প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পুনঃঅর্থায়ন (রিফাইন্যান্স) স্কিম নিতে যাচ্ছে দেশে কার্যরত ইসলামী ব্যাংকগুলো। সরাসরি সুদ লেনদেনের কারণে এর আগে কখনো এ স্কিমে অংশগ্রহণ করেনি ইসলামী ধারার কোনো ব্যাংক। সুদের পরিবর্তে মুনাফার সুযোগ দিয়ে ইসলামী ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীকে ঋণ সুবিধা দিতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে যে মডিউলে এ স্কিম সাজানো হয়েছে তাতে মুনাফার শর্ত ইসলামী শরিয়াহ সমর্থন করছে না বলে অভিযোগ বিনিয়োগকারী ও সাধারণ গ্রাহকদের।
তাদের দাবি, শুধু সুদের পরিবর্তে মুনাফা লিখে দিলেই বৈধ হয়ে যাবে না বরং শরিয়াহ সমর্থিত পন্থায় স্কিমটি পুনর্গঠন করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের চাপেই ইসলামী ব্যাংকগুলো এতে অংশগ্রহণ করতে রাজি হচ্ছে এবং শরিয়াহ বোর্ডের অনুমোদনের আগেই চুক্তিতে স্বাক্ষর করছে —এমন দাবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট ফোরামে জোর প্রতিবাদ দেখা যাচ্ছে।
ব্যাংকগুলোর শরিয়াহ বোর্ড ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শক স্কলাররা বলছেন, বর্তমান নিয়মে ইসলামী ব্যাংকগুলোর এ স্কিমে অংশ নেয়ার সুযোগ নেই। তবে কিছু সংশোধনীর মাধ্যমে এ সুযোগ নেয়া যেতে পারে। উভয় পক্ষের যথেষ্ট আন্তরিকতাও আছে। তাই স্কলারদের পরামর্শের ভিত্তিতে সংশোধন এনে স্কিমটি পরিচালনা করলে আর বিতর্ক থাকবে না বলে তারা মনে করেন।
জানা গেছে, গত ১৯ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই অ্যান্ড স্পেশাল প্রোগ্রামস ডিপার্টমেন্ট থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি (সিএমএসএমই) শিল্পের উদ্যোক্তাদের জন্য ২৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিম (রিফাইন্যান্স) চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই স্কিম পরিচালনা করা হবে।
এতে সিএমএসএমই, বিশেষ করে এসএমই ক্লাস্টারের উদ্যোক্তা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তা ও নারী উদ্যোক্তাদের বিশেষ প্রাধান্য দিয়ে ঋণ দেয়া হচ্ছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ২ শতাংশ সুদ বা মুনাফায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ৭ শতাংশ সুদ বা মুনাফায় গ্রাহকদের দেবে।
এর আগে এ ধরনের সার্কুলারে স্পষ্ট করে লেখা থাকত শরিয়াহভিত্তিক ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য প্রযোজ্য নয়। কিন্তু এবারই প্রথম এ স্কিমটিতে ইসলামী ব্যাংকগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এ ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ ব্যবস্থা ছাড়াই কেবল সুদের স্থলে মুনাফা লেখা হয়েছে।
আর ব্যাংকগুলোকে তড়িঘড়ি করে চুক্তি করতে ডাকা হয়েছে। যদিও কোনো নতুন অপারেশনের ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকগুলো তাদের শরিয়াহ বোর্ড থেকে অনুমোদন নিয়ে থাকে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে শরিয়াহ বোর্ডের অনুমোদনের আগেই বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে চুক্তি করেছে কয়েকটি ইসলামী ব্যাংক।
এছাড়া যেহেতু এটি সব ইসলামী ব্যাংকের ক্ষেত্রেই নতুন স্কিম তাই সেন্ট্রাল শরিয়াহ বোর্ডের পরামর্শও নিতে পারে ব্যাংকগুলো। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের চাপেই তড়িঘড়ি করে চুক্তি করছে ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে এখন পর্যন্ত সাতটি ইসলামী ব্যাংক এ স্কিমে অংশগ্রহণ করতে চুক্তি করেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেহেতু দেশের বড় একটি অংশ ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সাথে যুক্ত তাই বাংলাদেশ ব্যাংক চাইছে ইসলামী ব্যাংকগুলোকে এতে অন্তর্ভুক্ত করে সঠিক গ্রাহকের কাছে রিফাইন্যান্স সেবা পৌঁছে দিতে। বিশেষ করে নতুন গভর্নর আসার পর এমন উদ্যোগ চোখে পড়ছে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের আর্থিক সক্ষমতা নিশ্চিত করতে এসব বিষয়ে জোর দিচ্ছেন তিনি। তবে শতভাগ শরিয়াহ নিশ্চিত না করে রিফাইন্যান্স স্কিমে ইসলামী ব্যাংকগুলোকে যুক্ত করলে বিশাল জনগোষ্ঠী ইসলামী ব্যাংকিংয়ে আস্থা হারিয়ে ফেলতে পারে। এতে পরোক্ষভাবে আর্থিক খাতে বড় প্রভাব পরবে।
