ভালো কাজ কিংবা সৎ উদ্যোগের জন্য পেশাগত পরিচয় কখনো মুখ্য হতে পারে না। তারই দৃষ্টান্ত স্থাপন করে দেখিয়েছেন কর্মক্ষেত্রে সততা, সাহসিকতা, দক্ষতা আর সময়োপযোগী-দূরদর্শী ও বহুমুখী নেতৃত্বগুণে সুখ্যাতি লাভ করা কর্মকর্তা বাংলাদেশ পুলিশের সদ্য পদোন্নতিপ্রাপ্ত অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমান। পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ইতোমধ্যেই নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়।
কেবল কঠোরতাই নয়, অবহেলিত আর নিগৃহীত জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়িয়ে সবার ধারণাও পাল্টে দিয়েছেন তিনি। পুলিশি সেবার বাইরে গিয়েও মানবিক কাজকেও ভালোবেসেছেন তিনি। সুযোগ আর সময় পেলেই কাছে টেনে নিচ্ছেন সুবিধাবঞ্চিতদের। ইতোমধ্যেই তিনি বদলে দিয়েছেন সমাজের পিছিয়েপড়া বেদে সমপ্রদায় ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের। কাজ করছেন যৌনপল্লীর শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়াতে।
শুধু তাই নয়, ভালো কাজ করতে সহযোগিতার পাশাপাশি দেন দিকনির্দেশনাও। এ জন্য মানবিক পুলিশ অফিসার হিসেবেও তার সুখ্যাতি রয়েছে। পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ সব দায়িত্বে থেকেও নিজেকে কর্মের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন সাধারণের সেবায়।
অবহেলিত জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে ২০১৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠা করেন ‘উত্তরণ ফাউন্ডেশন’। বর্তমানে সাভার ছাড়াও মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ ও সিংড়া এলাকার পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীর মানুষদের নিয়ে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি।
মেধাবী, সৎ ও চৌকস এই পুলিশ কর্মকর্তা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৬৭ সালে গোপালগঞ্জের চন্দ্র দিঘলিয়া গ্রামে। ১৭তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে যোগ দেন তিনি। পেশাগত জীবনে তিনবার বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) ও দু’বার রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক (পিপিএম) লাভ করেন।পেশাগত কাজের বাইরে করেন লেখালেখিও। এছাড়া একজন সফল ক্রীড়া সংগঠকও তিনি। কাজ করছেন দেশের কাবাডি নিয়েও।
পুলিশের বর্তমান ও সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও তার বিষয়ে বলছেন, হাবিবুর রহমান সাধারণ মানুষের রিঅ্যাকশন বুঝতে পেরেছেন। এটি অবশ্যই গঠনমূলক ও গণমুখী এবং সেবামুখী পদক্ষেপ। বিশেষ প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন আমার সংবাদের নিজস্ব প্রতিবেদক-নুর মোহাম্মদ মিঠু
করোনাকালে অধীনস্থদের প্রতি সহমর্মিতা ও নাগরিকদের পুলিশিসেবা
