বাড়ছে অর্থনৈতিক বৈষম্য। আয় বৈষম্যের পারদ এতটাই ঊধ্বমুখী যে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে এখন সমানতালে বাড়ছে ধনী ও গরিবের সংখ্যা।

একদিকে বৈশ্বিক করোনা মহামারির ধাক্কায় টিকে থাকার লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে দারিদ্র্য সীমার নিচে নেমে যাওয়ার তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। অন্যদিকে করোনা, যুদ্ধ ও মুদ্রাস্ফীতির হুমকির মধ্যেই বেড়ে চলেছে কোটিপতির সংখ্যা।  

২০২১ সালের ২০ মে প্রকাশিত বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) পরিচালিত এক যৌথ সমীক্ষায় দেখা যায়, করোনায় নতুন করে দরিদ্র শ্রেণিতে  যুক্ত হয়েছে প্রায় দুই কোটি ৪৫ লাখ মানুষ।

ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, মহামারির কারণে উপার্জন কমে যাওয়ায় গ্রামাঞ্চলের মানুষ তাদের সঞ্চয়ের ২৪ শতাংশ হারিয়েছে। অন্যদিকে, শহরাঞ্চলে সঞ্চিত অর্থ হ্রাসের পরিমাণ ১১ শতাংশ। এ ছাড়া  ১৪ শতাংশ দক্ষ শ্রমিক, ১৩ শতাংশ বেতনভুক্ত কর্মচারী এবং ৩২ শতাংশ গৃহকর্মী উচ্চ হারে কর্ম হারিয়েছেন।

একই বছরের জানুয়ারিতে প্রকাশিত জরিপে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম জানিয়েছে, করোনার প্রভাবে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার (আপার পোভার্টি রেট) বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশ। দেশব্যাপী খানা পর্যায়ের জরিপের ভিত্তিতে এই তথ্য প্রকাশ করে সংস্থাটি।

এমন পরিস্থিতিতেও আয় কমেনি বিত্তশালীদের। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কোটিপতি হিসাবধারীর সংখ্যা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে এক কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে এমন অ্যাকাউন্টের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ আট হাজার ৪৫৭টিতে। তিন মাস আগে যা ছিল এক লাখ তিন হাজার ৫৯৭টি। এ বছরের শুরুতে ২০২১ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিকে এর সংখ্যা ছিল এক লাখ এক হাজার ৯৭৬।

আর এক বছর আগে ২০২১ সালের জুনে কোটি টাকার বেশি হিসাবের সংখ্যা ছিল ৯৯ হাজার ৯১৮টি। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে কোটি টাকার হিসাব বেড়েছে আট হাজার ৫৩৯টি, ছয় মাসে বেড়েছে ছয় হাজার ৪৮১টি ও তিন মাসে বেড়েছে চার হাজার ৮৬০টি। অর্থাৎ গত এক বছরে কোটিপতি বৃদ্ধির হার যথাক্রমে ৩১৫ শতাংশ (ছয় মাসে) ও ৩০০ শতাংশ (গত তিন মাসে)। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০২২ সালের জুন ভিত্তিক হালনাগাদ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১২ কোটি ৯৫ লাখ ১৪ হাজার ৫১৩টি। যাদের হিসাবে জমা ছিল ১৫ লাখ ৭৩ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা। ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ১২ কোটি ৭৩ লাখ ৫২ হাজার ৮৯৩টি। তাদের হিসাবে জমা ছিল ১৫ লাখ ১৪ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। এছাড়া ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ১২ কোটি ১৫ লাখ ৪৯ হাজার ২৬৬টি। সে সময় তাদের হিসাবে জমা ছিল ১৪ লাখ ৩৯ হাজার ৭৬৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা।

তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, কোটি টাকার হিসাব মানেই কোটিপতি ব্যক্তির হিসাব নয়। কারণ ব্যাংকে এক কোটি টাকার বেশি অর্থ রাখার তালিকায় ব্যক্তি ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। আবার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কতটি ব্যাংক হিসাব খুলতে পারবে, তার কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই। ফলে এক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির একাধিক হিসাবও রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কোটি টাকার হিসাবও রয়েছে।