ইসলামী স্কলার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ইসলামী ব্যাংক প্রধানত তিনটি উপায়ে বিনিয়োগ নেয় । ক্রয়-বিক্রয়, ইজারা ও মুদারাবা বিনিয়োগ। এর বাইরে করযে হাসানা দিতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে মুনাফার ভিত্তিতে ইসলামী ব্যাংকগুলোকে টাকা দিতে বর্তমান মডিউলে পরিবর্তন এনে শরিয়াহ স্কলারদের পরামর্শের আলোকে পুনর্গঠন করতে হবে। তখন আর বিতর্ক থাকবে না। এ ছাড়া ‘প্রি-ফাইন্যান্স’ বিকল্প সমাধান হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো গ্রাহক জোগাড় করে দেয়ার পরিবর্তে সার্ভিস চার্জ নিতে পারবে। তবে এ ধরনের দাবি ইসলামী ব্যাংকগুলো থেকেই আসতে হবে।তখন বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্যই পরীক্ষা করে দেখবে এবং এর প্রবর্তন হলে সব বিতর্কের অবসান হবে।
এ বিষয়ে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মনিরুল মওলা আমার সংবাদকে বলেন, ইসলামী ব্যাংক রিফাইন্যান্স নিতে পারে না, এ কথা ঠিক না। বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য আলাদা ডিজাইন করেছে যার ভিত্তিতে আমরা নিচ্ছি। বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের টাকা দেবে তাদেরকে ২ শতাংশ মুনাফা দিতে হবে। আমরা ৭ শতাংশ পর্যন্ত লাভ করতে পারব।
তিনি বলেন, রিফাইন্যান্স মানেই সুদ নয়। আমরা সব কিছু বিবেচনা করেই এটি নিচ্ছি। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের লাইসেন্স দিয়েছে ইসলামী শরিয়াহ মেনে ব্যবসা করার জন্য। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সহায়তা করতে চাচ্ছে। যেহেতু দেশের প্রায় ৩০ শতাংশ গ্রাহক ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সাথে জড়িত তাই এ বিশাল জনগোষ্ঠীর কাছে সরকারি সহায়তা পৌঁছে দিতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
অতীতে কখনো রিফাইন্যান্স না নিলেও এবার কেন নেয়া হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমরা শরিয়াহ বোর্ডের অনুমোদন নিয়েই কাজ করব।
গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীরা বিষয়টিতে আপত্তি জানিয়ে সামাজিক মাধ্যমে স্বোচ্চার হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, একটা পক্ষ আছে যারা আগে থেকেই ইসলামী ব্যাংকের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে আসছে। তারা সব সময় বলে আসছে ইসলামী ব্যাংক কৌশলে সুদের ব্যবসা করে। এছাড়া দেশের প্রয়োজনেই রিফাইন্যান্স নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে চুক্তি হয়েছে বলে জানান দেশের সবচেয় বড় ইসলামী ব্যাংকটির এমডি।
মতামত জানতে আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যস্থাপনা পরিচালককে একাধিক বার ফোন করা হয়। কিন্তু তারা রিসিভ করেননি। তবে একটি ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের সাথে কথা হয় আমার সংবাদের।
শরিয়াহ বোর্ডের কর্মকর্তারা বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা মতামত প্রস্তুত করছি। কয়েকটি বিষয় সংশোধন করলেই আর সমস্যা থাকবে না। যেসব বিষয় শরিয়াহর সাথে সাংঘর্ষিক সেগুলো চিহ্নিত করে আমরা মতামত দেবো। আশাকরি বাংলাদেশ ব্যাংক তা আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার আল্লামা কামাল উদ্দিন আবদুল্লাহ জাফরী আমার সংবাদকে বলেন, ‘সাধারণভাবে মনে হচ্ছে ইসলামী ব্যাংকগুলোর রিফাইন্যান্স স্কিমে অংশ নেয়ার সুযোগ নেই। তবে শরিয়াহসম্মত উপায় অনুসরণ করে এটি সাজালে আর সমস্যা থাকবে না। ইসলামী ব্যাংকগুলো কিভাবে নিচ্ছে তা আমার জানা নেই।’ তবে তাদের শরিয়াহ বোর্ড যথাযথ পদক্ষেপ নেবে বলে আশা করেন এ শরিয়াহ বিশেষজ্ঞ।