করোনাকালে পুলিশের এই কর্মকর্তা প্রায় প্রতিটি পুলিশ সদস্যের খোঁজখবর নিয়েছেন, মনোবল বাড়ানোর জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন। তাদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে নিরলস কাজ করেছেন, পাঠিয়েছেন উপহারসামগ্রী। এমনকি সশরীরে মাঠে নেমেছেন জনগণকে সচেতন করার লক্ষ্যে। নিজ উদ্যোগ করোনায় কর্মহীন সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে দিয়েছেন খাদ্য সহায়তা। ঈদে দুস্থদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন ‘ঈদসামগ্রী’। তার স্বকীয় প্রচেষ্টায় পুলিশ সম্পর্কে সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে পাল্টে দিয়েছেন। প্রশংসিত করেছেন সমকালীন পুলিশের প্রবণতা ও উদ্যমকে। বর্তমানে পুলিশের জনকল্যাণধর্মী ভূমিকার অন্যতম আইকন অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমান। তাই তো তিনি হয়ে উঠেছেন পুলিশের রোল মডেল। পুলিশ জনগণের প্রকৃত বন্ধু— এই মূল মন্ত্রকে তার দূরদর্শী নেতৃত্বগুণে শতভাগ প্রতিপন্ন করেছেন। নিজ রেঞ্জ এলাকার পুলিশের জরুরি রক্ত সরবরাহে খুলেছেন ‘ব্ল্যাড ব্যাংক’। নিজ বাহিনীর সদস্যরাই সেখানে রক্ত দেন; পরে তা সংগ্রহ করে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে রাখা হয়। পরবর্তীতে জরুরি প্রয়োজনে তা কাজে লাগান পুলিশ সদস্যরা। সমাজ পরিবর্তনে, মানুষের কল্যাণে, মানবতার স্বার্থে পুলিশের কার্যকর ভূমিকা রাখতে অবিরাম কাজ করে চলেছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
ভাসমান বেদে জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার কারিগর হাবিবুর রহমান। বেদে জনগোষ্ঠীর বাসিন্দারা কেন পিছিয়ে থাকবে— এমন ভাবনা থেকেই তার উত্তরণ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বিশাল এই জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নে কাজ শুরু করেন তিনি। এরপর থেকেই মূলত বেদে শিশু-কিশোররা এখন স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও ইডেন কলেজের মতো নামি প্রতিষ্ঠানেও লেখাপড়া করছে। চাকরিও করছে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে। এ সবই সম্ভব হয়েছে হাবিবুর রহমানের উদ্যোগের বদৌলতে। শুধু তাই নয়, হাবিবুর রহমানের তত্ত্বাবধানে এগিয়ে চলা বেদে জনগোষ্ঠীর কেউ কেউ রাজনৈতিক অঙ্গনেও সফলতা দেখাচ্ছেন। তাদের একজন সাভার পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রমজান আহম্মেদ। তিনি বলেন, ‘হাবিবুর রহমান সাভারে বেদেপল্লীতে স্থাপন করেছেন উত্তরণ শিক্ষালয়। বেদে পরিবারের হতদরিদ্র শিশু-কিশোররা এখানে কোচিং নিয়ে দেশের নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেধার সাক্ষর রাখছে’। বর্তমানে উত্তরণ শিক্ষালয়ে প্রায় ২০০ শিক্ষার্থী রয়েছে। যারা মেধাবী হয়ে গড়ে উঠছে। কারিগরি শিক্ষার জন্যও তিনি বেদেপল্লীতে উত্তরণ কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার, উত্তরণ ড্রাইভিং ট্রেনিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছেন। সাভারের পোড়াবাড়ি বেদেপল্লীতে নির্মিত হচ্ছে হাবিবুর রহমান প্রাথমিক বিদ্যালয়, দারুল আফতান হাফিজিয়া মাদ্রাসা, উত্তরণ পল্লী প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান। বেদে বেকার নারী-পুরুষের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘উত্তরণ ফ্যাশন’ নামে একটি গার্মেন্টস কারখানা। সাভারের তুরাগ নদীর তীরে গড়ে উঠেছে উত্তরণ পল্লী। পোড়াবাড়ির ওয়াহিদুল্লাহ ও আনিসা দম্পতির মেয়ে ওয়াহিদিনা আক্তার উত্তরণ শিক্ষালয়ে কোচিং করে এখন অনার্স প্রথমবর্ষে পড়ছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। একইভাবে অনামিকা আক্তার ইডেন কলেজে অনার্স প্রথমবর্ষে পড়ছেন। সর্বোপরি সাভারের বেদেপল্লীর নারী-পুরুষ এখন