জঙ্গি হামলার শঙ্কা নিয়েই আজ থেকে শুরু হচ্ছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা। যদিও গত বছর কুমিল্লায় গুজবের ঘটনা বিবেচনায় ও সাম্প্রতিক সময়ে হিজরতের নামে ৫০ যুবকের ঘর ছাড়ার ঘটনায় এবার কঠোর অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সুশৃঙ্খলভাবে পূজা সম্পন্ন করতে সরকারেরও নির্দেশনা রয়েছে।
ইতোমধ্যে মাঠ প্রশাসনের সাথে মিটিং করে নির্দেশনাও দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত-অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে মাঠ প্রশাসনও রয়েছে কঠোর অবস্থানে। এবার সারা দেশে ৩২ হাজার ১৬৮টি পূজা মণ্ডপের প্রতিটিতেই গুরুত্ব অনুযায়ী কোথাও একজন এসআই, কোথাও একজন এএসআই পদমর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তার নেতৃত্বে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সাজানো হয়েছে। তাদের সাথে আনসার ও মন্দিরের স্বেচ্ছাসেবকরাও নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন।
ঢাকার ২৪২টি মণ্ডপের মধ্যে পাঁচটি ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত মন্দিরে ইতোমধ্যেই সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ-ডিএমপি। প্রতিটি মণ্ডপেই সিসিটিভি স্থাপন করে মনিটর করা হচ্ছে। পুলিশ, আনসার ও স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে।
এছাড়া আর্চওয়ে, মেটাল ডিটেক্টর, ডগ স্কোয়াডের মাধ্যমে ভিভিআইপি নিরাপত্তাও নিশ্চিত করেছে ডিএমপি। পূজা মণ্ডপ ঘিরে প্রশাসনের এমন কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীতেও সনাতন ধর্মালম্বীদের মধ্যে বিরাজ করছে চাপা আতঙ্ক। তারা বলছেন, দেশের একাধিক অঞ্চল থেকে ‘হিজরতের’ নামে ঘর ছাড়া ৫০ যুবকই এবারের পূজায় তাদের আতঙ্কের কারণ।
জাতীয় শীবমন্দির পরিচালনা পর্ষদের প্রচার সম্পাদক নয়ন সাহা আমার সংবাদকে বলেন, ‘গুজব কে কখন কোন প্রেক্ষাপটে ছড়াবে তার ঠিক নেই। তবে এসব রোধে প্রশাসনের কঠোর অবস্থানের প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে। যদিও শঙ্কার কারণ হিজরতের নামে ঘরছাড়া ৫০ যুবক। যারা এখন পর্যন্ত নিখোঁজ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখনো তাদের অবস্থান শনাক্ত করতে পারেনি।’
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অনেকেই বলছেন, ‘হোলি আর্টিজানে হামলার আগে নব্য জেএমবিতে জড়িয়ে অনেকেই ঘর ছেড়েছিলেন। সামপ্রতিক সময়ে ঘরছাড়া তরুণরাও আনসার আল-ইসলামের সদস্য বলে মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পেরেছেন তারা। যে কারণে আতঙ্ক পিছু ছাড়ছে না তাদের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পাঁচ বছর পর নতুন করে তরুণদের ঘর ছাড়ার ঘটনা শারদীয় দুর্গাপূজা ছাড়াও উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। গত নভেম্বর থেকে আগস্টের মধ্যে ঘর ছাড়ে ওইসব তরুণ। এদের মধ্যে কুমিল্লা, পটুয়াখালী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও সিলেট থেকেই নিখোঁজের সংখ্যা বেশি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যে জানা যায়, এখন পর্যন্ত নতুন করে নিখোঁজ রয়েছেন ৫০ জনেরও অধিক তরুণ। বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্যে, চলতি বছরের শুরুর দিক থেকে নতুন করে তরুণদের বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানায় নিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করে একটি জঙ্গিগোষ্ঠী। তারা হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলায় জড়িত আইএস মতাদর্শী জঙ্গিগোষ্ঠী নয় বলে ওয়াকিবহাল একটি সূত্র জানিয়েছে।