২০২২ সালের জুন পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী, এক কোটি এক টাকা থেকে পাঁচ কোটি টাকার আমানতকারীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৫ হাজার ৮৪১টি। যাদের হিসাবে জমা টাকার পরিমাণ এক লাখ ৭৬ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা। পাঁচ কোটি থেকে ১০ কোটির মধ্যে রয়েছে ১১ হাজার ৮৬৫টি হিসাব। তাদের অ্যাকাউন্টে টাকার পরিমাণ ৮৪ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। এছাড়া ১০ কোটি এক টাকা থেকে ১৫ কোটির টাকার হিসাব রয়েছে তিন হাজার ৭৬৩টি, ১৫ কোটি এক টাকা থেকে ২০ কোটির মধ্যে এক হাজার ৭১৯টি, ২০ কোটি এক টাকা থেকে ২৫ কোটির মধ্যে এক হাজার ১৫১টি, ২৫ কোটি এক টাকা থেকে ৩০ কোটির মধ্যে হিসাব রয়েছে ৮৮৩ জনের, ৩০ কোটি এক টাকা থেকে ৩৫ কোটি টাকার মধ্যে ৫০২টি এবং ৩৫ কোটি এক টাকা থেকে ৪০ কোটির মধ্যে রয়েছে ৩০৭ আমানতকারীর হিসাব। ৪০ কোটি এক টাকা থেকে ৫০ কোটি টাকার অ্যাকাউন্ট সংখ্যা ৬২১টি। আলোচিত সময়ে ৫০ কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা হিসাবের সংখ্যা বেড়ে এক হাজার ৮০৫টিতে দাঁড়িয়েছে।

এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, আয় বৈষম্যের মাত্রা অসহনীয় হয়ে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি যে হারে বাড়ছে সে অনুপাতে সবার আয় বাড়ছে না। ফলে তাদের ক্রয়ক্ষমতা এবং জীবনযাত্রার মান কমে যাচ্ছে। অনেকে সঞ্চয় ভেঙে জীবন চালিয়ে নিচ্ছে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির অসহনীয় চাপের মধ্যেও দেশে কোটিপতির সংখ্যা বাড়ছে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান আমার সংবাদকে বলেন, করোনা মহামারির প্রভাবে দ্রব্যমূল্যের দাম যেভাবে বেড়েছে তাতে গরিব মানুষরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ব্যবসায়ী শ্রেণি লাভবান হয়েছে। অন্যদিকে করোনার ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে সরকার যেসব প্রণোদনা দিয়েছে তা বড় ব্যবসায়ী শ্রেণি যেভাবে পেয়েছে, সে অনুপাতে দরিদ্র মানুষ বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পায়নি।

এ সময়ে অনেক মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়েছে কিন্তু ধনীরা করোনার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তাদের সম্পদ আরও বাড়িয়ে নিয়েছে। তাই দরিদ্র ও কোটিপতির সংখ্যা সমানতালে বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারী ছিল পাঁচজন, ১৯৭৫ সালে তা ৪৭ জনে উন্নীত হয়। ১৯৮০ সালে কোটিপতি হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ৯৮টি।

এরপর ১৯৯০ সালে ৯৪৩টি, ১৯৯৬ সালে দুই হাজার ৫৯৪টি, ২০০১ সালে পাঁচ হাজার ১৬২টি, ২০০৬ সালে আট হাজার ৮৮৭টি এবং ২০০৮ সালে ছিল ১৯ হাজার ১৬৩টি। ২০২০ সালে ডিসেম্বর শেষে দাঁড়ায় ৯৩ হাজার ৮৯০টিতে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে কোটিপতি হিসাবের সংখ্যা বেড়ে এক লাখ এক হাজার ৯৭৬টিতে পৌঁছায়।