শিক্ষিত হয়ে গড়ে উঠছে। পুলিশ বিভাগেও চাকরি করছেন অনেকেই। এসবই সদ্য পদোন্নতিপ্রাপ্ত পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপির অবদান। এছাড়াও বেদে জনগোষ্ঠীর অপ্রকাশিত ভাষা নিয়ে হাবিবুর রহমানের লেখা গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘ঠার’ বিভিন্ন মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। চলতি বছরের বইমেলাতেও বইটির পাঠক চাহিদা বেশ ভালো ছিল বলে জানায় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স। পাশাপাশি পাঠকরা বলছেন, নানান জনগোষ্ঠীর নানান ভাষা রয়েছে। কিন্তু বেদে জনগোষ্ঠীর যে একটি আলাদা ভাষা রয়েছে, তা আমাদের অজানা ছিল। সেই আগ্রহ থেকেই বইটি পছন্দের শীর্ষে স্থান পায়। রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদও ব্যাপক প্রশংসা করেছেন বইটির।
ওয়েসিসের মাধ্যমে সেবা
সেবার সব স্তরেই সফল পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমানের তদারকিতে পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের উদ্যোগে ঢাকার অদূরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের বসুন্ধরা রিভারভিউ প্রকল্পে গড়ে উঠেছে অত্যাধুনিক মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র ‘ওয়েসিস’। সম্পূর্ণ অলাভজনক এ প্রতিষ্ঠানটিতে তার হাত ধরেই চালু হয়েছে ‘টেলিমেডিসিন সেবা’। যেখানে প্রতিদিন বিনামূল্যে ২৪ ঘণ্টা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মাধ্যমে টেলিমেডিসিন সেবা দেয়া হয়। প্রতিনিয়ত বিষয়টি মনিটরিংও করেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন এই কর্মকর্তা। প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা সুশান্ত নারায়ণ বলেন, ‘হাবিব স্যার গত মাসেও দুইবার ওয়েসিসে এসেছেন। রোগীদের চিকিৎসা, খাবার, কাউন্সিলিং সব বিষয় খোঁজখবর নিয়ে গেছেন। পাশাপাশি যারা এখান থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন তাদের সাথে যোগাযোগ ঠিক মতো করা হচ্ছে কি-না সেই রেজিস্টার পুঙ্খানুপুঙ্খুভাবে দেখে গেছেন।’
স্বাধীনতার স্মৃতি ও চেতনার বাতিঘর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর— হাবিবুর রহমানের একক প্রচেষ্টার ফসল। যা মুক্তিযুদ্ধের বহু স্মৃতি ও চেতনার বাতিঘর। মূলত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দায়বদ্ধতা থেকেই তার পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে টেলিকম ভবনে প্রতিষ্ঠিত এই জাদুঘর একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ এটি সর্বসাধারণের প্রবেশের জন্য উম্মুক্ত করে দেয়া হয়। পরবর্তীতে ২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি ‘জাতীয় পুলিশ সপ্তাহ-২০১৭’-এর উদ্বোধনের দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশ স্মৃতিস্তম্ভের ঠিক পাশেই নবনির্মিত জাদুঘর ভবনের উদ্বোধন করেন। যেখানে মুক্তিযুদ্ধের সময় পুলিশ সদস্যদের ব্যবহূত রাইফেল, বন্দুক, মর্টারশেল, হাতব্যাগ, টুপি, চশমা, মানিব্যাগ, ইউনিফর্ম, বেল্ট, টাই, স্টিক, ডায়েরি, বই, পরিচয়পত্র, কলম, মেডেল, বাঁশি, মাফলার, জায়নামাজ, খাবারের প্লেট, পানির মগ, পানির গ্লাস, রেডিও, শার্ট, প্যান্ট, র্যাঙ্ক ব্যাজসহ টিউনিক সেট, ক্যামেরা, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, লোহার হেলমেট, হ্যান্ড মাইক, রক্তভেজা প্যান্ট-শার্ট, দেয়ালঘড়ি, এমএম রাইফেলসহ অনেক কিছু সংরক্ষিত আছে।