সূত্রটির মতে, এ জঙ্গিদের কার্যক্রমের সাথে আল-কায়েদা মতাদর্শী আনসার আল-ইসলামের কার্যক্রমের সামঞ্জস্য রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও বলছেন, হোলি আর্টিজানে হামলাকারীরা সবাই এভাবেই ঘর ছেড়েছিলেন। এখন আবার বেশ জোরেশোরে হিজরতের নামে বের হচ্ছেন। এদের যদি খুঁজে বের করা না যায় তবে এটি হবে বড় দুশ্চিন্তার কারণ। গণমাধ্যমের এমন খবর আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের বক্তব্যে গুজব কিংবা অন্য কোনো ঘটনা নিয়ে যতটা না চিন্তিত সনাতন ধর্মালম্বীরা; তার চেয়ে বেশি আতঙ্কে রয়েছেন নিখোঁজ ৫০ যুবকের বিষয়ে। তবে পূজা মণ্ডপের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিদর্শনে গিয়ে ঢাকেস্বরী মন্দিরে ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলছেন, দুর্গাপূজা ঘিরে জঙ্গি হামলার আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না তারা।
সেখানে তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তা ঝুঁকি দুই ধরনের হয়। একটি জঙ্গি হামলা, অন্যটি ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে সাধারণ মানুষকে উসকানি দিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা। জঙ্গি হামলার শঙ্কা আমরা একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছি না। কারণ, এক মাস ধরে আমরা একটি বিষয় নিয়ে কাজ করছি— ৫০ তরুণ বাড়ি ছেড়েছেন। তারা কোথায় ট্রেনিং নিচ্ছেন, আমরা এখনো তা জানি না। গোয়েন্দারা এ নিয়ে কাজ করছে।’
তিনি আরও বলছেন, ‘আশা করি তারা ফিল্ডে কোনো অপারেশনে আসার আগেই তাদের ধরে ফেলতে পারব।’ মূলত ডিএমপি কমিশনারের এমন বক্তব্যের পরই আতঙ্কের চাপ আরও বৃদ্ধি পায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে। জাতীয় শীব মন্দিরের প্রচার সম্পাদক নয়ন সাহাও বলেছেন একই কথা।
তিনি বলছেন, ‘ডিএমপি কমিশনারের বক্তব্যের পরই মূলত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে নিখোঁজ ৫০ যুবককে নিয়ে চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে।’
সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘নারী-পুরুষদের মণ্ডপে ঢুকতে ও বের হতে আলাদা পথ ব্যবহার করতে হবে। কেউ কোনো ধরনের ব্যাগ সাথে নিয়ে মণ্ডপে আসতে পারবে না, এমনটি হলে সেগুলো মণ্ডপের গেটের বাইরে রেখে ভেতরে ঢুকতে হবে।’ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে পূজা উদযাপনের জন্য সবার প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি।
এদিকে পূজা শুরুর মাসখানেক আগে থেকেই মণ্ডপের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করছে মাঠ প্রশাসন। জেলা পুলিশ সুপাররা নিজ নিজ জেলায় অংশীজনদের নিয়ে সভা করেছেন, যাতে পূজায় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ছাড়াও যেকোনো বিশৃঙ্খলা এড়ানো যায়। এরই মধ্যে হিজরতের নামে ৫০ যুবকের ঘর ছাড়ার বিষয়টি আলোচনায় আসে।
হিজরতের নামে ৫০ যুবকের নিখোঁজ হওয়া ও শারদীয় দুর্গাপূজার নিরাপত্তার বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের বক্তব্য জানতে চাইলে পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি, মিডিয়া) মঞ্জুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের নজরদারিতে রয়েছে। সে অনুযায়ী কাজ চলছে।’