বেদে জনগোষ্ঠীসহ দৌলতদিয়ার যৌনপল্লীতে হাবিবুর রহমানের মানবিক কার্যক্রম ইতোমধ্যেই বিভিন্ন মহলে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। এ কার্যক্রম তিনি ছড়িয়ে দিতে চান সারা দেশেই। তিনি বলেন, ‘দেশের সব নাগরিকের সমান অধিকার রয়েছে। সংবিধানে সবার জন্য সে অধিকার রেখে গেছেন বঙ্গবন্ধু আর তার কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও সেই ব্যবস্থা অব্যাহত রেখেছেন। আমি সেই আদর্শের অনুসারী হয়ে সমাজ বদলের এই প্রচেষ্টাকে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে দিতে চাই। তখনই আসলে সত্যিকার পবিরর্তন চোখে পড়বে। সমাজে পরিবর্তনের ছাপ ইতোমধ্যে লক্ষও করা যাচ্ছে।’ মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের হাট বাসুদেবপুর গ্রামে সান্দার বেদে গোত্রের প্রায় ২০০টি পরিবার স্থায়ীভাবে বসবাস করে; যাদের শতভাগ মুসলমান। অথচ এই জনগোষ্ঠীর কেউ মারা গেলে মুসলমান হিসেবে তাদের সৎকারটুকুও করতে পারতেন না। পরিবারের কোনো সদস্য মারা গেলে আশপাশের কোনো কবরস্থানে তাদের কবর দিতে দেয়া হতো না। এমন করুণ অবস্থা জানতে পেরে সহকর্মীদের সহযোগিতায় একটি জায়গা খুঁজে পান হাবিবুর রহমান, যেটি কিনে দান করেন এই জনগোষ্ঠীর ২০০ পরিবারের কল্যাণে। তা ছাড়া ২০২০ সালের শুরুতে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়ায় বহু পুরনো যৌনপল্লীতে প্রথমবারের মতো একজন যৌনকর্মীর পুরোপুরি ইসলামি প্রথা মেনে জানাজা পড়িয়ে দাফন করা হয়। পরে চেহলামেরও আয়োজন করা হয়। এখন নতুনভাবে দৌলতদিয়ার যৌনপল্লীর শিশুদের জন্যও কাজ শুরু করেছেন তিনি। যার সুফলও মিলছে। বিশেষ করে যৌনপল্লীর শত শত শিশুকে সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে তার হাতে গড়া ‘উত্তরণ ফাউন্ডেশন।
দেশের পিছিয়েপড়া অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর কল্যাণ, পুলিশ বিভাগের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বলে নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, লেখালেখিসহ বহুমুখী সফল কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি ক্রীড়াঙ্গনেও অসামান্য অবদান রেখে আসছেন হাবিবুর রহমান। সফল ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে ইতোমধ্যেই নিজের স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। ক্রীড়াঙ্গনে থিঁতিয়ে যাওয়া কাবাডিকে মূলধারায় তুলে এনেছেন তিনি। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সুনাম কুড়িয়েছেন। ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে এখন তিনি বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ও এশিয়ান কাবাডি ফেডারেশনের সহ-সভাপতির দায়িত্বও সফলভাবে পালন করছেন।
সমাজ উন্নয়নের স্বার্থে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নেয়া ও নানাভাবে কর্মমুখী করে গড়ে তোলার প্রবল ইচ্ছায় অবহেলিত ও বঞ্চিত বেদে এবং হিজড়াদের বেছে নেন হাবিবুর রহমান। এরা মানুষ হয়েও মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। সঠিক দিকনির্দেশনার অভাব আর বেঁচে থাকার তাগিদে জড়িয়ে পড়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডেও। আর তাদেরকে সঠিক ও আলোর পথ দেখাতেই নিরলস কাজ করছেন তিনি এবং এ লক্ষ্যেই উত্তরণ ফাউন্ডেশনের যাত্রা। এটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এই সংগঠনের মাধ্যমেই হিজড়া ও বেদে সমপ্রদায়ের লোকজনের মধ্যে আলো ছড়াচ্ছেন হাবিবুর রহমান। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে হিজড়াদের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে বিউটি পার্লার। পার্লারগুলোই এখন নতুনভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখাচ্ছে হিজড়াদের। তাদের মূল পেশার (প্রতারণা, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসা) বাইরে এনে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছেন তিনি। পাশাপাশি বেদে সমপ্রদায়ের জন্য বুটিকসহ নানা প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলা হয়েছে। তাদের সন্তানদের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে উত্তরণ শিক্ষালয়। মুন্সীগঞ্জে একটি স্কুলে বেদেদের সন্তানরা লেখাপড়া শিখছে। কেউ কেউ ভর্তি হয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও ইডেন কলেজে। বেদেপল্লীতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি এ সমপ্রদায়ের জন্য তৈরি হচ্ছে মিউজিয়াম। হাবিবুর রহমানের ব্যক্তিগত উদ্যোগে এখন দেশি-বিদেশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান, এনজিও এগিয়ে আসছে।
কর্মক্ষেত্রের বাইরেও অবসর সময়ে প্রতিনিয়ত বই পড়েন পুলিশের এই কর্মকর্তা অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমান। তা ছাড়া তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে নিয়ে বই সম্পাদনা করেছেন, যাতে দেখিয়েছেন দূরদর্শিতা। বইটিতে তুলে আনেন মন্ত্রীর বাল্যকাল, পড়াশোনা, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ সহ রাজনীতিতে অংশ নেয়ার বিষয়াবলি। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয় ‘নন্দিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান খান’ গ্রন্থটি। বইটি প্রকাশ করে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেড। এছাড়া ২০১৮ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা তুলে ধরে একটি বই সম্পাদনা করেন তিনি। যার নাম দেন ‘মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ’। লিখেছেন বেদে সমপ্রদায়ের বিলুপ্তপ্রায় ভাষা নিয়ে ‘ঠার’ নামে একটি বইও। ‘ঠার’-এর বেশির ভাগ শব্দই বাংলা ভাষার আদি রূপ থেকে উদ্ভূত। ভাষাটির নেই কোনো বর্ণ বা লিপি। মূলত এটি কথ্যভাষা। ‘ঠার’ বেদেদের মাতৃভাষা। যা সাধারণ মানুষের বোধগম্যের বাইরে। যদিও ভাষাটি নিয়ে খুব বেশি গবেষণা হয়নি। ব্যক্তি উদ্যোগে কয়েকজন গবেষক ‘ঠার’ ভাষা নিয়ে করছেন গবেষণা। তবে ‘ঠার’ নিয়ে লেখা হয়নি কোনো গ্রন্থ কিংবা পাণ্ডুলিপি। ‘ঠার’ বই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা বইটি দীর্ঘ আট বছর গবেষণার ফসল। যেহেতু ‘ঠার’ বা ‘ঠের’ ভাষাটির লিখিত কোনো রূপ নেই, সেহেতু শব্দটির কোনটি সত্য তা বলা মুশকিল। তাদের মাধ্যমে ভাষাটির শব্দ, ব্যাকরণ উদ্ধারের চেষ্টা করেছি। কখনো কখনো বেদেপল্লীতে উপস্থিত হতে না পারলে বেদেদের আমার অফিসে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। তাদের সাথে কথা বলে অজানা ভাষাটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ বই হিসেবে লিখিত রূপ দেয়ার চেষ্টা করেছি।’
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সেই কালরাতের ভয়াবহ ঘটনা এখন ইতিহাসের পাতায়। বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্নভাবে ওই ঘটনা অবলম্বনে স্বল্প দৈর্ঘ্যের অসংখ্য নাটক নির্মিত হলেও সেই হত্যামামলার নথিসহ বিভিন্ন তথ্যের বিশ্লেষণ ও গবেষণায় ফ্যাক্ট বেইজড মর্মস্পর্শী ডকুমেন্টারি ‘অভিশপ্ত আগস্ট’ নির্মাণ করেন সদ্য পদোন্নতিপ্রাপ্ত পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমান। দেশব্যাপী সাড়াজাগানো কালজয়ী এ নাটকের মঞ্চায়ন করছে ডিএমপি সদর দপ্তরের ডিসি থাকাকালে হাবিবুর রহমানেরই উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত পুলিশ থিয়েটার। এক বছরে ‘অভিশপ্ত আগস্ট’-এর ১১০ বার মঞ্চায়ন করে ইতোমধ্যে বিশ্বরেকর্ডও (আনুষ্ঠানিক স্বীকৃত মেলেনি) করেছে পুলিশ থিয়েটার। তথ্য মতে, অন্য কোনো থিয়েটার গ্রুপ এক বছরে এখন পর্যন্ত কোনো নাটকের শতবার মঞ্চায়ন করতে পারেনি। এ ছাড়া ইতিহাসের খলনায়ক খন্দকার মোশতাকের মূল চরিত্র, সাথে ঘাতকচক্রের অন্য সদস্যের সাথে বঙ্গবন্ধু হত্যার নীলনকশা তৈরি ও সেই ষড়যন্ত্রের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির গোপন পৃষ্ঠপোষকতার চিত্রও এ নাটকে তুলে ধরেছেন হাবিবুর রহমান। নাটকটির নির্দেশক পুলিশ সুপার জাহিদুর রহমান বলেন, এক বছরে ৩৬ জেলা ও রাজধানী মিলিয়ে ১১০ বার মঞ্চায়িত হয়েছে নাটকটি। মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, বুদ্ধিজীবী, সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এই নাটক দেখে আপ্লুত হয়েছেন। তিনি বলেন, দুই বাংলার সব থেকে বড় সাংস্কৃতিক উৎসব গঙ্গা-যমুনা। আগামী ২১ অক্টোবর শিল্পকলা একাডেমিতে এ সাংস্কৃতির অনুষ্ঠানের প্রথম দিনেই ১১১তম মঞ্চায়ন হবে নাটকটির। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও বলছেন, ‘অভিশপ্ত আগস্ট’ নাটকে সে সময়কার প্রকৃত ইতিহাসকেই তুলে ধরা হয়েছে।
হাবিবুর রহমানকে ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি থেকে অতিরিক্ত আইজিপি পদে পদোন্নতি দিয়ে গত সোমবার ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রধান পদে পদায়ন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। এরপরই গতকাল মঙ্গলবার গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তিনি। মানসিকভাবে তিনি এই দীক্ষায় দীক্ষিত— সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম না হলে হয়তো আমরা স্বাধীন হতাম না। আর স্বাধীন না হলে আজকে আমরা যে পুলিশের আইজিপি, অতিরিক্ত আইজিপি কিংবা ডিআইজির চেয়ারে বসেছি সেখানে কোনো পাকিস্তানি বসত। এ জাতির কেউ হয়তো বসতে পারত না। একটি জাতি হিসেবে প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধাও হয়তো পাওয়া যেত না। মহান এই মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই গতকাল সহকর্মীদের সাথে নিয়ে জাতির পিতার সমাধি সৌধের বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন তিনি। পরে পবিত্র ফাতেহা পাঠ করে বঙ্গবন্ধুসহ মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনায় দোয়া ও মোনাজাতে অংশ নেন তিনি। পরে তিনি পরিদর্শন ভবনের রক্ষিত বইতে মন্তব্য লিখে স্বাক্ষরও করেন।